১#
পণ্ডিত রবি শঙ্করের দুর্ভাবনা ছিলো, জর্জ হ্যারিসন হয়তো কনসার্টের ব্যাপারটা খুব একটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন না। তিনি জর্জকে পুরো বিষয়টাই ভালো করে বোঝালেন। তারপর বললেন– ‘জর্জ, এই হলো অবস্থা, আমি জানি এটা তোমার দুর্ভাবনার বিষয় না, তুমি সম্ভবত এটা বুঝে উঠতেও পারবে না।’
জর্জ অবশ্য বেশ আবেগতাড়িত গলাতেই বলে উঠলেন– ‘হ্যাঁ, আমার মনে হয় কিছু একটা করা সম্ভব।’
দুই দেশের, দু’টি ভিন্ন সঙ্গিত ঘরানার, দুই জনপ্রিয় শিল্পী- পণ্ডিত রবি শঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনকে ব্যথিত করে তুললো বাংলাদেশের ২৫ মার্চের সেই ভয়াল কালো রাত। ‘কিছু একটা করার’ প্রয়াস থেকে তারা আয়োজন করে ফেললেন সেই ইতিহাস বিখ্যাত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।
২#
কোনো ধরনের পশ্চিমা সঙ্গীত নয়, ‘বাংলা ধুন’ দিয়ে শুরু হয়েছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। পণ্ডিত রবি শঙ্কর বিশেষভাবে তৈরি করেছিলেন এই ধুন। তার সাথে ছিলেন ভারতীয় শিল্পী আল্লা রাখা খান, আকবর আলী খান। ছিলেন একমাত্র নারী সদস্য কমলা চক্রবর্তী। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এক ঐতিহাসিক মেলবন্ধন ঘটে সেদিন।
৩#
পপ সঙ্গীতের জনপ্রিয় ব্যান্ড দ্য বিটলসের ভাঙনের পর এটিই ছিল বিটলসের সদস্য জর্জ হ্যারিসনের প্রথম নিজস্ব কনসার্ট। তিনি কনসার্টের জন্যে রচনা করেন বাংলা দেশ (Bangla Desh) গান। ব্যান্ড সদস্যদের অভিমান থাকে খুব তীব্র। বিশেষ করে ভাঙনের পর। কিন্তু বিটলসের সদস্যদের পথ বদলে গেলেও হ্যারিসন জন লেনন, পল ম্যাককার্টনি ও রিংগো স্টারকে তার সাথে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এ যোগ দিয়ে বাংলাদেশের জন্য একসাথে গলা মেলাতে আমন্ত্রণ জানান। এছাড়াও তিনি আমন্ত্রণ করেছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, লিওন রাসেলের মত কিংবদন্তী সব শিল্পীদের।
৪#
জন লেনন কনসার্ট করতে রাজি হয়ে যান। কিন্তু অদ্ভুত এক শর্ত দিয়েছিলেন হ্যারিসন, জন লেননের সাথে তার স্ত্রী ইয়োকো ওনো গাইতে পারবেন না। তাতে রাজিও ছিলেন শিল্পী। কিন্তু শোনা যায়, এ নিয়ে ইয়োকো ওনোর সাথে ঝগড়া হলে কনসার্টের দুইদিন আগে নিউইয়র্ক ছাড়েন লেনন।
৫#
পল ম্যাককার্টনি বিটলসকে বিদায় জানানোর সময় যেসব আইনি জটিলতাকে পিছনে ফেলে এসেছিলেন, তাতে আবার জড়াতে চাননি। তাই তিনিও না করে দেন। তবে রিংগো স্টার এসেছিলেন। কিছু ঘটনা অন্যরকম হলে হয়তো বিশ্ব আবারো দেখতে পেত দ্য বিটলসের পুনরুত্থান।
৬#
বব ডিলান ১৯৬৬ সালের এক মোটরবাইক দূর্ঘটনার পর জনসমক্ষে খুব কম দেখা দিতেন। ১৯৬৯ সালে ছিল তার শেষ কনসার্ট। হ্যারিসনের অনুরোধ গ্রহণ করলেও নিজেকে নিয়ে সংশয়ে ছিলেন ডিলান। কিন্তু ৫০ বছর আগের এই দিনে দর্শকদের অবাক করে দিয়ে সেই মঞ্চে তিনি গেয়ে চলেছিলেন- ‘ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড’, ‘মি. টাম্বুরিন ম্যান’, ‘জাস্ট লাইক আ উইম্যান’।
৭#
বিশ্বখ্যাত রক গিটারিস্ট এরিক ক্ল্যাপটন বিষণ্ণতা ও মাদকাসক্তির কারণে বহুদিন ছিলেন অন্তরালে। কিন্তু তাকে মঞ্চে তুলে দিয়ে পুরোনো ক্ল্যাপটনকে ফিরিয়ে আনতে নাছোড়বান্দা ছিলেন হ্যারিসন। দুই বছরের মধ্যে এটাই ছিল তাঁর শেষ পারফরম্যান্স। তারপর আসক্তি কাটানোর লড়াইয়ে নামেন তিনি।
৮#
কনসার্ট থেকে প্রায় আড়াই লাখ ডলার তুলে ইউনেস্কোকে দিয়েছিলেন আয়োজকরা। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত এই কনসার্ট থেকে প্রাপ্ত ১২ মিলিয়ন ডলার রিলিফ হিসেবে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। এখনও ডিভিডি ও সিডি বিক্রি থেকে অর্জিত টাকা ইউনিসেফের জর্জ হ্যারিসন তহবিলে যাচ্ছে।
৯#
রবি শঙ্কর বলেছিলেন জর্জ হ্যারিসনকে, আর তারা দু’জনে মিলে জানিয়েছিলেন পুরো বিশ্বকে। সঙ্গীত বিষয়ক সাংবাদিক গ্রায়েম টমসন বলেন, ‘কাছাকাছি বছরগুলোতে এই শিল্পীদের কাউকেই কনসার্টে খুব একটা দেখা যায়নি। সুতরাং তাদের একখানে জড়ো হওয়াটাই ছিল একটা ঘটনা।’ তারা সকলে মিলে যেন বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের স্থানটা পাকাপোক্ত করে দিয়েছিলেন।
চ্যারিটি কনসার্টের যে ধারা শুরু হয়েছিল, তার সূচনা করেছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। আশির দশকে এসে এই ধারা চূড়ায় পৌঁছে। ১৯৮৫ সালের লাইভ এইড কনসার্টকে বলা যায় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’–এরই সন্তান।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, ডেইলি স্টার
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন