সুন্দরবনে অগ্নিকুণ্ডলা

৮১ পঠিত ... ১৭:৩২, মে ০৬, ২০২৪

23

ঝড়ের কবলে পড়িয়া নবকুমার আটকাইয়া পড়ে এক জনমানুষ্যি শূন্য দ্বীপে। চারিপাশে ঘন অরণ্য। পাখির কিচির মিচির, হনুমানের লম্ফঝম্ফ; দূরাগত ব্যাঘ্রের গর্জন। দিকহারা হইয়া নবকুমার ভাবিতে থাকে কোনদিকে যাইতে পাইলে পথের দিশা পাওয়া যাইবে। দিকবিভ্রমে হতচকিত হইয়া যেইদিকে চিমনি হইতে নির্গত কালো ধোয়া আকাশ অধিকার করিতেছে সেইদিকে যাত্রা শুরু করে।

হঠাতই এক বিড়ালাক্ষী পুষ্প সালংকারা নারী আসিয়া পথ আগলাইয়া দাঁড়ায়; বিস্ফারিত নেত্রে জিজ্ঞাসিল,

--পথিক তুমি কী পথ হারাইয়াছ!

নবকুমারের হৃদয় শিহরিত হয়, এতক্ষণ ভাবিতেছিলাম আমি পথ হারাইয়াছি; এখন মালুম হইতেছে আমি গন্তব্যে আসিয়া পড়িয়াছি।

কপালকুণ্ডলা তাহাকে হাত ধরিয়া সুন্দরী বৃক্ষের তলায় এক গোলপাতার ছাউনিতে লইয়া যায়। অঞ্জলি ভরিয়া মধু পান করিতে দেয়। স্বর্গের আনন্দ আসিয়া নবকুমারের হৃদয়তন্ত্রীতে নবতম ঝংকার তুলিতে থাকে। কপালকুণ্ডলার মায়াস্পর্শে সে নিদ্রার কোলে ঢলিয়া পড়ে।

কপালকুণ্ডলা নবকুমারের কপোল স্পর্শ করিয়া লাজুক হাসিতে চটুল হয়। বনফুল সংগ্রহে বাহির হয়। পাখিরা গান গায়, দূরের সমুদ্র গর্জনে আজ উল্লাসের সুর; চারিপাশে কেওড়া পাতারা হাওয়ায় দুলিয়া যেন কপালকুণ্ডলার আনন্দযজ্ঞে মাতোয়ারা হয়।

নবকুমার নিদ্রা হইতে জাগিয়া চারিপাশে ছড়ানো পুষ্পশয্যা দেখিয়া জিজ্ঞাসিল, আমি কী স্বপ্ন দেখিতেছি কপালকুণ্ডলা!

--আকাশে জ্যোছনার আলো; চলো চন্দ্রের আলোয় ডিঙ্গি নৌকায় করিয়া ঘুরিয়া দেখাই সবুজ রাজ্য।

নবকুমার ঈষত হাসিয়া কহে, মধু যখন পান করিয়াছি; চন্দ্র তো দেখিতেই হইবে। চলো তাহার আগে বনবিবির মন্দিরে প্রেমের অর্ঘ্য দান করিতে যাই।

কপালকুণ্ডলা সলজ্জে নবকুমারের হস্তে একটি পুষ্পমাল্য অর্পণ করে। তার নিজের হাতেও একটি পুষ্পমাল্য।

মন্দিরে পৌঁছাইলে পুজারী কহেন,

প্রেম স্বর্গ হইতে আসিয়া মন্দিরের দ্বারে উপস্থিত; চন্দ্র পূর্ণতার তিথিতে জানান দিতেছে, আজ মধুচন্দ্রিমার নিশি। হে প্রেমময় মানব মানবী, তোমরা এখন পুষ্পমাল্য বদল করো; গ্রহণ করো পরস্পরকে; সারাটি জীবনের জন্যি।

সুন্দরবনের এক হনুমান বৃক্ষের আড়ালে দাঁড়াইয়া কপালকুণ্ডলার বিবাহ দেখিয়া ঈর্ষাকাতর হয়। কপালকুণ্ডলাকে সে ভালোবাসে; কিন্তু তাহাতে ভ্রুক্ষেপ নাই অহংকারী নারীর। সপ্তগ্রাম হইতে আগত নবকুমারের কী আছে; যা হনুমানের নাই!

হনুমান প্রতিজ্ঞা করে, ঐ রাবণরুপী নবকুমারকে আমি লেজের আগ্নিতে পুড়াইয়া মারিব!

হনুমান আসিয়া পথ আগলাইয়া ধরে। আর্তনাদ করিয়া কহে, কপালকুণ্ডলা তুমি পথ হারাইয়াছো! নবকুমার বিবাহিত; সে তাহার স্ত্রী পদ্মাবতীকে ত্যাগ করিয়া তোমাকে গ্রহণ করিয়াছে। যে পদ্মাবতীকে ত্যাগ করিতে পারে; সে দেখিও একদিন তোমারেও ত্যাগ করিবে! আমি অভিশাপ দিতেছি কপালকুণ্ডলার সংসার অগ্নিকুণ্ডলা হইবে। তাহাতে সুন্দরবন থাকিল কী উজাড় হইলো; তাহাতে আমার কিছু আসে যায় না আর!

নবকুমার হনুমানকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কোথা হইতে আনিলে এইসব খবর!

হনুমান উত্তর দেয় ঐ যে আকাশে চিমনির ধোয়া দেখিতেছ! ঐখানে রামপাল। সেইখানে কয়লা পুড়াইয়া আলোক উতপাদিত হয়। পদ্মাবতী ঐ আলোকনগরীর আধিকারিণী। সে আমাদিগকে স্বপ্ন দেখাইয়াছে, এই সুন্দরবন আর গাঁ হইয়া থাকিবে না; ইহা নগর হইবে; এইখানে প্রগতি আসিবে! পদ্মাবতীর পথের কাঁটা ঐ কাপালিকেরা; যাহারা সুন্দরবনের প্রগতির শত্রু। পদ্মাবতীই আমাদিগকে নিয়োগ করিয়াছে কাপালিকের কন্যা আর তাহার লম্পট স্বামী নবকুমারকে শায়েস্তা করিতে।

কপালকুণ্ডলা গর্জন করে, মুখ সামলাইয়া কথা কহো শংকর।

হনুমান ক্রুর হাসি হাসিয়া কহে, তোমরা কাপালিকেরা সুন্দরবনের প্রগতির শত্রু। কয়লা আলোকের প্রগতির বিরোধিতা করিয়াছো শুরু হইতেই। এখন তো ঠিকই নবকুমারকে বিবাহ করিয়া নগরে যাইতেছ! তাহা হইলে সুন্দরবনে আমাদিগের রামনগর প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়াছো কেন এতদিন ধরিয়া। স্বার্থপর নারী কাঁহাকা!

নবকুমার কপালকুণ্ডলার হাত ধরিয়া কহে, চলো মৃন্ময়ী, আমরা নৌপথে যাত্রা শুরু করি। হনুমান শংকরকে ঈর্ষার আগুনে পুড়িতে দাও।

নৌকায় উঠিবার সময় খালের পানিতে আলকাতরা পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া বিস্মিত হয় নবকুমার!

কপালকুণ্ডলা কহে, পদ্মাবতীর আলোক কারখানার কয়লা, আলকাতরা লইয়া যন্ত্রজলযান এই পথে যায়। ইহাতে বৃক্ষ মরিতেছে, পক্ষী দেশান্তরী হইতেছে, দেখো ঐখানে এক হরিণীর মৃতদেহ।

-ইহা অমঙ্গল চিহ্ন; বনভূমি উজাড় হইতেছে; যে বনভূমি বুক দিয়া ঠেকাইয়া রাখে সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস।

হনুমান কাপালিকদের খবর দেয়, তোমাদিগের কপালকুণ্ডলা নবকুমারকে বিবাহ করিয়া সপ্তগ্রামের পানে যাত্রা শুরু করিয়াছে। কাপালিক সমাজের মুখে চুনকালি দিয়াছে ঐ রাক্ষসী নারী। আমি যাই পদ্মাবতীকে খবর দিই; তাহার লম্পট স্বামী কপালকুণ্ডলার সহিত মধুচন্দ্রিমা করিতেছে।

কপালকুণ্ডলা বৈঠা বাইতে বাইতে প্রশ্ন করিয়া বসে, আমি বননারী, আমি কী তোমাদিগের নগরের সহিত মিলাইয়া চলিতে পারিবো! ঐখানে চাক ভাঙ্গা মধু, বনপুষ্প কী পাওয়া যায়; পাখির কলকাকলী, হরিণীর মায়াচাহনী; আছে কী নগরে!

--তোমার কোন অসুবিধা হইবে না মৃণ্ময়ী। শুধু কাঁচুলির পরিবর্তে সেলাই করা বস্ত্র পরিধান করিতে হইবে!

কপালকুণ্ডলা ভারাক্রান্ত মনের বিষাদ লইয়া পিছনের দিকে তাকাইয়া থাকে কতকক্ষণ। তাহার আশৈশব ভালোবাসার সুন্দরবনের দিকে তাকাইয়া নীরবে অশ্রুপাত করে। অগ্র হইতে একটি যন্ত্রজলযানে করিয়া পদ্মাবতী আসিয়া দাঁড়ায়। ভ্রু নাচাইয়া ঠাট্টা করিয়া কহে, নব কুমারকে নব পরিণয়ে পুলকিত মনে হইতেছে। পরিতাপের বিষয়, একবারও ভাবিলেনা এই পদ্মাবতীর কথা! তুমিই বা কেমনতর নারী হে কপালকুণ্ডলা; জানা নাই শোনা নাই প্রেমে গদ গদ হইয়া তাহাকে বরণ করিলে!

নবকুমার উত্তর দেয়, উচ্চাভিলাষী নগরের নটি তুমি হৃদয়হীনা; আমি তো জানিই তুমি এইখানে নগর বিস্তারের কাজ লইয়াছো! দূর হও আমাদিগের দৃষ্টিসীমা হইতে।

পদ্মাবতী তাহার প্রতিশোধঘন কন্ঠে হাহা করিয়া হাসিয়া উঠে,

--রামনগর প্রতিষ্ঠা হইলে আমি আগ্রা চলিয়া যাইবো হে নবকুমার; সপ্তগ্রামের প্রেমপুরুষ!

পদ্মাবতী বাঁকা চোখের ইশারা করিয়া কহে, জয় শংকর।

অমনি হনুমান তাহার লেজের আগুনে সুন্দরবনে অগ্নিকুণ্ডলি প্রস্তুত করে। দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতে থাকে বনভূমি; কয়েক ক্রোশ ধরিয়া অগ্নির লেলিহান শিখা ছড়াইয়া পড়ে! পশুপাখিরা প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করে। অগ্নিহত ব্যাঘ্র মৃত্যু কান্নার শব্দ তুলে।

পদ্মাবতী যন্ত্রজলযানে ফিরিয়া যাইবার পথে; পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকদিগকে সুন্দরবনের আগুন নিভাইতে যাইতে দেখিয়া কহে; কয়েক প্রহর পরে আসিও; দেবালয় পুড়িয়া নগরের জন্যি ভূমি উদ্ধার করিতে দাও। আজ যেরকম অগ্নিকুণ্ডলীতে সুন্দরবন আলো হইয়া উঠিয়াছে; একদিন দেখিবে রামপালের কয়লা দাহে প্রস্তুত বিদ্যুৎ- আলোকসজ্জায় ঠিক তেমনি আলো হইবে রামনগরী। জয় শ্রীরাম!

(বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর উপন্যাস কপালকুণ্ডলা অনুসরণে কাল্পনিক রম্যগল্প)

৮১ পঠিত ... ১৭:৩২, মে ০৬, ২০২৪

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top