বাচ্চাটা

৭৫ পঠিত ... ১৭:১৪, এপ্রিল ০৬, ২০২৫

24-thumb

লেখা: নুসরৎ নওরিন

খিদে লাগলেই আমি বাচ্চাটার শরীর থেকে কোনো না কোনো অংশ খাই। বাচ্চাটা তেমন প্রতিবাদ করে না। বরং কোনো কোনো সময় মনে হয় কাজটা যেন সহজে করতে পারি, সেজন্য যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করে।

এই তো, গত সপ্তাহে, বারবার ব্যবহারে ভোঁতা হয়ে যাওয়া ছুরিটা দিয়ে ওর বাম হাতটা ঠিকমতো আলাদা করতে পারছিলাম না, রক্ত লেগে হাত পিছলে যাচ্ছিল। তখন অন্য হাতটা দিয়ে ও নাইফ ব্লক থেকে ধারালো, চকচকে, বড় একটা ছুরি নামিয়ে দিল। এক মুহূর্ত থেমে চোখ কুঁচকে আমি বোঝার চেষ্টা করলাম কী হচ্ছে। বুঝতে যে সময় লাগল, তার মধ্যে আমি একটু অধৈর্য্যও হয়ে গেলাম। তারপর বুঝলাম সেই ছুরিটা, মূলত একটা ক্লিভার, সে আমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।

ওর শরীরের একেকটা অংশ দিয়ে খিদে মিটিয়ে কতদিন পার হয়েছে জানি না। কয়েক মাস…বছরও হতে পারে। পুষ্টিকর তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। পা, কোমড়, পেট শেষ করে বুকের ওপরের দিকে পৌঁছে গিয়েছি। এখন বাকি মোটে একটা হাত, গলা এবং মাথা। একটু একটু গন্ধ হওয়ার আগেই আমি বাচ্চাটার অবশিষ্ট অংশ ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখেছি।

একদিন বের করে ডাইনিং টেবিলের বিরাট ট্রের ওপর রাখতেই সূক্ষ্ম, সাদাটে একটা ধোঁয়া বের হতে লাগল। খেয়াল করলাম, চামড়াটা মসৃণতা হারাচ্ছে। আর চোখের সাদা অংশটাও কালো হতে শুরু করেছে। মাংসের কোয়ালিটি পড়তে শুরু করেছে, একটু হতাশ হলাম।

ইন্টারনেট ঘেটে দেখি, ভ্যাকুয়াম করে বায়ুশূন্য অবস্থায় প্যাকেটজাত করলে বেশিদিন মাংস ফ্রেশ রাখা যায়। হাড়সহ রাখা ভালো। ফ্রিজের তাপমাত্রা রাখতে হবে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১৮ এর নিচে। লবণ বা এসিড জাতীয় কিছু দেওয়া যাবে না।

ঠিক সেভাবেই করলাম। হাতটা ভাঁজ করতে গিয়ে বেশ সমস্যা হলো। বাচ্চাটা তখনও মন দিয়ে আমার কাজকর্ম দেখছে। তার চোখে আলাদা করে কোনো মণি নেই অবশ্য, ফলে কোনদিকে যে তাকাচ্ছে তা নিখুঁতভাবে বোঝা যায় না, তবে আমার দিকেই যে তাকিয়ে আছে নিশ্চিত। কাঁপা কাঁপাভাবে মাথাটা আমার গতিবিধির দিকে সরে যাওয়া দেখে বোঝা যায়।

প্যাকেট করার পর ফ্রিজে রেখে দরজা আটকাতেই একটা স্বস্তি নেমে এলো মনে। বড়সড় একটা প্রস্তুতি শেষ। আগামী কয়েকটা দিন খাবারের চিন্তা করতে হবে না।

ড্রইং রুমে টিভি ছেড়ে দিয়ে, বুকশেলফ থেকে না-পড়া ঝলমলে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে আর দুই পেগ ভদকার গ্লাস হাতে এখন আমি ডিভানে আধশোয়া। আসলে টিভি দেখব না, ম্যাগাজিনও পড়ব না। শুধু স্ক্রল করে যাব। এই যে, আলস্যভরে এগুলোতে ঢুঁ মারার মধ্যে যে অবসরের অনুভুতি, সেটাই মুখ্য।

ম্যাগাজিনের মসৃণ পাতায় হাই রেজুলেশনের, নিখুঁত পিক্সেলের ছবিওয়ালা পাতাগুলো উল্টে যেতে যেতে হঠাৎ আমার হাত থেকে ভদকার গ্লাসটা পড়ে গেল। সমস্ত শরীরে একটা অদ্ভুত ঝাঁকুনি। উঠে বসলাম আমি। হাতের চামড়ায় মৃদু গরম কিছুর ছোঁয়া পেয়ে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডান হাতের দুই আঙুল চোখের কোণে উঠে এলো। চোখ থেকে পানি ঝরছে। বেশ পরিমাণে। সেই সাথে বুকের ভেতর থেকে একটা চাপা শব্দ বের হয়ে আসছে। যেন, দলছুট কোনো আহত নেকড়ে দুর্বোধ্য ব্যথায় চিৎকার করছে।

শরীরে কোনো শক্তি নেই। তবু কাঁপতে কাঁপতে কোনো রকমে কিচেনে গিয়ে আমি ফ্রিজের দরজা খুলি। বাচ্চাটা তখনও সম্পূর্ণ কালো হয়ে যাওয়া দুই চোখে, যেই চোখে খুব আর্তি, তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আর একটিমাত্র হাতের জড়তা ধীরে ধীরে কাটিয়ে, সেটাকে আমার দিকে উঠিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে।

পুরু, স্বচ্ছ প্লাস্টিকের প্যাকেটটা খোলার সাথে বাচ্চাটা আমার নরম চুলে এক হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। বোঝা যায় কী যায় না, এমন অস্ফুট, কিন্তু মায়াবী স্বরে বলল, কেঁদো না, মা, কেঁদো না। প্লিজ। কেঁদো না।

৭৫ পঠিত ... ১৭:১৪, এপ্রিল ০৬, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top