টাকমাথায় চুল গজানোর উপায় কি কারও জানা আছে?

৬৯৯৫ পঠিত ... ১৩:৫১, আগস্ট ২৫, ২০১৬


বিন্তির জন্য দাঁড়িয়ে আছি বটগাছের নিচে। বটগাছের নিচে একটা লাল গাড়ি। গাছের ডালে বসে ফলখেকো পাখিরা টুপটাপ বর্ষণ করছে। লাল গাড়ির ছাদ চিত্রময় হয়ে উঠেছে। আকাশে তাকাব নাকি? আমার মাথার ওপরে কোনো পাখি বসে নেই তো! যেই না তাকিয়েছি, অমনি! পাখিদের টার্গেট এত নির্ভুল হয়।

অলংকরণ : জুনায়েদ

মাথা থেকে ফলের গুঁড়ো মোছার জন্য টিসু পেপার খুঁজছি।

বিন্তি এসে পড়েছে। রিকশার ভাড়া দিচ্ছে। এই মুখ এখন কোথায় লুকাব।

নীল রঙের শাড়িতে তাকে দেখাচ্ছে অপরূপ। রিকশা থেকে নামতে গিয়ে তার শাড়ি গোড়ালির ওপরে উঠে গেল। আমার বুকটা হু হু করে উঠল।

বিন্তির সঙ্গে আমার পরিচয় ফেসবুকে। এখনো দুজনে দুজনকে ভালোমতো চিনি না। আমার মাথা ভর্তি টাক, একেবারে পাকা তালের মতো। আমার বয়স ৩২, কিন্তু আমাকে দেখতে লাগে ৫২।

ফেসবুকে সুন্দর সুন্দর স্ট্যাটাস দিতাম আমি। নিজের কোনো কাব্যপ্রতিভা আমার নেই। আমার বন্ধু সুমন পাটোয়ারীর স্ট্যাটাস কপি করে পেস্ট করে দিতাম। বিন্তি সেই কাব্যময় স্ট্যাটাস পড়ে আমার প্রতি আগ্রহ বোধ করতে লাগল।

প্রথম দিন আমাকে দেখে সে খুবই হতাশ হয়েছিল। বলেছিল, ‘তুমি কি মিনহাজ, নাকি মিনহাজের আব্বা।’

আমি বলেছিলাম, ‘আমার বয়স মোটে ৩২।’

সে দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, ‘বিশ্বাস করি না।’

আমি বলেছিলাম, ‘দেখো, খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির হলে থেকে থেকে আমার এ অবস্থা। ওদের পানিতে খুব লবণ। চুল সব উঠে যায়।’

আজকে আমি আমার ম্যাট্রিকের সার্টিফিকেটের সত্যায়িত ফটোকপি এনেছি। বিন্তিকে দেখাব। এরপর যদি সে বিশ্বাস করে যে আমার বয়স মোটেও বেশি নয়।

বিন্তি বলল, ‘এ কী অবস্থা তোমার! সারা মাথায় এসব কিসের গুঁড়ো? টাকমাথায় বটফলের গুঁড়ো, হি হি হি... কাক টাক পছন্দ করে না।’

আমি বললাম, ‘টিস্যু পেপার আছে না তোমার ব্যাগে?’

সে টিস্যু পেপার বের করল। এমন সময় একটা সাত-আট বছরের টোকাই কোত্থেকে এসে আমার হাত ধরে বসল, ‘আব্বা, আসো, আম্মা ডাকে।’

আমি হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললাম, ‘এই, হাত ছাড়! কে তোর আব্বা?’

‘আব্বা, এইটা তোমার কেমন স্বভাব? সামনে কোনো মহিলা থাকলেই তুমি কও কে তোর আব্বা। চলো, আম্মা তোমারে ডাকে।’ টোকাইটা আমার হাত ধরে ঝুলে পড়ল।

মহা মুশকিল।

বিন্তি বলল, ‘যাও। তোমার ওয়াইফ তোমাকে ডাকছেন। দাঁড়িয়ে আছ কেন?’

আমি অসহায় ভঙ্গিতে বললাম, ‘এই পিচ্চি, ছাড় ছাড়।’

ছেলেটি একটা নীল রঙের টি-শার্ট আর ধূসর রঙের হাফপ্যান্ট পরা, পায়ে বড় বড় দুটো স্পঞ্জের স্যান্ডেল, চোখ দুটো ভাসা ভাসা, চিত্কার করে উঠল, ‘আম্মা, আব্বা আসে না।’

এমন সময় পাশের হলুদ ছাপরা ঘরটার জানালা খুলে গেল। জানালায় একজন ৩০-৩২ বয়সের মহিলা তারস্বরে বলে উঠল, ‘টুটুলের আব্বা। কী ঘটনা তোমার, আসো না কেন?’

বিন্তি বলল, ‘যাও। ভাবির কাছে যাও।’

বিন্তি যে রিকশায় এসেছে, সেই রিকশাতেই চলে গেল।

এই সময় বাড়ি থেকে একজন প্রবীণ মহিলা বেরিয়ে এলেন। টুটুলের হাত আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রবীণা বললেন, ‘যাও টুটুল, ঘরে যাও।’

টুটুল বলল, ‘১০০ টাকা না দিলে ছাড়ব না।’

আমি ১০০ টাকা বের করলাম মানিব্যাগ থেকে। প্রবীণা বললেন, ‘দেবেন না, দেবেন না। আপনারা দেন বলেই ও রোজ এই রকম করে।’

১০০ টাকার নোটটা ছোঁ মেরে নিয়ে টুটুল খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, ‘ঠকাইছি। আরও একটা আবুলরে বোকা বানাইছি।’

প্রবীণা বললেন, ‘দেখলেন? আজ আপনাকে ঠকাল, কাল আরেকজনকে ঠকাবে।’

আমি বললাম, ‘টুটুল না হয় ঠকিয়ে মজা পায়। কিন্তু ওই মহিলা, যিনি জানালা দিয়ে ডাকলেন, তাঁর ঘটনা কী?’

প্রবীণা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। টুটুলের মায়ের মাথাটা ঠিক নেই। অ্যাকসিডেন্টে টুটুলের বাবা মারা গেছে, এটা টুটুলের মা কোনো দিনও মানতে পারল না। যাকে দেখে, তাকেই সে টুটুলের বাবা ভেবে বসে থাকে।

প্রবীণা বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

বিন্তি আমাকে ফেসবুকে ব্লক করে দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো উপায় আমি আর পাচ্ছি না। সুমন পাটোয়ারী ঠিক তখনই একটা স্ট্যাটাস দিল,

‘বুকের ভেতর সূক্ষ্ম/

একা থাকার দুঃখ।’

আমি সেটা কপি করে নিজের স্ট্যাটাস বানালাম, ২৫টা লাইক পেলাম। কিন্তু বিন্তিকে আর কোনো দিনও পেলাম না।

তার বদলে পেলাম সিন্থিয়াকে। ও আমার স্ট্যাটাস পড়ে পড়ে মুগ্ধ হয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। এর মধ্যে আমি পরচুলা কিনে সেটা পরা শুরু করে দিয়েছি।

সিন্থিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম পরচুলা পরে। আমাকে আর আব্বা আব্বা লাগছে না। আশুলিয়ার ফ্যান্টাসি কিংডমে গেছি।

সিন্থিয়া রোলার কোস্টারে চড়বে। অভয় দিয়ে বীরের বেশে আমি তার পাশে বসলাম। এই সময় কালবৈশাখীর বাতাস উঠল। আমরা চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। ভাগ্য ভালো, বাতাস কমে গেল।

সিন্থিয়া খুব ভয় পাচ্ছে। পার্কের প্রবীণ কর্মচারী বললেন, ‘ভয় পাচ্ছেন কেন। আচ্ছা আপা, আপনার আব্বার হাত শক্ত করে ধরে থাকেন। আংকেল আপনি মেয়ের হাত ধরেন।’

আমি সিন্থিয়ার হাত এক হাতে ধরলাম। আমার বুকটা ধড়াক করে উঠল। লোকটা আমাকে আংকেল বলছে কেন? আমি আরেকটা হাত মাথায় দিলাম। সেকি! আমার পরচুলা কই? আমার হৃদপিন্ড মুহূর্তে উড়ে গেল বুকের খাঁচা ছেড়ে। কালবৈশাখীর প্রবল বাতাস আমার পরচুলা উড়িয়ে নিয়ে গেছে! আর আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে।

রোলার কোস্টার চলতে শুরু করল। সিন্থিয়া, বয়স ১৭, ভীষণ ভয় পেয়েছে। সে আমার হাত খামচে ধরে চিত্কার করছে, ‘আব্বা, আব্বা, আমাকে নামান, আমি নামব।’ কী আর করা, আমি মেয়ে হলে, অল্প বয়সে বিয়ে হলে, এই বয়সী একটা মেয়ে আমার থাকতেও পারত! আমি বললাম, ‘কেঁদো না মা, এই তো এসে পড়েছি।’

সিন্থিয়াকে হারিয়ে আমি একটা স্ট্যাটাস দিলাম ফেসবুকে। এই প্রথম আমি নিজে বানিয়ে একটা স্ট্যাটাস লিখলাম, ‘টাকমাথায় চুল গজানোর উপায় কি কারও জানা আছে?’

অনেক ‘লাইক’ পড়ল। আশ্চর্য তো, আমি মরি সমস্যায়, আর লোকে সেটা লাইক করে?

৬৯৯৫ পঠিত ... ১৩:৫১, আগস্ট ২৫, ২০১৬

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top