ঢাকার যত টোটকা বৈদ্য

১৫১ পঠিত ... ১৮:২৮, জানুয়ারি ২৪, ২০২৪

420092291_7375076219209075_4625329404392840533_n

পূর্ববঙ্গের একটি সম্ভ্রান্ত জাত হলো বৈদ্য। এদের স্থান বৈশ্যের পরে আর কায়েতের আগে। বাংলা বিহারের বাইরে বৈদ্য নেই। শাকদ্বীপের ব্রাহ্মণরাও চিকিৎসক। বৈদ্য জাতের উদ্ভবের বিষয়ে জানা যায় না। তবে, এই জাতের উদ্ভব সম্বন্ধে হিন্দুদের প্রচলিত ধারণা হলো এই- আম্বা নামে এক কুমারী তরুণী নদীর ঘাট থেকে জলভরা কলসি কাঁখে ফিরছিল। পথে দেখা হলো মুনির সাথে। মুনি জল পান করতে চাইল। অম্বা মুনি ঋষিকে জল পান করালে মুনি সন্তুষ্ট হয়ে বর দান করেন- 'অনেক সন্তানের মা হবে তুমি'। স্মিত হেসে অম্বা বলল, 'আমি তো কুমারী, মা হব কেমন করে?' বর দেওয়ার পর তো ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। মুনি তাকে এক আঁটি খড় আনতে বললেন। মুনির ইচ্ছায় খড়ের আঁটিটি রূপান্তরিত হলো একটি শিশুসন্তানে। সন্তান নিয়ে কুমারী ঘরে ফিরতে পারে না। হতবুদ্ধি হয়ে গেল সে। মুনি একজন ব্রাহ্মণকে আনালেন এবং তরুণীকে বিয়ে দিলেন তার সাথে। মুনির কাছেই থাকতে লাগল মেয়েটি। এই অসাধারণ ছেলেটির নাম অমৃত আচার্য। গল্পে মুনি ছেলেটিকে চিকিৎসা শাস্ত্র বা আয়ুর্বেদ শেখাতে লাগলেন। বলা হয় অম্বার আরও কয়েকজন সন্তান হয়। তার মধ্যে একজনের নাম অম্বষ্ঠি। পলব মুনি তাকে আয়ুর্বেদ বা চিকিৎসা শাস্ত্র বিজ্ঞান শেখালেন। ফলিত চিকিৎসাবিদ্যার জনক বলা হয় অন্বষ্ঠকে।‘

ঢাকা শহরে কত কিছুই না আছে। এই কথাটা এখন যেমন সত্য, সেই প্রাচীনকালেও তেমনই সত্য ছিল। প্রতিদিন নতুন নতুন ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছে ঢাকা। সিন্ধু তীরে অন্বষ্ঠ নামে এক জায়গায় ছিল বৈদ্যদের বসবাস। সেখান থেকে বৈদ্যদের একটি দল ভারতে এবং অন্য একটি দল বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেন।

ব্রিটিশ আমলে কিংবা নবাবি আমলে রাজবৈদ্য ছিল। হুমায়ুনের মৃত্যুশয্যায় বাদশা বাবরের জীবন দিয়ে হুমায়ুনের জীবন প্রাপ্তি বৈদ্যর পরামর্শেই হয়েছিল। ঢাকার নবাবি আমলেও রাজদরবারে একমাত্র বৈদ্যরাই নির্বিঘ্নে প্রবেশাধিকার পেতেন। বৈদ্য হিন্দু জমিদারদের চিকিৎসা পরামর্শক সভাসদ আর মুসলমানদের চিকিৎসা পরামর্শক সভাসদ ছিলেন কোবরেজ বা কবিরাজ। তবে প্রচলিত অর্থে কবিরাজ আর বৈদ্যের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। কবিরাজ গাছগাছালির সহায়তায় চিকিৎসা করত আর বৈদ্য গাছগাছালির সঙ্গে ঝাড়-ফুঁক দিয়ে চিকিৎসা করত যাকে দারু-ফুঁক বলা হয়।

উন্নত চিকিৎসা-পদ্ধতি তখনও এই সমতটে পরিচিত না হওয়ার কারণে সেই সময় বৈদ্য ছিল এই সমতটের একমাত্র অবলম্বন। নবাববাড়ির অন্দরমহল থেকে গাজীপুর জঙ্গলে সমানভাবে প্রযোজ্য ছিল। সেই সময়ের জঙ্গলাপূর্ণ ঢাকায় সাপ- ভূতের উৎপাত কমাতে, পেটের পীড়া কিংবা বাতাসলাগা ছাড়াতে প্রতি মহল্লাতেই ওঝা-বৈদ্য পেশাজীবী শ্রেণি গড়ে উঠেছিল, এখনকার ডাক্তারের মতো। এরা আবার কামরূপ-কামাক্ষ্যা থেকে কেউ কেউ দীক্ষা নিয়ে আসতেন। কামরূপ- কামাক্ষ্যা থেকে দীক্ষা নিয়ে আসা বৈদ্যদের আলাদা কদর ছিল। এখনকার আমেরিকা-ইউরোপ থেকে ইন্টার্নি করে আসা ডাক্তারের মতো। বৈদ্যরা সমাজের মর্যাদাপূর্ণ জায়গা দখল করে ছিল এক সময়। সব মহল্লাতেই ছিল বৈদ্যদের বসবাস। যে মহল্লায় বৈদ্য ছিল না, সেখানে অন্য এলাকা থেকে এসে রোগীদের খোঁজখবর নিত বৈদ্যরা। এদের কাজ ছিল পেটের পীড়া, শরীর গরম, বাতাস লাগা, স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা থেকে শুরু করে বাটি চালান দেওয়া, আয়না পড়ানো, চোর ধরা, সংসারের আয়-উন্নতির ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন তুঘলকি কাণ্ড-কীর্তি করা।

পুলিশের সেই সময়কার খাতা ঘেঁটে দেখা গেছে ১৮৩৭ সাল পর্যন্তও ঢাকায় প্রতি বছর কমপক্ষে একজন মানুষ বাঘের হাতে নিহত হয়েছে। বাঘ, ভূত-প্রেত আর দারুটোনা বিতরণের প্রয়োজনে তাই সতেরো শতকে বৈদ্য খুব প্রয়োজনীয় ছিল ঢাকায়। তবে এই উনিশ শতকে এসেও পত্রিকার পাতায় সেদিনও ওঝার বিজ্ঞাপন দেখা যেত। সাপের মণি দিয়ে চিকিৎসা করানোর কথা বলা হতো সেসব বিজ্ঞাপনে। মোনা-মোনি দিয়ে সংসার জোড়া লাগানোর কথা বলা হতো। মানুষের অশিক্ষাকে পুঁজি করে অপরিচিত রোগকে জিন-ভূতের আছর বলে দারুটোনা দিতেন বৈদ্যরা। পত্রিকার পাতায় বিজ্ঞাপন না এলেও এখনও ঢাকায় বৈদ্যরা বহাল-তবিয়তেই আছেন এই ডিজিটাল এক বিশ্বের যুগে। একটু চোখ খুললেই চোখে পড়ে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যতটুকু অবলোকন করা যায়, আমরা মনে করি এতটুকুই ঢাকা। এর বাইরে আমাদের অনুপস্থিতিতে আবার কখনও আমাদের গোচরেও অনেক কিছু ঘটে। যেমন মিরপুর বস্তি এলাকায়, রায়েরবাজার, বাসাবো, যাত্রাবাড়ী এলাকায় প্রতিদিন খুব সকালে বসে কিছু বৈদ্য বা ওঝা। জন্ডিসের চিকিৎসা করতে এরা হাত ও মাথা ধুইয়ে দেয়। এরা দাবি করে এতে করে জন্ডিস ভালো হয়ে যায়।

দয়াগঞ্জ বাজারের রেললাইন ঘেঁষে মানুষের বড়ো একটা লাইন। এত ভোরবেলা লাইন কীসের? শিশু, বুড়ো, তরুণী সব বয়সি মানুষই আছে। এগিয়ে চোখে পড়ল, চৌকিতে বসে লাল পরিধান গায়ে একজন হাসতে হাসতে কথা বলছেন। তার সামনে চৌকি পাতা। লাইন থেকে একজন গিয়ে বসছে চৌকিতে। একটা চামচে চুনের মতো কী একটা নিয়ে হাতে দিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন লোকটি। তারপর প্লাস্টিকের বদনা থেকে পানি ঢালছেন মাথায়। একজন উঠে যাচ্ছে আবার আরেকজন বসছে।

মাত্র মাথা ধুয়েছে আছমা বেগম, বয়স ৩০। জানা গেল এসেছেন শ্যামপুর থেকে। বললেন, 'অন্নেকদিন দইরা মাথা গুরায়, চোখ লাল হইয়া থায়ে। এর লেইন্না আমার শাশুড়ি এই খানে লইয়া আইছে। মাথা ধোয়াইলেই নাকি ঠিক অইয়া যাইব।' আক্কাস মিয়া (বয়স ৭০), নিলা আক্তার (বয়স ৯), বিলাল হোসেন (বয়স ১৮)-এর মতো আরও অনেকেই এসেছেন জন্ডিস রোগ থেকে সেরে উঠতে মাথা ধোয়াবেন বলে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে আক্কাস মিয়া এসেছেন দিনাজপুর থেকে। অনেকদিন হয় জন্ডিসে ভুগছেন। ঢাকায় চাকুরে ছেলে নিয়ে এসেছেন এখানে চিকিৎসার জন্য।

সমস্ত ঢাকায় আছে এমন টোটকা বৈদ্য। সায়েদাবাদের গোলাপবাগ থেকে নতুন রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলে সায়েদাবাদ ব্রিজ পার হয়ে দয়াগঞ্জ রেলব্রিজ পর্যন্ত গেলে কম করে হলেও ৮ থেকে ১০ জন মাথা ধোয়ানোর বৈদ্য চোখে পড়বে। এদের কয়েকজনের নামও জানা গেল ইসলামিয়া হাসপাতালের সামনে বসেন ইয়াসমিন বেগম। সায়েদাবাদ ব্রিজের পূর্বপাশে বসেন খবির মিয়া। দয়াগঞ্জ মোড়ে বসেন লাল মিয়া। আর ব্রিজের পাশে ইসমাইল মিয়া। এখানে যারা বসেন সবারই আছে নাম-ডাক। সবার সামনেই দেখা যাবে দুই-একজন রোগী। যারা কি না মাথা ধোয়াতে এসেছে। তবে রেলব্রিজের পাশে বসা ইসমাইল মিয়ার সামনে প্রতিদিন থাকে রোগীর উপচে পড়া ভিড়।

তথ্যসূত্র: ঢাকার প্রাচীন পেশা ও তার বিবর্তন, ইমরান উজ জামান

১৫১ পঠিত ... ১৮:২৮, জানুয়ারি ২৪, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top