বাঙালি প্রতিভার রেগে যাওয়া

১১১ পঠিত ... ১৬:২০, মে ০৭, ২০২৪

31 (7)

তিরিশের কল্লোল যুগ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকে জন্ম নেয়া মানুষেরা যে সময় ও সমাজ সৃষ্টি করেছিলেন; সেটাকে আমি বাঙালি সংস্কৃতির সোনালী সময় হিসেবে চিহ্নিত করেছি। এই হাইপোথিসিসের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের সোনালি সময়ের নির্মাতা প্রতিভাবান বাঙালি উল্লেখযোগ্য প্রায় সবার সঙ্গেই দেখা করে কথা বলে; ধারাবাহিকভাবে ইন্টারভিউ করে; এই অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি।

আর আমরা যারা প্রায় বাংলাদেশের বয়সের সমান বয়েসী; সেখান থেকে বাঙালি সংস্কৃতির  নবপ্রস্তর যুগের প্রস্তুতির শুরু। সোনালী সময়ের মানুষ যতদিন বেঁচে ছিলেন, সক্রিয় ছিলেন; ততদিন পর্যন্ত; আমাদের বিনির্মিত প্রস্তর যুগের কালচারের পাশাপাশি সোনালী যুগের কালচারের ভারসাম্য বজায় থাকায়; বিংশ শতক পর্যন্ত বাঙালি সমাজ ছিলো আলোকপ্রভা।

একবিংশ শতক ধীরে ধীরে বাঙালি সমাজকে প্রস্তরীভূত করেছে। আবার আমরা ফিরে গেছি শিকারের যুগে; ক্যানিবালিজমের যুগে। মিডিয়ার শিরোনাম পড়লে; সোশ্যাল মিডিয়ার বিদ্বেষের বাজার; মন্তব্য শাখায় ছাগল ও হনুমানের নৃত্য কিংবা ষাঁড়ের শিং ঘষার চিত্র দেখে আপনারা নিওস্টোন এইজের চিহ্নগুলো অনায়াসে খুঁজে পাবেন।

সোনালী যুগের প্রতিভাবান বাঙ্গালির মধ্যে যে লোকেরা একটু ক্ষ্যাপাটে বলে পরিচিত ছিলেন; সেটা শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নবারুণ ভট্টাচার্য, ছফা আহমেদ, হুমায়ূন আজাদ হলেও; ব্যক্তিগত পর্যায়ে মিশতে গিয়ে শিশুর মতো সরল; স্নেহময়, স্নিগ্ধ মানুষ হিসেবে খুঁজে পাওয়া গেছে তাদের মাঝে।

প্রস্তর যুগে একটু প্রতিভাবান হলে; মানুষ একটু আগ্রহ দেখালেই লোকটা একটু খ্যাতি পেলেই; তারপর রেগে উঠতে শুরু করে, গম্ভীর হয়ে উঠতে শুরু করে। তারপর ভক্ত সেলফি নিতে এলে ধাক্কা দিয়ে দেয়।

অথচ অবাঙ্গালি প্রতিভাবান শচীন টেন্ডুলকার স্মিত হাস্যে; সরলতায় কোমল মানুষ হিসেবে বিরাজ করেন। সোনালী যুগকে দীর্ঘায়িত করেন তারা ঐতিহ্যের অস্থি ধারণ করে। আমাদের সোনালী যুগে জন্ম নেয়া ক্রিকেটার রকিবুল হক, আকরাম খান, গাজি আশরাফ লিপু ঠিক এরকম বিনয়ী ও কার্টিয়াস মানুষ।

বিশ্বখ্যাত অলরাউন্ডার হবার পর থেকে সস্ত্রীক ক্রিকেটার সাকিব; যেরকম রাগ, গাম্ভীর্য, ভক্তকে ধাক্কা দেয়া, ক্যাপ দিয়ে বাড়ি দেয়া; মানে পাটগাঁতি বাজারের যতরকম কর্কশ কালচার আছে; তার সবটাই প্রায় ডেমোনেস্ট্রেট করেছেন অন ক্যামেরা।

কলকাতার খ্যাতিমান কবি সুবোধ সরকার বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাঙ্গালিকে শিষ্টাচার শেখাতে।

কাব্য চর্চা হচ্ছে সত্য সুন্দর ও মঙ্গলের চর্চা। কেরালার কবি, লক্ষ্ণৌর কবি, কলকাতার কবি কিংবা ঢাকার সোনালী যুগের কবি; আচার আচরণে তারা যেন নৌকাডুবিতে হারিয়ে যাওয়া জমজ ভাই। শামসুর রাহমান কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জাভেদ  আখতার কিংবা গুলজার অথবা সুবোধ সরকার কিংবা আমাদের হেলাল হাফিজ; একই রকম স্নিগ্ধ হাসিতে বরণ করেন তাদের কবিতার ভক্তকে।

প্রতিভা তো তাই; যা মানুষকে বিনয়ী করে। আপনি অনায়াসে চিত্রনায়িকা স্বস্তিকা মুখার্জি  কিংবা বিদ্যাবালানের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। কিন্তু আমাদের প্রস্তরযুগে কোন শীর্ষ অভিনেত্রীর সঙ্গে দেখা হলে মনে হবে আপনি পিঁপড়া; হাতির মুখোমুখি হয়েছেন। উনারা প্লাস্টিক কার্টিয়াস আচরণ করলেও আপনি আড়ষ্ঠ বোধ করবেন।

আমাদের প্রস্তর যুগের প্রতিভাবানেরা যেন এলিফ্যান্ট ম্যান এন্ড উইমেন। একটা ফিল্ম একটু নাম করলেই কল্পনায় ক্রিস্টোফার নোলান হয়ে; ফেসবুকে ভি আইপি হয়ে বিরাজ করেন প্রস্তর যুগের মেকাররা। অথচ আপনি সোনালী যুগের চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল বা মোরশেদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে যান, সুন্দর করে আলোচনা করবেন তারা।

সোনালী যুগের বাঙালি বঙ্গবন্ধুর পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় অসংখ্য অনুরাগী ছড়িয়ে আছে; কারণ তিনি নিরহংকার আন্তরিক একজন মানুষ ছিলেন। ভিন্নমতের মানুষকে জেলখানায় দুপুরের খাবার পৌঁছে দিতেন নিজ হাতে।

আপনি প্রস্তর যুগের মুজিবাদর্শের সৈনিকদের সঙ্গে একটু ভিন্নমত পোষণ করুন; সাইবার নিরাপত্তা আইনে হারুনের ভাতের হোটেলে আমন্ত্রণ নিশ্চিত। আর ধমক দিয়ে বলবেন উনি, আপনি তো কিছুই জানেন না।

সিএসপি হাসনাত আবদুল হাই তরুণদের লেখা খুঁজে পড়ে ফেসবুকে অকুন্ঠ প্রশংসা করে লেখেন। প্রস্তর যুগের বিসিএস অফিসারকে প্রথমেই আপনার স্যার ডাকতে হবে; তারপর অন্যকথা।

 বিংশ শতকের সোনালী সময় অতিক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ সমাজ একবিংশের প্রস্তর সময়ে প্রবেশ করলে, রাজনীতির হাওয়াবদলে দুলু-ভুলুদের  অভ্যুদয়ে কর্কশ আবহ সৃষ্টি হলেই সমাজের নিমজ্জন শুরু হয়।  সোনালী সময়ের বাতিগুলো একে একে নিভে যাবার ক্ষণে রাজনীতির ‘খেলা হবে’ নামের হাডুডু ও জব্বারের বলী খেলা-সমাজের আগমন বার্তা ঘোষিত হয়। বাংলাদেশ রাজনীতি হয়ে পড়ে জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’-এর প্রতিবিম্বিত প্রতিরুপ যেন।

অনেকেই এসব প্রস্তর যুগের রাজনীতির রুক্ষ্মতাকে রসের ছলে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেন।

আসলে নেপোলিয়ান,স্ট্যালিন, হিটলার, ইয়াহিয়া, কিম জং উন, পুতিন কিংবা মোদিকে ডিফেন্ড করা যায় না; তা যতই প্রতিভা থাকুক তাদের।

একটাই জীবন আমাদের; সেখানে পাথর মানবের ঔদ্ধত্য দেখে সময় নষ্ট করে লাভ নেই।

বাংলাদেশ গানের দেশ-কবিতার দেশ। সোনালী যুগের শচীন দেব বর্মন, আলাউদ্দিন খাঁ, আলাউদ্দিন আলীর সুরভেজা এই জনপদের প্রস্তর যুগে আজ শুধুই মোহরের মোহে অসুরের আনাগোণা। কোক স্টুডিও সংগীত প্রতিযোগিতায় দক্ষিণ এশিয়ায় ম্লান হয়ে গেছে আমাদের অহংকারী প্রতিভাবানেরা। ক্রিকেটের মাঠেও যেমন তারা জিম্বাবুয়ের সঙ্গে লিভ টুগেদার করে টিকে আছে কোন মতে।

প্রতিভাবান মানে গম্ভীর থাকতে হবে, সফল মানেই রাগারাগি করতে হবে; সেলিব্রেটি মানেই ভক্তের ইনবক্স বার্তা সিন করা যাবে না; যে আমার কোন কাজে আসবে না; তার ফোন ধরা যাবে না; শক্ত ও টান টান হয়ে থাকতে হবে; সারাক্ষণ আমি আমি আমি করে বুবুর ডামি হয়ে বর্তে যেতে হবে; এসব দিব্যি কে দিয়েছে এই প্রস্তর প্রতিভাবানদের!

আপনি পৃথিবী ও নিসর্গের দিকে যেরকম মনোভঙ্গি দেখান; পৃথিবী ও নিসর্গ আপনাকে ঠিক তাই ফিরিয়ে দেয়। নিউটনের তৃতীয় সূত্র, প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে; এটা মুখস্থ রাখা কর্তব্য আমাদের। বিনয়ী ও শিষ্টাচারসম্পন্ন না হলে; কোন প্রতিভাই তার সোনালী গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না।

১১১ পঠিত ... ১৬:২০, মে ০৭, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top