ব্যাংক ডাকাতদের নিয়ে আরও কিছু কথা, সঙ্গে দুটি ফাউ গল্প

৩৬৯৫ পঠিত ... ০১:০৪, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৬

অলংকরণ : গেসপারব্যাংক ডাকাতদের নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম প্রথম আলোতে। উপসম্পাদকীয়, যাকে আমরা বলি কলাম। এই পাতায় লেখার নিচে পরিচয় ছাড়াও ইমেইল এড্রেস দেওয়া সুযোগ থাকে। পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানার একটা সুযোগ এটি। লেখাটি গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তে  প্রকাশ পাওয়ার পর এখন পর্যন্ত আমি ৯টি মেইল পেয়েছি। এর মধ্যে আটটিই প্রশংসা। প্রশংসা কে না পছন্দ করে। তবে একটি ছিল নিন্দা। নামটা না বললাম। বরং কি লিখেছেন সেইটা বলি। তিনি লিখেছেন, ‘ব্যাংক ডাকাতির দু’মিনিটের মধ্যে সব ধরনের তথ্য নিয়ে ম্যানেজারের রুমে হাজির একজন সাংবাদিক। তুমুল দরকষাকষির পর রফা হলো তিন কোটি টাকার অর্ধেক, না হলে পরদিন সবকিছু ফাঁসের ব্ল্যাকমেইল। সাংবাদিক সাহেব দেড় কোটি টাকার হিসাব বুঝে পেয়ে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল–এর নাম হচ্ছে ডাকাতের ওপর বাটপারি।
তা হলে কে বড় ডাকাত?’
কথাটা কিন্তু ওই পাঠক খারাপ বলেননি। তাহলে একটা ঘটনার কথা বলি। মনজুর ছিলেন আমার সহকর্মী। ব্যাংক বিষয়ে দেশের সেরা রিপোর্টার। একবার মনজুর প্রভাবশালী এক ব্যাংকারের চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করল। এর আগেও মনজুরের করা রিপোর্টের কারণে একাধিক ব্যাংকারের চাকরি গেছে। মনজুর এমনিতেই অলটাইম উত্তেজিত রিপোর্টার। ওই রাতে দেখলাম আরও উত্তেজিত। কি ব্যাপার?
জানলাম যে এক সিনিয়র সাংবাদিক বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে দাওয়াত দিয়েছেন একটি পাঁচ তারা হোটেলে। সাংবাদিকেরা গিয়ে দেখেন আলোচিত সেই ব্যাংকার হাজির। মূলত দাওয়াতটা ব্যাংকারের, আর সম্পাদক তার পক্ষে আয়োজক। বিনিময়ে অর্থ প্রাপ্তি। সেই সাংবাদিক (এখন সম্পাদক) এখনো দেখি নানা ফোরামে দেশ ও জাতিকে সুসাংবাদিকতা শেখান।

হায় হল-মার্ক, হায় সম্পাদক, হায় মন্ত্রী!

হল-মার্ক কেলেঙ্কারির কাহিনি তো সবাই জানি। আমার ধারণা হল-মার্ক কেলেঙ্কারি পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়ার মতো বিষয়। ব্যাংক ও আর্থিক অপরাধের ক্ষেত্রে এটি একটি অনন্য উদাহরণ। আর্থিক অপরাধ নিয়ে যারা লেখাপড়া করেন, তারা এর চেয়ে ভালো কেস স্টাডি আর কয়টা পাবেন।
বলতে দ্বিধা নেই, এর আগে হল-মার্কের নাম তেমন শুনিনি। আমাদের মনজুর যখন রিপোর্টটি নিয়ে আসল তখনো মনে হয়েছিল কোনো এক অখ্যাত হল-মার্ক, কত দূর আর কি করবে। এর চেয়েও বড় বড় প্রতিষ্ঠিত ‘ব্যাংক ডাকাত’ তো দেশেই আছে। পরে শুনেছিলাম হল-মার্কের কাণ্ডকীর্তি শুনে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক ডাকাতেরা লজ্জা পেয়েছিল। পরে আরও জানলাম অর্থনৈতিক সাংবাদিক হিসেবে হল-মার্কের নাম না জানি, কিন্তু হল-মার্কের অন্দরমহলের সাংবাদিকের সংখ্যা কম নেই। বলাই বাহুল্য সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা তো এই দেশে কেউ একা একা খেতে পারবে না।
সাংবাদিকেরা এই কেলেঙ্কারি নিয়েও লিখলেন। কিন্তু তেমন কিছু হচ্ছে না। তারপর একদিন জানা গেল হল-মার্ক কর্তৃপক্ষ নতুন একটি আবেদন জানিয়েছে সরকারের কাছে। আর সেটি হলো তাদের একটি সুযোগ দেওয়া হোক। অর্থমন্ত্রী নিজেও এই মতের দিকে শুরুতে কিছুটা সায় দিয়েছিলেন। এর পরে দেখা গেল এক সম্পাদক টকশোতে বলছেন, হল-মার্ককে আরেকবার সুযোগ দেওয়া উচিত, এর সঙ্গে ১০ হাজার শ্রমিক জড়িত, ইত্যাদি ইত্যাদি।
শেষ পর্যন্ত কাজ কিন্তু হয়নি ব্যাপক সমালোচনার কারণে। অবশ্য পক্ষে বলা ও লেখার জন্য নেওয়া অর্থ ফেরত দিতে হয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি।

ঋণ পাওয়ার উপায়

এক পত্রিকায় কিছুদিন পর পরই দেখা যায় নানান ব্যাংক নিয়ে রিপোর্ট। ভাষা মোটামুটি একই। ব্যাংকটি যে কত খারাপ, এর এমডি যে ব্যাংকটিকে ডোবাচ্ছেন, পরিচালনা পর্ষদ যে কত বড় চোর সেসবই লেখা থাকে। প্রতিবারই খোঁজ নিয়ে জানা যায় ব্যাংক আর ঋণ দিচ্ছে না, অথবা নবায়ন করছে না, অথবা সীমা বাড়াচ্ছে না।

একটা শোনা ঘটনা বলি। একবার এক ব্যাংক ঋণ প্রস্তাবটি বাতিল করে দিল অথবা পর্ষদ সভাতেই তোলা হচ্ছিল না। তার কয়েক দিন পর ব্যবস্থাপনা পরিচালক একটা ফোন পেলেন। এক পত্রিকা মালিক বললেন, ‘কাল একদল হিজড়া আপনার বাসার সামনে গিয়ে চিৎকার করে বলবে আপনি কাম করে পয়সা দেন নাই’। শোনা যায় শেষ পর্যন্ত ঋণ তিনি পেয়েছিলেন।

হায় টোয়েন্টিফোর ডটকম

একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের কথা বলি। একটা বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের একটা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। মোবাইল ফোনে সংবাদ দেওয়া-নেওয়া জাতীয় কিছু একটা। এই কাজটির জন্য আবার দরপত্র ডাকাডাকির মতো নানা কাজ কারবার করতে হয়। একদিন দেখা গেল, নিউজ পোর্টালটি বড় প্রতিষ্ঠানের একগাদা অনিয়ম নিয়ে দিনের পর দিন লিখে চলছে। এ নিয়ে বেশ হইচইও হলো। কাহিনি কি? শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে...পোর্টালটি দরপত্রে কাজ পায়নি। অতএব লেখো...তারা লিখলো বটে! 
ইদানীং এরা এবার সু বা সৎ সাংবাদিকতার ঠিকাদারি নিয়েছে কোনো দরপত্র ছাড়াই।
এসব অসমর্থিত তথ্যে ভরপুর লেখাটা কিনো লিখলাম, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না। ভুল স্বীকার বা ক্ষমা-টমা চাইতে পারব না কিন্তু।

রূপালি পর্দায় ব্যাংক ডাকাত

বরং ব্যাংক ডাকাতদের নিয়েই থাকি। নেট ঘেঁটে দেখলাম ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে তৈরি সিনেমার সংখ্যা খুব কম নয়। তবে বেশির ভাগই কবির কল্পনার ডাকাতি। আবার সত্য সত্য ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা নিয়েও সিনেমা হয়েছে। এর মধ্যে আমি লিখেছিলাম ডগ ডে আফটারনুন নিয়ে। আল পাচিনোর ভক্ত ছাড়াও, ভালো সিনেমার ভক্তদের এই ছবিটি দেখা অবশ্য কর্তব্য। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমার পরিচালক সিডনি লুমিট। ১৯৭২ সালের ২২ আগস্ট ব্রুকলিন ব্যাংকে ডাকাতি হয়েছিল। সেই ঘটনা থেকেই সিনেমাটি করা। ডাকাতির ঘটনাটি ১৯৭২ সালেই লাইফ ম্যাগাজিনে লিখেছিলেন পি এফ ক্লুজ নামের একজন সাংবাদিক।

তবে ব্যাংক ডাকাতির ভয়াবহ ঘটনাটি সম্ভবত বনি পার্কার ও ক্লাইড বোরোর করা। এই জুটি এখন অপরাধ জগতের ইতিহাসের একটি অংশ। ধনী হতে এক জোট বেঁধেছিল বনি ও ক্লাইড। করেনি এমন কিছু নেই। শেষটা ছিল ব্যাংক ডাকাতি। পুরোটাই সত্যি ঘটনা। ১৯৩৪ সালের সেই ঘটনা নিয়ে সিনেমাটি হয়। অতি বিখ্যাত এই সিনেমাটির নাম বনি অ্যান্ড ক্লাইড। ১৯৩৪ সালের কিন্তু একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। বিশেষ করে একজন অর্থনৈতিক সাংবাদিক হিসেবে তাৎপর্যের কথাটা বলতেই পারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২৯ সালে শুরু হওয়া সেই বিশ্ব মহামন্দার প্রভাব ছিল এটি। অনেকেই এ সময় বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যায়। যেমন, বনি ও ক্লাইড। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটিতে আছেন ওয়ারেন বেটি ও ফায়ে ডানাওয়ে। সিনেমা জগতের অন্যতম রক্তাক্ত মৃত্যুদৃশ্য-এর জন্য এই সিনেমাটির নাম বেশিবার উচ্চারিত। অবশ্য কর্তব্য এই সিনেমাটি দেখা।
যারা হিন্দি সিনেমার নাম শুনে কপাল কুচকান, তাদেরও একটি ব্যাংক ডাকাতির সিনেমা দেখতে বলি। ‘শোর ইন দ্য সিটি’। ২০১১ সালের এই সিনেমার সঙ্গে প্রথাগত হিন্দি সিনেমাকে মেলানো যাবে না। এখানেও আছে এক ব্যাংক ডাকাতি। এবার একটু লোভ দেখাই। এই সিনেমার নায়িকা রাধিকা আপ্তে। আর বোনাস হচ্ছে শ্রেয়া ঘোষালের কণ্ঠে ‘সাইবো’ নামে অসাধারণ সুন্দর একটা গান।

দুটি গল্প, একটি সুশীল আরেকটি মাসুমসীমার বাইরে

মূল লেখাটিতে ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে একটা গল্প দিয়েছিলাম। খুঁজতে গিয়ে আরও দুটি গল্প পাই। এর একটি সুশীল, আগেও আমি আমার এক রম্যে ব্যবহার করেছি। আরেকটি গল্প মাসুমসীমা পার করার গল্প। আগে সুশীলটা বলি।

ডাকাত পড়ল ব্যাংকে। ভল্ট থেকে সব অর্থ তুলে নেওয়ার পর ব্যাংকের ভেতরে থাকা সবাইকে এক লাইনে দাঁড়াতে বলল ডাকাতেরা। ডাকাত সর্দার গাব্বার সিং হাসমত তালুকদারকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি দেখেছ যে আমরা ডাকাতি করেছি?
কাঁপতে কাঁপতে হাসমত তালুকদার বলল, জি, দেখেছি। সঙ্গে সঙ্গে একটা গুলি। লুটিয়ে পড়ল হাসমত। রক্তে ভেসে গেল ব্যাংকের মেঝে।
পাশে দাঁড়ানো আক্কাস আলী। ডাকাত সর্দার এবার তার কাছে জানতে চাইল, তুমিও কি দেখেছ যে আমরা ডাকাতি করেছি? আক্কাস আলী ওপর-নিচে মাথা নেড়েছে কি নাড়েনি, তার আগেই গুলি। লুটিয়ে পড়ল রক্তাক্ত আক্কাস আলী।
এরপরেই দাঁড়ানো জুলমত খোন্দকার ও তার স্ত্রী জরিনা বানু। ডাকাত সর্দার এবার জুলমতের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটি করতে গেল। তার আগেই জুলমত খোন্দকার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বউকে দেখিয়ে বলল, ‘আমি দেখিনি, তবে আমার বউ দেখেছে।’

সবশেষ গল্পটা এবার, তিন ব্যাংক ডাকাত গভীর রাতে ব্যাংকের তালা ভাঙল। ভাঙল ভল্টের তালা। কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো টাকা পেল না। এক ডাকাত খুঁজে পেল গোপন এক বাক্স। সে তখন তার সঙ্গীকে জানাল, টাকা-পয়সা কিছু নাই। কেবল আছে খাওয়ার জন্য এক বাটি দই। কি আর করা। দইটা খেয়ে তারা চলে গেল।
পরের দিন বড় বড় শিরোনামে খবর দেওয়া হলো-‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্পার্ম ব্যাংকে ভয়াবহ ডাকাতি’। 

৩৬৯৫ পঠিত ... ০১:০৪, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৬

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top