বৈষম্যের বিষাদ সিন্ধুতে ‘রহস্য পুরুষ’

২৫২ পঠিত ... ১৬:০৮, জুন ১০, ২০২৩

Rohosso-purush

ইতিহাস চর্চায় আমি মহিউদ্দিন আহমেদ, আফসান চৌধুরী, উইলিয়াম ড্যালরিম্পল আর শাশী থারুরের ছাত্র। এই চারজন ইতিহাসবিদ বর্তমানের প্রেক্ষিতে ইতিহাসের মূল্যায়ন করেন না; ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে ভ্যান্টেজ পয়েন্ট থেকে সত্যান্বেষণ করেন। ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক পর্যবেক্ষণ করার কারণে এই চারজন ইতিহাসবিদ আনপ্লেস্যান্ট ট্রুথ টেলার হিসেবে দলীয় লোকেদের মুখে নিন্দিত। কিন্তু জনসমাজে নন্দিত তারা নির্ভীকভাবে ইতিহাস চর্চা চালিয়ে যাবার ঋজুতায়।

এই প্রাক-কথাটি রাজনীতিক সিরাজুল আলম খানের প্রয়াণে ফেসবুকে গণ-আদালত ভিত্তিক ইতিহাস আলোচনায় অংশ নেবার ঠিক আগের পদক্ষেপ। মানে আমি বেশ কিছু আনপ্লেস্যান্ট ট্রুথ বলতে যাচ্ছি। ঝুঁকি নিচ্ছি প্রিয় বন্ধুদের অপ্রিয় হবার।

সিরাজুল আলম খানের বোন বা ভাইয়ের নাতনি জাতীয় বেতার ভবনে আমার সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করেছিলো, আপনি বিষণ্ণতার শহরের লেখক; দাদাভাইয়ের সঙ্গে একবার দেখা করবেন না; তা কী হয়।

আমি উনাকে ভয় পেতাম; সবাই তাঁকে রহস্য পুরুষ বলে। রাজনীতিতে উনি নিষিদ্ধ ফল খেয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের এক রকমের বেহেশতের বাগান থেকে বিদায় ঘটেছে তাঁর। একজন বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে উনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে চাকরি হারাই কীনা!

কিন্তু ঐ মেয়েটি সম্ভবত রেডিও-র শিক্ষা কার্যক্রমের শোতে আসতো। সিনিয়র সহকর্মী শামীম আপার সামনে বসতো। শামীম আপার পাশে টেবিলে বসে; ওর সঙ্গে চোখাচোখিকে ভয় পেতাম। কক্ষ ত্যাগ করতাম ছদ্ম ব্যস্ততার অভিনয়ে।

একবার শেরাটনে গেলাম এক সাঁঝে খুশিজলের দাওয়াতে। বিষণ্ণতার শহর সিরিজে মুগ্ধ এক অগ্রজপ্রতিম ডেকেছেন। দূরের টেবিলে রহস্য পুরুষের দেখা পেলাম। অনেক সংকোচ নিয়ে দেখা করলাম। ভয় ভাঙ্গালেন তিনি নিজেই। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের মতো শিশুতোষ হাসি দিয়ে বললেন, সিভিল সার্ভিসের সদস্য হয়ে পাবলিকলি কথা বলতে এসেছো; আবার বলছো লেখালেখি করো; বলো কী প্রশ্ন তোমার!

আমি বললাম, আপনাদের প্রজন্মের লোকেরা অত্যন্ত নায়কোচিত; রহস্যপ্রিয়; জন লেনন কিংবা চে গুয়েভারার মতো!

এবার উনি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো অবিকল শিশুতোষ হাসি হাসলেন। উনার আলাপের মেথডটা হচ্ছে সক্রেটিক মেথড। উনি আমার মাঝ থেকে আমার চিন্তাকেই বের করে আনবেন; নিজে বলবেন কম। হাসবেন বেশী।

প্রিয় নেতা মুজিব যখন যুদ্ধাহত দেশ পুনর্গঠনে প্রাণপাত করছেন! তখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালো কেন তাঁরই শিষ্যরা! আম্মা বলেছেন, উনি রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে ট্রেনে করে ক্লাস করতে যাবার সময় স্থানে স্থানে রেল-লাইন উপড়ানোর ভোগান্তিতে পড়তেন!

 

উত্তর না দিয়ে আর্নেস্ট হেমিং ওয়ের দ্য সান অলসো রাইজেসের যুদ্ধ ফেরত নায়ক জেক বার্ন্স-এর নির্ঘুম রাত আর যন্ত্রণার গল্পটা তুললেন। একটু বললেন, জানতেন বাকিটা আমিই বলবো!

ঈশ্বরদীর দুলাল নানাকে চেনেন কীনা জিজ্ঞেস করলাম। উনি আমার আম্মার মামা। আওয়ামী লীগ পরিবারের বিদ্রোহী দুলাল; সেই কালে জিনস আর টি-শার্ট পরতেন।

এবার সম্পর্ক আরো সহজ হয়ে এলো। ‘দাদা ভাই’ সম্বোধনটা সহজতা পেলো।

: বৃটিশ-পাকিস্তান উপনিবেশের পুনরাবৃত্তি তোমার দুলাল নানা চাননি। ওরা তো বৃটিশ আমল থেকে ধনী। তাহলে বলো, ওর অসন্তোষ কেন স্বাধীন দেশে! কারণ, বৃটিশ পাকিস্তানী বুর্জোয়া তাড়িয়ে দেশি বুর্জোয়া চাননি তিনি। চাননি রাতারাতি হিন্দু ও অবাঙ্গালির বাড়ি দখল করে মুক্তিযোদ্ধা বুর্জোয়ার আত্মপ্রকাশ।

দুলাল নানা আমি ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়েই এক ঠোঙ্গা বাদামের বিনিময়ে সাম্যবাদ বোঝাতেন। উনার বড় ভাই আতা নানা সেটা দেখে হাসতেন। ‘দেখিস দুলাল, নাতিকে বিপ্লবী বানাস না!’ আতা নানার ছেলে সবুজ মামা তখন ছাত্র ইউনিয়ন করেন। একই বাড়িতে এক একটা কক্ষে কোথাও মুজিব, কোথাও কার্ল মার্কস, কোথাও বিটলস-এর পোস্টার।

উনি বললেন, ‘পৃথিবীর সব বিপ্লবের পরেই প্রতিবিপ্লব হয়েছে। তোমার দুলাল নানা মুক্তিযুদ্ধের বিপ্লবেও ছিলো, এরপর নতুন দেশের মুক্তিযোদ্ধা বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবপ্লবীও ছিলো।‘ দুলাল নানা অল্প বয়সে ঝরে গেছেন, আর্নেস্ট হেমিং ওয়ের বেদনায়। উনার বিধবা স্ত্রী তখন জাতীয় বেতার ভবনে একটা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। ঈশ্বরদীর সেই আনন্দঘন পরিবারের বিধবা বউ অশ্রু লুকিয়ে কাজ করেন; ছেলেটিকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করেছেন। বিপ্লবীর ছেলে প্রতিষ্ঠানের শেকলে সমাজের কথিত সফলতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের তথ্য মন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ঈশ্বরদীর ঐ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে চেনেন; আর দুলাল নানী শিক্ষিতা-স্মার্ট-যোগ্য বলে তাকে স্টাফ আর্টিস্টের চাকরিটা দিয়েছেন। এভাবেই মুক্তিযোদ্ধা সাইয়িদ মুক্তিযোদ্ধা দুলালের স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

রহস্য পুরুষ হেসে বললেন, ‘তোমার দুলাল নানী আর তার সন্তানের খোঁজ খবর আমিও রাখি পাভেল। আত্মার আত্মীয়দের যোগাযোগ থাকে; যোগাযোগ হয়ে যায়। এই যেমন এইখানে দুলালের নাতির সঙ্গে আমার দেখা হলো।‘

সিভিল সার্ভিস রুলে কেবল গল্প-কবিতা লেখার অনুমতি; তাই উনার চরিত্রের ছায়ার লিখলাম বিষণ্ণতার সিরিজে, দ্য সান অলসো রাইজেস।

ফেসবুক ট্রায়ালের লার্নেড আইনজীবীরা বলছেন, রহস্যপুরুষ শারারাত বা দুষ্টুমি করেছে। তার শখের দাবা খেলায় বিভ্রান্ত তরুণদের প্রাণহানি ঘটেছে। কলকাতার নকশাল বাড়ি আন্দোলন নিয়ে একই অভিযোগ করেন কংগ্রেস ও অধুনা বিজেপির সমর্থকেরা। কত মানসিক কষ্টে জমিদারের ছেলে আজিজুল হক; তার জমিদার বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দুই দশক জেলে কাটালেন; তার এক মাত্র কন্যা অনাথের মতো বেড়ে উঠলো; তার স্ত্রী বিধবা না হয়েও বিধবার জীবন কাটালেন।

আসলে সহমত ভাই বা রহমত ভাই; সচিবালয়ে তদবির করে; কিংবা উন্নয়ন প্রকল্পের কমিশনে যারা নতুন বড়লোক হয়; তারা লুণ্ঠনের স্ট্যাটাসকো চায়। তাই তাদের চোখে সিরাজুল আলম খান, দুলাল, আজিজুল হকেরা পথভ্রষ্ট-রজনীশ-রাসপুটিন-বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট; আমাদের দেশের দলীয় লোকের কন্সপিরেসি থিওরি বা ষড়যন্ত্র তত্বের আলেয়ায় অথবা কল্পনায় এজেন্ট যেন নানা বাড়ির গাছের পেয়ারা।

আসলে চর্বি জমলে ভটভটি আপা ও কুমড়ো পটাশ আপা টিভির বাতাবি লেবুর সুবাসে সবজান্তা শমশের সেজে জাতিকে ইতিহাস, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়ন জ্ঞান দেন। ফইন্নির ঘরের ফইন্নি; যে এই দেশে কোটাল পুত্র হয়ে কুঁড়ে ঘর থেকে রাজপ্রাসাদ ও সেকেন্ড হোম বাগিয়েছে; চাটার দল চার্টার্ড বিমানে করে হিল্লী-দিল্লী ঘোরে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ হয়ে।

সিরাজুল আলম খান, দুলাল, আজিজুল হক দেখেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গুঁড়িয়ে যাওয়া পশ্চিম জার্মানি একটি সুষম শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করে; সম্পদের বন্টন সুষম করে; সাম্যবাদের আদলে সামাজিক গণতন্ত্রের অভিযোজিত বা এডাপটেড পথে কল্যাণ রাষ্ট্র গড়েছে ১৯৭১ সালের আগেই। গতকালের কল্যাণরাষ্ট্রের ইউটোপিয়া বা কষ্টকল্পনাই আজকের বাস্তবতা ইউরোপের দেশে দেশে।

আর স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে বৈষম্যের বিষাদ সিন্ধুতে; অসাম্যভিত্তিক শিক্ষা-ব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়া অমল কিশোর মধ্যপ্রাচ্যে দাস হয়; অমল কিশোরী সেলাই দাস হয়ে রানাপ্লাজায় তার মৃতদেহের পায়ে নুপুর কিন্তু শেকল পরা বাংলাদেশের প্রতিবিম্বিত প্রতিরুপ হয়। আর পরিবারতন্ত্রের বৃক্ষ বিনাশী বাহুবলী ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বিচার বিভাগ; ভিন্নমতের সুশীলকে বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়; রাজ-দর্জির মেয়ে বিদেশ থেকে জমিদারি চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে বাবার নগর সাম্রাজ্যে গদিনশীন নওশীন হয়। আহারে কিম জং উন; আহারে কিম জং উনের হিট অফিসার রাজকুমারী; আমাকে এক দল, এক দেশ, এক নেতা, এক বিশ্বাস, হাসি-কান্নার ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের একরকমের বেহেশতের বাগানে পিয়ং ইয়ং-এ একটি সেকেন্ড হোম কিনে দাও।

২৫২ পঠিত ... ১৬:০৮, জুন ১০, ২০২৩

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top