সৈয়দ মুজতবা আলীর আড্ডাবাজির যেসব গল্প আপনি নাও জানতে পারেন

৪২৮৩ পঠিত ... ১৮:৩৮, জানুয়ারি ২৪, ২০১৯

কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের এক দিকপাল। তার বাবা আরেক বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ফলে শৈশব থেকেই বাংলার জ্ঞানী-গুণী, শিল্পমনা মানুষদের সহচার্য পেয়েছেন। শুধু সঙ্গীত সাধনাই করেননি। চারপাশের অসাধারণ সব মানুষকে নিবিড়ভাবে দেখেছেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে তার সব অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ‘মজলিস’, ‘কুদরত রঙ্গি-বিরঙ্গি’র মতো চমৎকার বই লিখেছেন। সঙ্গীত ও সঙ্গীতের বাইরের মানুষদের সাথের স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন ‘ম্যহ্‌ফিল’। ‘ম্যহ্‌ফিল’ বইতে আরও অনেকের সাথে এসেছে সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রসঙ্গ। ভ্রমণকাহিনী আর রম্যরচনা যিনি এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন সেই ব্যক্তির আড্ডাবাজ রূপটি তুলে ধরেছেন লেখক। কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘ম্যহ্‌ফিল’ বই থেকে সৈয়দ মুজতবা আলী সম্পর্কিত স্মৃতিচারণ থাকছে eআরকির পাঠকদের জন্য।

 

মুজতবা আলির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ কফি হাউসে প্রাক্‌- পথের পাঁচালির যুগে। সম্ভবত শাঁটুলবাবুই ওঁকে পেড়েছিলেন। এসেই উনি আমাদের হৃদয় জয় করবার উদ্দেশ্যে একটি নোংরা গল্প ফেঁদে বসলেন। আর পাঁচটা কথাবার্তার মধ্যে আমি গুষ্টিসুখ কথাটা ব্যবহার করায় উনি প্রশ্ন করলেন ‘এ কথাটা কোথায় পেলি? (ততক্ষণে আমি আপনি থেকে তুইয়েতে নেমে গেছি) মনে হচ্ছে মুজতবা আলির বই পড়েছিস।’ আমি ঘাড় নাড়তে উনি বাকি সবাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘তোমরাও পড়েছ দেশে বিদেশে? তাই পাবলিশার আমায় বলছিল আমার বই ছ কপি বিক্রি হয়েছে।’ আঙুল দিয়ে আমাদের গুণলেন এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়। সত্যজিৎ রায়ের পিতৃপুরুষের পরিচয় শাঁটুলবাবু (রাধাপ্রসাদ গুপ্ত) দিতে আলি সাহেব বললেন ‘তুমি তো মস্ত বড় বাপের ছেলে। ওই শতরঞ্চি মলাটের হযবরল আর তোমার বাপের ছবি আঁকা ‘আবোল তাবোলে’র প্রচ্ছদ বদলালে কেন ভাই? শুনেছি সিগনেট প্রেসের সব বইয়ের মলাটের ছবি টবি তুমিই আঁকো।’

আমাকে বললেন ‘তোর বাবা (ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) তো ভরত মুনি শার্ঙ্গদেবের পরই সংগীতজগতের বিখ্যাত অথরিটি গুরুদেব পর্যন্ত মানতেন, তা ওই নভেল তিনটে লিখতে গেল কেন? বাপ্‌রে! ঘেমে নেয়ে বিষম খেয়ে ঘটি ঘটি জলটল খেয়ে শেষ করেছিলাম কোনোক্রমে। তুই লিখিস?’

বললাম ‘না’।

‘তবু ভাল। যদি লিখিস তো আনাতোল ফ্রাঁসের কথা মনে রাখবি “ইফ ইউ ওয়ান্ট টু রিচ পস্টারিটি, ট্র্যাভেল লাইট”। তোর ইনটেলেকচুয়াল বাপের মত অত মাথা খাটাস্‌নি।’

আলি সাহেবের আদেশ শিরোধার্য করে পঁয়ষট্টি বছর বয়স পর্যন্ত বই-টই না লিখেই কাটিয়েছিলাম। তার পর কী যে মতিচ্ছন্ন হল…

পার্ক সার্কাসে ওঁর বাড়ি মাঝে মাঝে যেতাম জ্ঞান পিপাসা চরিতার্থ করতে। শক্ত শক্ত বিষয় এত সহজ আর মনোগ্রাহী করতে আর বড় একটা কাউকে দেখিনি। কখনও শোনাচ্ছেন বিভিন্ন ধর্মের মূলতত্ত্ব, কখনও বা হুমায়ুনের কবরের মকবরা কীভাবে শাহ্‌জাহানের তাজমহলের আর্কিটেক্‌টকে প্রেরণা দিয়েছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। Recounter ও বৈঠকবাজ হিসেবে সৈয়দ মুজতবা আলিকে আমি ধূর্জটিপ্রসাদের কিঞ্চিৎ উপরে রাখব, চিন্তাধারার গভীরতার বা নতুন নতুন আইডিয়া স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পেশ করার ব্যাপারে ধূর্জটিপ্রসাদকে ও সত্যেন বোস মশায়কে মুজতবা আলির উর্ধ্বে রাখতে হবে। তবে স্মরণশক্তি আলি সাহেবের সাংঘাতিক ছিল, বাবার মুখেই শুনেছি বোম্বাইয়ের চার্চিল চেম্বার্‌সে শচীন চৌধুরীর আড্ডায় উনি পরশুরামের ‘ভূশণ্ডির মাঠে’ গল্পটি পুরো মুখস্থ শুনিয়েছিলেন। অধ্যাপক ত্রিপুরারি চক্রবর্তী অবশ্য ঘোড়দৌড়ের ভাষায় আলি সাহেবকে হ্যাকে মারতেন। কেউ কেউ বলে মহাভারতের নিরানব্বুই হাজার শ্লোক ওঁর মুখস্থ ছিল। সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না তবে একবার বক্তৃতা করতে করতে বার্ট্রান্ড রাসেলের Power থেকে একটি প্যারাগ্রাফ কোট করতে চেয়েছিলেন, সেটি উদ্ধৃত করার পর থামতে পারলেন না, স্মরণশক্তির এমনই প্রেসার যে পরের গোটা চারেক পাতাও গড়গড় করে মুখস্থ বলে গেলেন। থামলেন যখন হঠাৎ খেয়াল হল যে ওগুলি relavant নয়, অপ্রয়োজনীয়।

ফর্সা ছিমছাম মানুষটি, গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি কোঁচানো ধুতি ও হাতে ছড়ি নিয়ে আলি সাহেব আড্ডা দিতে বসতেন। বাড়ির মধ্যে ছড়ির কী প্রয়োজন জিজ্ঞেস করায় বলতেন ‘তোদের মত অর্বাচীন অপোগণ্ডদের ঠ্যাঙানোর জন্য ওটা হাতের কাছে রাখি।’ একদিন সত্যি সত্যিই মার খেতে খেতে বেঁচেছিলাম। সেদিন উনি খুব একটা মৌজে ছিলেন না। কী একটা ব্যাপার আমি তর্কে প্রবৃত্ত হওয়ায় উনি বললেন ‘দ্যাখ্‌ তুই নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবিস, না? ওই তো তোর আসল গণ্ডগোল। আমায় দ্যাখ দিকিনি, বোকা সেজে থাকি, কত অ্যাডভান্টেজ।’ জবাবে আমি বলেছিলাম ‘কি জানেন, চেহারাটাও এসব ব্যাপারে একটু সাহায্য করে।’ ‘হারামজাদা বিটলে বামুনের বাচ্চা,’ বলে ছড়ি দিয়ে আমাকে পেটাতে বাকি রেখেছিলেন। গালাগাল যা দিয়েছিলেন তা ছাপার অযোগ্য। দিন তিনেক পড়ে একটা জনি ওয়াকার নিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন প্রাণখুলে আশীর্বাদ করতে করতে বলেছিলেন ‘শোন্‌ এই ব্যবস্থাই ভাল, আমি সাতটা ভাষায় খিস্তি করতে পারি। তোকে মাঝে মধ্যে গালাগাল করব আর তুই স্কচ্‌ খাওয়াবি। কি বলিস?’

এমনিতেই মুখ আলগা, পেটে কিছু পড়লে আরও লাগাম ঢিলে হয়ে যেত আলি সাহেবের। আর বয়স টয়েসের তোয়াক্কা বড় একটা উনি করতেন না। এই সূত্রে একটা গল্প মনে পড়ে গেল। তখন উনি শান্তিনিকেতনে কিছুকাল অধ্যাপনা করছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় আই. সি. এস থেকে প্রিমেচিউওর রিটায়ারমেন্ট নিয়ে শান্তিনিকেতনে বাড়ি করে লেখাপড়া আর বাগানের তদারক করে দিন কাটাচ্ছেন। বয়স এবং খ্যাতনামা সিনিয়র সাহিত্যিক হিসেবে সকলেরই সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। অন্নদাশঙ্করের আমেরিকান স্ত্রী লীলা রায় আক্ষরিক অর্থে যথার্থ সহধর্মিণী ছিলেন এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন বাঙালি হবার। একটি ইংরেজি শব্দও ব্যবহার করতেন না। একদিন সাইকেল চড়ে মুজতবা আলি অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতে উপস্থিত, বাগানে লীলা রায় নিড়েন নিয়ে ফুলগাছের তলাগুলো খোঁচাতে ব্যস্ত। আলি সাহেবের মিস্টার রায় বাড়ি আছেন কিনা এ প্রশ্নের জবাবে উনি বললেন ‘উনি এখন সৃষ্টির কাজে ব্যাপৃটো আছেন।’

পাল্টা প্রশ্ন আলি সাহেবের ‘তা হলে আ-আপনি এখানে বাইরে কী করছেন মিসেস রায়?’

*কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণমূলক বই ‘ম্যহ্‌ফিল’ থেকে

৪২৮৩ পঠিত ... ১৮:৩৮, জানুয়ারি ২৪, ২০১৯

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top