ঢাকা ও ঢাকার ওঝা

১২৮ পঠিত ... ১৭:৪৪, নভেম্বর ২৯, ২০২৩

3

রোমান ওঝাদের বলা হতো হ্যারাসপেকস। ল্যাটিন ভাষায় পেট-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত শব্দ থেকে এ রকম নামকরণ। ভারতীয় ওঝাদেরও নামকরণ ওই রকম। 'ওঝা' মানে হলো পেট। রোমান ও ভারতীয় ওঝা উভয়ই রোগীর পেট পরীক্ষা করতেন তাই এ ধরনের নাম। আজকাল এ বিদ্যা বিলুপ্ত প্রায়। যে কয়জন আছেন, তারা মানুষকে বোকা বানানোর জন্য যার যার মতো পদ্ধতি প্রয়োগ করে রোগীর নিরাময়ের ব্যবস্থা করেন।

মুসলমান ওঝা দুআতি নামে পরিচিত। আর হিন্দু ওঝা, ওঝা রোঝা, নয়তোবা গুনিন। জেমস ওয়াইজ অবশ্য অন্য জায়গাতে বনাজী চিকিৎসকদের বৈদ্য বলেছেন।

পিলখানার পাশে ছিল চৌদারটুলী ঢাকা বিশেষজ্ঞ নাজির হোসেন তাঁর 'কিংবদন্তির ঢাকা'য় লিখেছেন, ‘(চৌদারটুলী) এ মহল্লার পাশে রয়েছে গণকটুলী। ভাগ্য গণনাকারীগণ এখানে বাস করত বলেই এলাকাটি গণকটুলী নামে সবার কাছে পরিচিত হয়ে আসছে।' সেই সময়কার ঢাকায় তাদের রুজি-রোজগার ছিল খুব ভালো। নাজির হোসেন আরও বলেন, 'এক সময় ঢাকায় হিন্দু জ্যোতিষীদের দৌরাত্ম্য খুব বেড়ে গিয়েছিল। ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এমনকি অধিকাংশ মুসলিম পরিবারের লোকজন তাদের শরণাপন্ন হতো।'

নাজির হোসেন ও অন্যান্য তথ্য থেকে বোঝা যায় জ্যোতিষ বা গণকদের বসতিকে কেন্দ্র করে মোগল শাসনামলে ঢাকার আজিমপুরের একটি অংশ পরিচিতি পায় গণকটুলী নামে। অনগ্রসর ঢাকাবাসী ছোটখাটো চুরি থেকে শুরু করে সব কঠিন সমস্যায় গণকদের শরণাপন্ন হতো। তবে জেমস টেইলরের বর্ণনায়- গণক বা আচার্যরা হচ্ছে অধঃপতিত ব্রাহ্মণ। এরা প্রতিমা নির্মাণ ও এর চিত্রাঙ্কন বা নকশাকরণ কাজে নিযুক্ত। জ্যোতিষী ও ভাগ্য গণনাকারীরা বিক্রমপুরের পণ্ডিত সমাজের প্রস্তুত করা পঞ্জিকাদি নকলের কাজ করে। চুরি উদঘাটনের জন্য এদের দক্ষতার বিশেষ নাম-ডাক ছিল। চাল চিবিয়ে এরা চোর ধরতে পারত।

নবাব আর জমিদারদের তো জ্যোতিষী ছাড়া চলতই না। যুদ্ধ, বিয়েশাদি, আচার- অনুষ্ঠান, গমনাগমনে জ্যোতিষের গণনা বা ভবিষ্যদ্বাণী শুনে তবেই কাজ করত জমিদাররা।

বাদশাহ বাবরের দরবারে ছিল রাজ জ্যোতিষী। এই শাহি জ্যোতিষীর পরামর্শে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। বাবরের প্রতিপক্ষ রাজপুত রানা সংঘের সঙ্গে খানুয়ার যুদ্ধে এই শাহি জ্যোতিষির ভূমিকা ছিল। জ্যোতিষীর কথায় সেই যুদ্ধে সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হয়েছিল।

ইতিহাসে জ্যোতিষী বা গণকদের ভূমিকা এতই বেশি ছিল যে, কোনো কোনো যুগের প্রবর্তক তারা। এছাড়া সম্রাট আকবরের নির্দেশে প্রচলিত হিজরি সালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফসলি সাল বা বাংলা সাল উদ্ভাবন করেছিলেন আকবরের রাজ-জ্যোতিষী আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজী।

জ্যোতিষ চর্চা করে কোটিপতি হয়ে যাওয়া ঢাকার জ্যোতিষরাই এর প্রমাণ। এরা স্ব-ঘোষিত জ্যোতিষরত্ন বা হস্তবিশারদ। প্রতিদিনের খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে ব্যানার-ফেস্টুন দেখেই বোঝা যায় এদের ব্যবসাপাতি যে ভালো। পাঁচতাঁরা ও বড়ো বড়ো বিপণি বিতানের আলো ঝলমল দালানে বসে এরা মানুষের হাত দেখে অতীত-ভবিষ্যৎ বাতলে দেন। পাথর আর কথন দিয়ে ছাড়িয়ে দেন রাহুর গ্রাস। তবে এদের অনেকেরই ভাগ্য কিন্তু কখনও রাহুগ্রাসমুক্ত হয় না। বিশেষ একটা বিষয়- প্রাচীন জ্যোতিষ শাস্ত্রে কারও বিশ্বাস না থাকলেও অভিজাত ও প্রগতিবাদী পত্রিকাগুলোয় কিন্তু প্রতিদিন ভাগ্য গণনা বা রাশিচক্র নিয়ে একটা করে পাতা থাকে। আর অনেক জ্যোতিষ শাস্ত্রবিরোধী মানুষ কিন্তু একবার হলেও এই পাতাটি খুলে দেখেন। সকালে রাশিচক্র পড়ে শান্তির ঢেকুর তুলে অথবা গম্ভীর বদনে ঘর থেকে বের হন। এমন প্রমাণ আছে বইকি।

এ তো গেল সেভেন স্টার আর ফাইভ স্টার জ্যোতিষীদের কথা। ঢাকার রাজপথের কানি-কোনায় এক ধরনের জ্যোতিষ বা ভাগ্যগণক বসেন টিয়ার ঠোঁটে খাম তুলে সেই খামে থাকা রাক্ষস-খোক্ষসের বাণী বাতলে মানুষের অতীত- ভবিষ্যৎ বলে দেন এরা। মোমের নিচে অন্ধকারের মতো এদের সারা জীবন রাস্তায় কাটে।

তবে ভবিষ্যৎ গণনা বা অ্যাস্ট্রোলজি নিয়ে আজকাল পড়াশোনা হচ্ছে। তাছাড়া বড়ো বড়ো হাসপাতালে ডাক্তারের সঙ্গে একজন অ্যাস্ট্রোলজারও থাকেন। কাজেই জ্যোতিষ বিদ্যা আজকাল আর রাস্তার বিষয় নয়। ঢাকায় জ্যোতিষী বা গণক ঠাকুর প্রথা অতি প্রাচীন। ঢাকায় সেই সময় প্রমাণ পরিমাণ গণক বাস করত।

গণকরা ছিল সংস্কৃত জ্ঞানশূন্য। সেই সময়ে সংস্কৃত জ্ঞানশূন্যদের অশিক্ষিতের পর্যায়ে ফেলা হতো। তবে কোনো কোনো গণক সেই সময় সংস্কৃত জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে পণ্ডিতের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। সাধারণ গণকদের কাজ গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান নিশ্চিত করে মানুষের ভাগ্য ও আসন্ন শুভ ও অশুভ হিসাব-নিকাশ হলেও, পণ্ডিতদের কাজ ছিল সাল বর্ষ নির্ধারণসহ অন্যান্য রাজ-কর্ম সম্পাদন করা।

তথ্যসূত্র: ঢাকার প্রাচীন পেশা ও তার বিবর্তন, ইমরান উজ জামান

১২৮ পঠিত ... ১৭:৪৪, নভেম্বর ২৯, ২০২৩

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top