নোবেল প্রাইজ পাওয়া কিংবা না পাওয়া নিয়ে উঠেছে যত রকম বিতর্ক

১০৩৬ পঠিত ... ২০:২৮, অক্টোবর ১৫, ২০১৯

প্রতি বছর অক্টোবরে নোবেল প্রাইজ কমিটি পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, সাহিত্য, চিকিৎসাশাস্ত্র, অর্থনীতি ও শান্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করে। অবশ্য নোবেলপ্রাপ্তদের নিয়ে বিতর্কও কম নেই। কখনো কেউ নোবেল পাওয়ায় বিতর্ক হয়, কখনো বিতর্ক হয় নোবেল না পাওয়ায়। চলুন, তেমনি বিতর্কিত কিছু নোবেল পুরস্কার ও পুরস্কারজয়ীদের খবর জেনে নেয়া যাক। 

 

১# বারাক ওবামার শান্তিতে নোবেল প্রাপ্তি

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান ২০০৯ সালে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মাত্র নয় মাসের মাথায়। অথচ অন্য আমেরিকান প্রেসিডেন্টদের চেয়ে ওবামার যুদ্ধনীতি কোনো দিক দিয়েই ভিন্ন কিছু ছিলো না। কারও কারও মতে, নোবেল কমিটি ওবামাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দিয়েছিল সিমপ্লি ‘জর্জ ডব্লিউ বুশ না হওয়ার জন্যে।’ এমনকি অনেক ওবামা সমর্থকও মনে করেছেন ওবামাকে শান্তিতে নোবেল দেয়াটা ভুল ছিলো।

২০১৫ সালে, নোবেল ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক গির লুন্ডস্টাড, নিজেই আফসোস করে তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘নোবেল কমিটি ভেবেছিলো পুরস্কার প্রেসিডেন্টকে শক্তিশালী করবে এবং শান্তিতে ভূমিকা রাখায় উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু তেমন কিছু হয় নি।‘  

 

২# শান্তিতে পুরস্কার পেয়েছেন যুদ্ধবাজ কিসিঞ্জার!

আমেরিকার সহায়তা ও চেষ্টায় উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে গৃহযুদ্ধ হয়, যা ভিয়েতনামের যুদ্ধ নামে পরিচিত। যুদ্ধে আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষ নেয়। উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট সরকারের অধীনে একিভুত হয় দুই ভিয়েতনাম। শান্তি ফিরিয়ে আনতে, যুদ্ধের ভয়াবহ অবস্থাতে প্রশমিত করতে ভিয়েতনামের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব লে দৌ থো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। নোবেল কমিটি ১৯৭৩ সালে একই সঙ্গে দুজনকে শান্তি পুরস্কারের জন্যে নির্বাচিত করে। লে দৌ থো পুরস্কার নিতে রাজি হন নি। এ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়। বেশিরভাগ সমালোচকের দাবি, কিসিঞ্জারকে শান্তি পুরস্কার দেয়া নিষ্ঠুর রসিকতা ছাড়া কিছু নয়। কারণ কিসিঞ্জার শান্তিবাদী তো নয়ই, পুরোদস্তুর একজন যুদ্ধবাজ লোক। তার সঙ্গে লে দৌ থো একই সাথে পুরস্কৃত হওয়াটা অনুচিত।

 

৩# বিশ্বসাহিত্যের রথি-মহারথীদের নোবেল পুরস্কার দিতে ব্যর্থ হওয়া

পুরস্কার প্রবর্তনের প্রথম বছর সাহিত্যপ্রেমিদের ধারণা ছিলো প্রথম সাহিত্যে নোবেল পাবেন লিও টলস্টয়। তার সঙ্গে তুলনীয় লেখকও তেমন ছিল না তখন।

কিন্তু সুইডিশ একাডেমি সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাহিত্যে কবি সুলি প্রুধমকে। সমালোচকদের মতে প্রুধম একজন মাঝারি মানের কবি। এমনকি তার পরের বছরগুলিতেও টলস্টয়কে সাহিত্যে নোবেল দেয়া হয়নি।

বিষয়টিকে এখন পর্যন্ত নোবেল কমিটির ব্যর্থতা বলে মনে করেন অধিকাংশ সাহিত্যপ্রেমী। শুধু তাই নয়, শুরুর বছর থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত শান্তিতে নোবেল পান ৫ জন। পরে দুটি সংগঠনের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। আরো জানা যায় যে, নোবেল কমিটির অধিকাংশ সদস্য ওই দুটি সংগঠনের সমর্থক ছিলেন। এই খবর প্রকাশের পর প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়।

শুধু টলস্টয় না, নোবেল প্রাইজ কমিটি জেমস জয়েস, আন্তন চেখভ, মার্সেল প্রুস্ত, হেনরিক ইবসেন, মার্ক টোয়াইন, জর্জ অরওয়েল, কিংবা আর্থার মিলারের মতো রথী মহারথীদেরকে নোবেল পুরস্কার দিতে ব্যর্থ হয় নোবেল প্রাইজ কমিটি। অথচ ২০১৬ তে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় গায়ক-গীতিকার বব ডিলানকে। ডিলানের নোবেল প্রাপ্তি আরেক পশলা বিতর্কের সৃষ্টি করে।

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে  ২০১৮ সালের যৌন-কেলেঙ্কারির পর। বিতর্কের তীব্রতা এমন পর্যায়ে পৌছায় যে নোবেল কমিটি ২০১৮ সালে সাহিত্য পুরস্কার দেয়া স্থগিত রাখে। এ বছর একসাথে দুই বছরের জন্যে দুইজনকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়।

 

৪# অর্থনীতিতে মিল্টন ফ্রিডম্যানের নোবেল প্রাপ্তি

মিল্টন ফ্রিডম্যানের অর্থনীতিতে নোবেল প্রাপ্তি সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ১৯৭৬ সালে তিনি যখন নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন, শত শত লোক স্টকহোমের বিক্ষোভ করে, প্রতিবাদ জানায়।

নোবেল কমিটির ঘোষিত নিয়মমতে, নোবেল পুরস্কার কোনো মৃত ব্যক্তিকে দেয়া যাবে না। অথচ ২০১১ সালে ব্যত্যয় ঘটে এই নিয়মের। র‍্যালফ স্টাইনম্যান ওই বছর নোবেল পুরস্কার পান চিকিৎসা বিজ্ঞানে। নোবেল কমিটি পুরস্কার ঘোষণার সময় জানতেনও না যে, ঘোষণার ঠিক তিনদিন আগে স্টাইনম্যান মারা গেছেন। কমিটির এমন হাস্যকর অদক্ষতা অনেক সমালোচনা কুড়িয়েছে।

 

৫# রাসায়নিক মারনাস্ত্র উদ্ভাবককে নোবেল দেয়া

ফ্রিটস হেবারকে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় হেবার-বশ প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের জন্যে, যে প্রক্রিয়ায় লার্জ স্কেইল এমোনিয়া উৎপাদন করা হয়। সার উতপাদনে তথা কৃষিক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে।

কিন্তু হেবার একই সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্লোরিন গ্যাস দিয়ে রাসায়নিক অস্ত্র নির্মানেও ভূমিকা রাখেন। জীবদ্দশায় হেবার এই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের সমর্থনে কথাও বলে গেছেন।   

 

৬# আল গোরের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ

মার্কিন রাজনীতিক আল গোর আলিশান প্রাসাদে গ্যাস ও বিদ্যুতের অতিরিক্ত অপচয়ের কারণে তুমুল সমালোচিত হন। অবাক করা ব্যাপার হলো, এই আল গোরই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ভূমিকা রাখার জন্যে পেলেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। পুরস্কার প্রাপ্তির খবর ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় সমালোচনা। অথচ তিনিই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি সম্পর্কে সচেতনতা বিকাশে ভূমিকা রাখার জন্য ২০০৭ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় সমালোচনা।  

 

৭# মহাত্মা গান্ধীর নোবেল না পাওয়া

নোবেল বিতর্কের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধীর পুরস্কার না পাওয়াটাও তুমুল সমালোচিত এক বিষয়। নোবেল ইন্সটিউটের সাবেক পরিচালক গির লুন্ডস্টাড মনে করেন, নোবেল কমিটির সবচেয়ে বড় ভুলগুলির একটি ছিল মহাত্মা গান্ধীকে পুরস্কৃত না করা। ভারতীয় অহিংস রাজনৈতিক নেতা গান্ধীর পুরস্কার না পাওয়ার ব্যাপারে লুন্ডস্টাড জানান, গান্ধীকে পাঁচ বার সংক্ষিপ্ত তালিকায় মনোনীত করা হয়েছিলো, ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় দুইবার, পপরে ১৯৪৬, ৪৭ এবং ১৯৪৮ এ  একবার করে। কিন্তু কমিটির ইউরোপ-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে পুরস্কৃত করা হয়নি। লুন্ডস্টাড লেখেন, ‘গান্ধীর নোবেল প্রাইজ না পেলে কিছু আসত-যেত না, কিন্তু নোবেল কমিটির গান্ধীকে পুরস্কৃত করতে ব্যর্থ হওয়ায় আসে-যায় কিনা সেটাই প্রশ্ন।‘

 

নোবেল বিতর্কের ইতিহাসে একটা আইরনিক ব্যাপার চোখে পড়ে। সবচেয়ে বেশি বিতর্ক বা অশান্তি হয়েছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া না পাওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে। অবশ্য এই আইরনির শুরু নোবেল পুরস্কারের সূচনাকাল থেকেই। পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেলের দুশ্চিন্তা ছিলো তাকে মানুষ মনে রাখবে ডাইনামাইটের আবিষ্কারক হিসেবে। বিশ্বশান্তিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদেরকে স্বীকৃতি দেয়ার সবর্বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের প্রবর্তক জীবদ্দশায় পরিচিত ছিলেন ‘মার্চেন্ট অফ ডেথ’ বা মৃত্যুর সওদাগর হিসেবে।   

১০৩৬ পঠিত ... ২০:২৮, অক্টোবর ১৫, ২০১৯

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top