ঢাকার হারিয়ে যাওয়া গ্রিকদের কথা

৬৬৪ পঠিত ... ১৬:৫২, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২২

Dhakar-Greek

মৌর্য সাম্রাজ্যের সমকালীন সময়ে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার এসেছিলেন ভারত জয় করতে। তবে গঙ্গা তীরবর্তী পরাক্রমশালী রাজ্য গঙ্গারিডই'কে মোকাবেলা করার ভয়ে আলেকজান্ডার তার এই অভিযান থেকে পিছু হটেন। সেই আলেকজান্ডারের পর হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও এই অঞ্চলে গ্রিকদের আগমন ঘটেনি। ভারতবর্ষে ইউরোপীয়রা যখন দলে দলে প্রবেশ করছিল তার সর্বশেষ সংযোজন ছিল গ্রিকরা। যারা বাংলাতে পাট ও লবণের ব্যবসায় কাজে নিয়োজিত ছিল।

ঢাকায় গ্রিকদের আগমন ঘটেছিল স্রেফ ব্যবসা করতে। ইউরোপীয়দের মধ্যে গ্রিকরাই সবশেষে ঢাকায় আসে। ঠিক কবে তারা ঢাকায় এসেছিল তা বলা যায় না। তুরস্ক-রাশিয়া যুদ্ধের সময় বুলগেরিয়ার দুই শহর আদ্রিয়ানোপোলিস ও ফিলিপোপোলিসের পতন হলে গ্রিকদের একটা অংশ বাংলা অঞ্চলে আসে। এছাড়া ইজিয়ান সাগরের দ্বীপগুলোর গ্রিক অধিবাসীদের কেউ কেউ ইংরেজ জাহাজে করে বাংলা অঞ্চলে আসতে থাকেন। ১৭৭০ সালে ‘আলেকজান্ডার’ জাহাজে ইংরেজদের দোভাষী হিসেবে কাজ নিয়েছিলেন আরিগিরি নামের এক গ্রিক। সমুদ্রে প্রবল ঝড়ে পড়ে তিনি মানত করেছিলেন কলকাতা পৌঁছে তিনি একটা গির্জা নির্মাণ করবেন। তার হাত ধরেই কলকাতায় প্রথম অর্থোডক্স গির্জা স্থাপিত হয়। কলকাতায় গ্রিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা আরিগিরি ১৭৭৭ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার পুত্ররা ঢাকা ও বরিশালে বাস করতেন। তাদের বেশকিছু সহায় সম্পত্তি ছিল এখানে। টেইলরের মতে, ১৮৪০ সালে ঢাকায় ১২ টি গ্রিক পরিবার ছিল। ১৮২১ সালে গ্রিকরা ঢাকার কোন এক জায়গায় একটি গির্জা স্থাপন করেছিল। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এই গির্জাটি ধ্বংস হয় বলে ধারণা করা হয়।

কর্ণেল ডেভিনসনের ভ্রমণ কাহিনী থেকে জানা যায়, রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) গ্রিকদের একটি কবরস্থান ছিল। সমাধিগুলো অলংকৃত বা দেখতে সুশ্রী ছিল না। কবরগুলো ছিল নোংরা ও গরু বাছুরে পরিপূর্ণ। পরবর্তীতে এই কবরস্থানগুলোর অবস্থানও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৮৪০ সালে ডেভিনসন ঢাকার একটি গ্রিক গির্জার বিবরণ দেন। ডেভিনসনের কেরানি জানিয়েছিলেন যে, শহরে এখন গ্রিকদের সংখ্যা কম কারণ তারা খুব বেশিদিন বাঁচে না। সেসময় ভারতীয় নারী ও গ্রিকদের মধ্যে বিয়ের প্রচলন ছিল। গ্রিকরা যেখানে থাকত সেই এলাকার পরিবেশ খুব একটা সুখকর ছিল না। বদ্ধ গলির মাঝে আশেপাশে নর্দমা পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছিল।

ঐতিহাসিক দানীর মতে, ১৯৫৬ সালের দিকে ঢাকায় দুইজন গ্রিক ব্যবসায়ী ছিলেন। র‍্যালি ব্রাদার্স নামে পরিচিত এই ভ্রাতৃদ্বয় পাট ব্যবসা ছিল নারায়ণগঞ্জ ও কলকাতা জুড়ে। দেশভাগের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে অন্যান্য ভিনদেশী বণিকের মত গ্রিকরাও এই দেশ থেকে হারিয়ে যায়। ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ সরকার গ্রিকদের জমিতে একটি হাসপাতাল বানানোর পরিকল্পনা করে। হাসপাতালটি আজকের মিটফোর্ড হাসপাতাল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে আজো গ্রিক স্মৃতিসৌধ এদেশে গ্রিকদের উপস্থিতির সাক্ষ্য দিচ্ছে। উনিশ শতকের ত্রিশের দশকে এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়। নারায়ণগঞ্জে বসবাসকারী ডিমিট্রিয়াস নামের এক গ্রিক পরিবারের স্মৃতিতে নির্মিত হয়েছিল এ সমাধিসৌধ। নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত এই সমাধি পাদপ্রদীপের আলোয় আসেনি।  নব্বই দশকে ঢাকায় আসেন বিশ্বব্যাংকের গ্রিক প্রতিনিধি হেলেন আবাদজী। তিনি নিজে এই সমাধির পেছনের ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করেন। সৌধের ভেতরের ফলকগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করেন হেলেন। প্রথম ফলকে লেখা আছে, ‘যার স্মৃতিতে উৎসর্গ হল এই ফলক, তার নাম সুলতানা আলেকজান্ডার।‘ চতুর্থ ফলকটি নিকোলাস দিমিত্রিয়াস এলিয়াস নামের এক গ্রিক পুরুষের। চারদিকে লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো সমাধির প্রবেশপথ রয়েছে পূর্বদিকে। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি তখন রমনার দিকে আরেকটি গ্রিক স্মৃতিসৌধ প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। স্থানীয় লোকজন সৌধের পাথর চুরি করে নিয়ে যেত। এ নিয়ে কলকাতায় খবর প্রচার হলে সেন্ট থমাস গির্জার যাজক ম্যাকডোনাল্ডের উদ্যোগে নির্মিত হয় নতুনএই সমাধিসৌধ যেটি আজকের টিএসসিতে অবস্থিত। টিএসসি প্রাঙ্গন ছিল প্রকৃতপক্ষে গ্রিক সমাধিস্থল যা পরে ঘাস দিয়ে আধুনিকায়ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ করা হয়। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে সংস্কার করা হয় গ্রিকদের এ শেষ স্মৃতিচিহ্ন।

 

তথ্যসূত্র

  • https://elinepa.org/three-centuries-of-hellenic-presence-in-bengal/
  • ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী-মুনতাসির মামুন
  • নানা রঙের ঢাকা-কাজল ঘোষ
৬৬৪ পঠিত ... ১৬:৫২, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top