ছাগলে ভরিয়া গেল দেশ

৪৬৯০ পঠিত ... ১১:৪২, জুলাই ২০, ২০১৭

কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার ছবি আঁকার ক্লাশ 'শিল্প বিতান'-এর শিক্ষার্থী ছিলাম ১৯৭২ সালে। সদ্য স্বাধীন দেশ। সবখানেই একটা অন্যরকম আবহ। বাঙালি মধ্যবিত্ত তখন বিকশিত হচ্ছে ভিন্ন মাত্রায়। শিক্ষিত এবং সংস্কৃতিবান পরিবারগুলোর দেয়ালে পাশাপাশি দুটি শাদাকালো ছবি শোভা পেতো। একটি রবীন্দ্রনাথের অন্যটি নজরুলের। অনেক বাড়ির পাকা দেয়ালে, টিন অথবা বাঁশের বেড়ার দেয়ালে শোভা পেতো সস্তা ফ্রেমে বাঁধানো কাবা-র ছবি কিংবা বাংলা নয়তো আরবিতে লেখা 'আল্লাহু'। তাজমহলের ছবিও ঝুলিয়ে রাখতো কিছু কিছু পরিবার। সেই রকম একটা সময়ে আমি ছবি আঁকা শিখছি কচি-কাঁচার মেলার শিল্প বিতানে। স্বপ্ন একটাই--বিরাট শিল্পী হবো। গ্রাম, বৃক্ষ, ছনের ঘর, শহুরে দালানবাড়ি, নদী, নৌকা, মানুষ, প্রজাপতি, বেড়াল, হাতি কিংবা পাখির ছবি আঁকতাম বিপুল উদ্যমে। বাদ যেতো না রবীন্দ্রনাথ-নজরুলও।

বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত উপজেলা প্রশাসনের আমন্ত্রণপত্র!

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনটি ছিলো ডিআইটিতে। আমি সেখানে ছোটদের অনুষ্ঠানে অংশ নিই। বাহাত্তরের মার্চ মাসে বিটিভিতে একটা অনুষ্ঠান হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে। খুদে আঁকিয়ে হিশেবে আমি তখন মোটামুটি কদর-টদর পাচ্ছি। একদিন আমাকে বলা হলো শেখ মুজিবের একটা ছবি আঁকতে। তিন চারদিন টানা পরিশ্রম করে এঁকে ফেললাম শেখ মুজিবের একটা ছবি। তর্জনী উঁচিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ দিচ্ছেন শেখ মুজিব। সামনে অসংখ্য মাথা কিলবিল করছে।

তখন টিভিতে যেকোনো অনুষ্ঠানই লাইভ টেলিকাস্ট বা সরাসরি সম্প্রচার হতো। এখনকার মতো রেকর্ডিং-এর যথেচ্ছ সুযোগ তখন ছিলো না। একা আমি তো যেতে পারবো না টিভি অফিসে তাই এক সন্ধ্যায় আমাকে সেখানে নিয়ে গেলেন সাগর ভাই মানে ফরিদুর রেজা সাগর। ছোট্ট একটা স্টুডিওতে আমার মতো আরো জনা দশেক ছেলেমেয়েকে বেতের মোড়া ধরণের আলাদা আলাদা আসনে বসানো হয়েছে। প্রত্যেকের সামনে ছোট্ট মাপের ইজেল এবং ইজেলে প্রত্যেকের আঁকা শেখ মুজিবের ছবিটা ক্লিপ দিয়ে সাঁটানো।

নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা সুদর্শন এক ভদ্রলোক উপস্থাপক। কী চমৎকার করেই না কথা বলেন ভদ্রলোক! আমি তো রীতিমতো মুগ্ধ। এতো সুন্দর করে কথা বলা যায়! আমার আঁকা শাদাকালো বঙ্গবন্ধুর ছবিটির খুব প্রশংসা করলেন তিনি। আমি ওটা কীভাবে এঁকেছি জানতে চাইলেন। বললাম, দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হওয়া ছবি দেখে এঁকেছি। আমাদের সামনে আলাদা একটা জায়গায় বড় একটা ইজেলে শাদা একটা ক্যানভাস ফ্রেম করা। ভদ্রলোক আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেই ইজেলের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, তোমার এই ছবিটা আঁকা খুবই সহজ। শুনে আমি মাথা নাড়ি--না, মোটেও সহজ নয়। এটা আঁকতে তিন-চারদিন লেগেছে আমার। কিন্তু ভদ্রলোক তবুও বলেন--বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের এই ছবিটা আঁকা একদম সহজ। বলেই পকেট থেকে কালো একটা চক বের করে ইজেলে রাখা শাদা ক্যানভাসে খুব দ্রুত দশ বারোটা কিংবা পনেরো কুড়িটা আঁক কষলেন। কী আশ্চর্য এক ঝটকায় ওই আঁকিবুঁকির ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলেন আঙুল উঁচিয়ে থাকা শেখ মুজিব! বিস্ময়ে আমাদের তো চোখ একেবারে যাকে বলে--ছানাবড়া। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! লোকটা ম্যাজিক জানে নাকি? মাত্র কয়েকটা টান দিতেই শেখ মুজিব! আর আমি কী না তিন চারদিন ঘষে মুছে...। কে রে ভাই এই লোকটা?

অনুষ্ঠানের পর সাগর ভাই আমার সঙ্গে সেই লোকটার পরিচয় করিয়ে দিলেন--মন্টু ভাই এ হচ্ছে রিটন। কচি-কাঁচার মেলার রিটন। আর রিটন ইনি হচ্ছেন বিখ্যাত মানুষ মুস্তাফা মনোয়ার। আমাদের সকলের প্রিয় মন্টু ভাই। (সেইদিন থেকে মুস্তাফা মনোয়ার আমারও মন্টু ভাই হয়ে গেছেন!)

পরদিন ওয়ারির রাস্তায়, স্কুলে যাবার পথে বনগ্রাম-বিসিসি রোড-ঠাটারিবাজার এলাকায় এবং ক্লাশে গিয়ে টের পেলাম গতকাল সন্ধার পর সেই অনুষ্ঠানটা কেউ কেউ দেখেছে! রাস্তায় লোকজন ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দ্বিতীয়বার দেখছে! রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠলাম যেনো বা।

পঁয়তাল্লিশ বছর আগের ধুসর স্মৃতিটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ফিরে এলো সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কুৎসিত এক ঘটনায়।

মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে পঞ্চম শ্রেনী পড়ুয়া একজন ছোট্ট বন্ধুর আঁকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিসহ একটি আমন্ত্রণ পত্র ছাপিয়েছিলেন বরিশালের বরগুনার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারেক সালমান। টিভি সংবাদে দেখলাম, সেই কার্ড ছাপানোই তাঁর কাল হয়েছে। স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা দিয়েছেন মামলা ঠুকে। (এই বীর পুঙ্গব বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ওবায়েদুল্লাহ সাজু)। অভিযোগ গুরুতর। বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতি। জাতির জনকের ছবি বিকৃতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে আদালতের নির্দেশে কারাগারে প্রায় চালান হয়ে যাচ্ছিলেন সেই তরুণ ইউএনও। শেষমেশ যদিও জামিন মিলেছে তাঁর। আওয়ামী লীগের দুধের মাছি এই ধরনের ধড়িবাজ নেতাগুলো পোপের চেয়ে বড় ক্যাথলিক সাজার চেষ্টা করছে।

খবরে প্রকাশ আমন্ত্রণপত্র হাতে পেয়ে বঙ্গবন্ধুর 'বিকৃত' ছবি দেখে জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ওবায়েদুল্লাহ সাজু মর্মাহত হন এবং তার হৃদকম্পন বেড়ে যায়।

স্বাধীনতার পর টানা একুশ বছর পাঠ্যসূচি থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলা হয়েছিলো।

--তখন তুমি কোথায় ছিলে হে নয়া পোপ?

ইতিহাস বিকৃতি করে বঙ্গবন্ধুর জায়গায় আরেকজনকে প্রতিস্থাপিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছিলো।

--তখন তুমি কোথায় ছিলে হে নয়া পোপ?

কোথাও ছাপা যেতো না বঙ্গবন্ধুর ছবি।

--তখন তুমি কোথায় ছিলে হে নয়া পোপ?

বঙ্গবন্ধুর নামটাও উচ্চারণ করা যেতো না একটা সময়ে।

--তখন তুমি কোথায় ছিলে হে নয়া পোপ?

ভাগ্যিস তোমার মতো আঁতকা বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক ১৯৭২ সালে গজায় নাই। তাহলে তো শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারকেও গ্রেফতার বরণ করতে হতো!

সঙ্গে সঙ্গে আমার মতো খুদে শিল্পীর শিল্পচর্চার স্বপ্ন-আকাঙ্খাও বিলীন হতো নিকষ কালো অন্ধকারে!

ছাগলে ভরিয়া গেলো দেশ...।

৪৬৯০ পঠিত ... ১১:৪২, জুলাই ২০, ২০১৭

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top