বিশ্বজুড়ে জমে উঠছে পোস্টমর্ডান যুগের 'করোনা অলিম্পিক ২০২০'

৪৮৪ পঠিত ... ২৩:০০, জুন ২৩, ২০২০

অলিম্পিকের আঁতুড়ঘর হলো প্রাচীন গ্রিস। দীর্ঘ বিরতির পর আধুনিক অলিম্পিকের উৎপত্তিও হয়েছিল সে দেশেই। ঠিক একইভাবে উত্তরাধুনিক অলিম্পিকের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচনা করতে হয় চীনকে। একুশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র চীন কীভাবে অলিম্পিকের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল, সে বিষয়েই লিখছি আজ।

বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা হিসেবে আধুনিক অলিম্পিকের যাত্রা শুরু ১৮৯৬ সালে। তখন থেকেই প্রতি ৪ বছর পরপর (দুই বিশ্বযুদ্ধে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলেও) পৃথিবীর বিভিন্ন বড় শহর আয়োজন করে আসছে অলিম্পিকের। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের অলিম্পিক আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছিল জাপানের টোকিও। অথচ টোকিওকে ম্লান করে দুনিয়ার সমস্ত এটেনশন নিয়ে নেয় চীনের এক নাম না জানা শহর উহান। আর নতুন অলিম্পিককে এখন মানুষ, ‘করোনাভাইরাস’, ‘কোভিড নাইন্টিন’, ‘কোভিড উনিশ’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে চেনে।

উহানে শুরু হওয়া এবারের ভিন্নধর্মী অলিম্পিক পালটে দিয়েছে সব হিসাব। একটি শহরে সীমাবদ্ধ না থেকে সত্যিকারের বৈশ্বিক হবার লক্ষ্য নিয়েই যেনো নেমেছে এই অলিম্পিক। অ্যামাজন বা অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক দাবানলকে হার মানিয়ে এটি ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়ার সব শহর-নগর-বন্দর আর গ্রামে। 

অলংকরণ: মুবতাসিম আলভী

এমনিতেই অলিম্পিকে ক্রিকেট, বেজবল, রাগবি কিংবা দাবার মতো অনেকগুলো জনপ্রিয় খেলা না থাকা নিয়ে অনেকের আপত্তি শোনা যায়। কিন্তু এই পোস্টমডার্ন করোনালিম্পিকে এসবের কোনো বালাই নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে নানান খেলার মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য শ্রেণীপেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে দুরন্ত গতিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এটি। অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, এক শতাব্দীর ইতিহাসে প্রথাগত অলিম্পিক যা করতে পারেনি, মাত্র ৬ মাসেই সেটি করে দেখিয়েছে করোনালিম্পিক।

কী নেই এতে? জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আইএমএফ-এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে, তুমুল মিডিয়া কভারেজ, বাজেট, পয়েন্ট টেবিল এবং সর্বোপরি সেই পয়েন্ট টেবিলের উচ্চস্থান দখলের প্রতিযোগীতাও আছে।

অলিম্পিকে একটা সময় রাশিয়া, ইংল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রের বেশ প্রভাব ছিল। একটা সময় যুক্তরাষ্ট্র সবাইকে ছাড়িয়ে উপরে উঠে যায়। গত কয়েক আসর ধরে চীন ধীরে ধীরে টপকে যায় আমেরিকাকেই। সেটিই আসলে চীনের এই নববিপ্লবের ওয়ার্মআপ, এমনটাই ইঙ্গিত করেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

জানুয়ারি মাসে শুরু হওয়া অলিম্পিকের পয়েন্ট টেবিলে প্রথম থেকেই শীর্ষে ছিল মূল আয়োজক চীন। কিছুদিনের মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের ইরানও টেবিলের উপরের দিকে চলে আসে। বৈশ্বিক যেকোনো ইনডেক্সেই শীর্ষে থাকা ইউরোপের দেশগুলোই পিছিয়ে থাকবে কেনো? ইতালি, স্পেন আর যুক্তরাজ্য প্রবল গতিতে টপ টেনে ঢুকে পড়ে। একইসাথে জার্মানি, ফ্রান্স, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডের মতো এগিয়ে থাকা দেশগুলোও একের পর এক মেডেল জিততে থাকে। 

চীন, ইরান ও ইউরোপে যখন করোনালিম্পিকের জয়জয়কার তখনো আমেরিকা, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়া নিস্প্রভ ছিল। তবে মার্চেই আর সবাইকে চমকে দিয়ে আমেরিকা ঘুরে দাঁড়ায়। দেখতে দেখতে তারা একে একে প্রতিটি দেশকেই ছাড়িয়ে যায়। এমনকি সাম্প্রতিক অলিম্পিকগুলোয় চীনের কাছে প্রথম স্থান হারানোর বদলা নিতে তারা এতটাই মরিয়া হয়ে যায় যে, বর্তমানে প্রতি ৪টি মেডেলের ১টি তাদের দখলে। এ বিষয়টি নজর কেড়েছে বোদ্ধাদেরও।

২৩ জুন রাত ১০টা পর্যন্ত করোনা অলিম্পিকের বৈশ্বিক পয়েন্ট চার্ট। অলিম্পিকের শীর্ষ তারকা চীন এখানে একেবারে তলানিতে!

অর্থনীতি, প্রযুক্তিসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমেরিকার মূল প্রতিযোগী এখন চীন। তাই চীনকে বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে আমেরিকা আবারও নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করল বলেই ধারণা করছেন বোদ্ধারা। একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় এক স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির এই একুশ শতকে চীন ও আমেরিকার মধ্যে যে অন্যরকম শীতল যুদ্ধ চলছিল, সেটি যেন এক চূড়ান্ত পরিণতির দেখা পেয়ে গেছে। আর গত কোল্ড ওয়ারের মতোই এবারেও জয়ীর নাম আমেরিকাই! যার পুরো কৃতিত্বই এই চীনে আয়োজিত করোনালিম্পিকের।’ 

এবার একটু নজর দেওয়া যাক তৃতীয় বা উন্নয়নশীল বিশ্বের দিকে। আইনশৃঙ্খলা, শান্তি, অবকাঠামো, বাসযোগ্যতা ইত্যাদি সকল বিচারেই এসব দেশ সবসময় পিছনের কাতারেই থাকে। তবে করোনালিম্পিকের বৈষম্যহীনতা শীর্ষে ওঠার সুযোগ এনে দিয়েছিল সবার সামনে। আফ্রিকার দেশগুলো এ সুযোগকে হেলায় হারিয়ে পিছনে পড়ে থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো শুরুতে কিছুটা বিপাকে পড়লেও পরবর্তী সময়ে ঠিকই উৎরে গেছে।

যার ফলশ্রুতিতে ভারত এখন শীর্ষ ৫-এ জায়গা করে নিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান টপ টেনে ঢোকার অপেক্ষায় আছে। দুর্নীতি ও নানাবিধ অপ্রতুলতায় বাংলাদেশ অধিকাংশ তালিকাতেই পিছিয়ে থাকে। করোনালিম্পিকের শুরুর দিকেও মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশ বুঝি পিছনেই পড়ে থাকবে। প্রতিদিন একশ দেড়শ টেস্ট করে তো টপ টেনে যাওয়া যায় না! তবে এ সময় কর্তৃপক্ষের কিছু ভূমিকা এই সমস্যা থেকে উত্তোরণে খুবই সহায়ক হয়। সাধারণ ছুটি নাকি লকডাউন? এই সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশব্যাপী করোনালিম্পিকের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর ঈদ এসে পড়ায়, সেটি আরও বেগবান হয়।

পাশাপাশি একই সময়ে একটু একটু করে টেস্ট বাড়ানোর ফলে ধীরে ধীরেই বাংলাদেশ সফলতার দিকে এগিয়ে যায়। এর মাঝে আমজনতার উৎসাহী অংশগ্রহণকেও খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ‘পরি মাস্ক না ঢাকি মুখ’, ‘হাতে হাত ধরে কাটাই সামাজিক দূরত্ব’ ইত্যাদি স্লোগানে সাধারণ জনগণ দেশকে করোনালিম্পিকের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করেই চলেছেন। তবে এখনো প্রচুর সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে মতামত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এমনই এক বিশ্লেষক করোনালিম্পিকে বাংলাদেশের অবস্থান ব্যখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের সুযোগ ছিল এতদিনে টপ ফাইভে চলে যাওয়ার। অথচ পর্যাপ্ত টেস্টের অভাবে আমরা সেটা পারলাম না। ফলে অফিশিয়াল নাম্বারে আমরা পিছিয়েই থাকলাম।’ এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি, এই আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি আরও বলেন, ‘ব্রাজিল বা রাশিয়া যে টেবিলের ২ আর ৩ নাম্বারে চলে আসবে সেটাই বা কে ভেবেছিল? সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এখনো সম্ভব টপ ফাইভে চলে যাওয়া!’

করোনালিম্পিক কতদিন চলবে, তা ঠিক বলা যাচ্ছে না। নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনামের মতো বিভিন্ন দেশ এই পোস্টমডার্ন অলিম্পিকের পাঠ চুকিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। অন্যদিকে বাংলাদেশ যেনো অনন্তকাল ধরে এই খেলায় থেকে যাওয়ার পণ করেছে। সামনে কী হবে তা সময়ই বলে দিক, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে যেনো আমরা অনন্য উদাহারণ রেখে যেতে পারি। সেটাই হোক সংকল্প।

৪৮৪ পঠিত ... ২৩:০০, জুন ২৩, ২০২০

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top