বাবার মিটিঙের বাক্সভর্তি খাবার

২৩১ পঠিত ... ১৮:৫৭, জুন ১৮, ২০২৩

বাবার-মিটিঙের

আজ একটি অন্যরকম দিন। সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেলো ৫টা ১০ এ। আবার ঘুমালাম। আধাঘণ্টা পর আবার ঘুম ভেঙে গেলো। বাকি তিন ভাই-বোন ঘুমাচ্ছে। সবার ছোট ভাইটার নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ৬ বছরের বাচ্চা এত প্রকট শব্দে নাক ডাকতে পারে না শুনলে বিশ্বাস হতো না। পা টিপে টিপে বিছানা থেকে উঠলাম যাতে অন্য কারও ঘুম না ভাঙে। অন্যদিন হলে ঠুসঠাস শব্দ করে সবার ঘুম ভাঙাতাম। কিন্তু আজ তা করা যাবে না, কারণ—আজ একটি অন্যরকম দিন।

আব্বা আম্মার রুমে উঁকি দিলাম। বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন তারাও। একবার মন চাইলো আব্বাকে ঘুম থেকে তুলি। এমন গুরুত্বপূর্ণ দিনে আব্বা এখনও নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছেন ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আব্বার কি একটুও টেনশন হচ্ছে না? কে জানে। বাকিদের কী অবস্থা জানি না, আমার টেনশনে ঘুম হচ্ছে না। সারাটা রাত এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়েছি।

আব্বার অফিসে আজ মিটিং আছে। গত একমাস ধরে আজকের জন্য অপেক্ষা করছি। মিটিঙের তারিখগুলো আমার ক্যালেন্ডারে গোল দাগ দিয়ে রাখা আছে। বড় সন্তান হিসেবে আব্বাকে তিন দিনে একবার মিটিং এর ডেট মনে করিয়ে দেওয়া আমার দায়িত্ব।

অবশেষে আব্বা ঘুম থেকে উঠলেন, ফ্রেশ হলেন, অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছেন। আজ পুরো বাসায় ভীষণ ব্যস্ততা। আট বছর বয়সী বোনটা আব্বাকে টাই, ঘড়ি এগিয়ে দিচ্ছে, কে আব্বার জুতা পালিশ করে দিবে এই নিয়ে ঝগড়া লাগলো দ্বিতীয় এবং চতুর্থ জনের মধ্যে। আমার খুব মেজাজ খারাপ লাগছে। করার মতো কোনো কাজ পাচ্ছি না।

ভয়ে ভয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আব্বা গরম পানি করবো? হাত পা ধোয়ার জন্য? '

আব্বা একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। বোকার মতো প্রশ্ন করে লজ্জা পেলাম। আসলেই তো। গরমের দিনে গরম পানি দিয়ে আব্বা কী করবেন? আসলে আব্বার জন্য করার মতো কোনো কাজ পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে বাকি ভাই-বোনগুলো জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যাচ্ছে। খুব রাগ হচ্ছে। খুব!

অবশেষে আব্বা অফিসে গেলেন। আমরা চার ভাই বোন মেরুদণ্ড সোজা করে বসে আছি ড্রয়িং রুমে। টানটান উত্তেজনা সবার ভেতর। মাও আজ একটু পর ঘড়ি দেখছেন। আশ্চর্য, আবার মা কেনো?

দ্বিতীয় এবং তৃতীয় জনের ফিসফিসের শব্দ কানে আসলো। 'পেটিস আমার, বুঝলি? টানাটানি করবি না।‘ তৃতীয় জন অসহায় মুখে তাকালো আমার দিকে। আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম।

আজ মনে হচ্ছে সময় কাটছে না। টিভি ছাড়লাম। অন্যদিন হলে মনোযোগ দিয়ে সবাই সনি৮ এ 'আহট' দেখি। আজ তাও ইচ্ছে করছে না। দ্বিতীয় জন নফল নামাজ পড়ছে। সবার চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। একটু পর পর সবাই ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, ঘড়িও নিশ্চয়ই আজ নিজেকে খুব স্পেশাল ভাবছে। ধ্যেত! 

সাড়ে দশটা, দশটা চুয়াল্লিশ, বারোটা তেরো, একটা, দেড়টা, দুইটা...! দুইটা বেজে গেছে! আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। এতক্ষণে আব্বার মিটিং শেষ হয়ে গেছে নিশ্চিত। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আসবেন। আমরা চারজন দরজায় সিরিয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছি। সবার বড় হওয়ায় একটু এক্সট্রা ফ্যাসিলিটি হিসেবে প্রথমে দাঁড়াতে পেরেছি। দেখা যাক ভাগ্যে কী আছে!

যেসব দিন অফিসে মিটিং থাকে সেসব দিনে আব্বার জন্য এমন রিসিপশনের আয়োজন করা হয়। অবশেষে আব্বা এলেন। তিনি এলেন! এরমধ্যে তৃতীয় জন আব্বাকে একটি গোলাপ ফুল দিলো। আব্বা হাসতে হাসতে ফুলটি নিয়ে ওকে চুমু খেলেন। মুহূর্তেই মেজাজ বিগড়ে গেলো। এতক্ষণ গোলাপ ফুল লুকিয়ে রেখে বদমাশটা মাত্র বের করলো। এতো সুবিধাবাদী ভাই-বোন দেখে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসলো।

আব্বা সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন। আমাদের সবার দৃষ্টি আব্বার হাতের দিকে। একটি নীল-সবুজ প্যাকেটও আব্বার হাঁটার গতিতে দুলছে। ভেতরে কী আছে বুঝার চেষ্টা করলাম। কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি প্যাকেটে বড় বড় দুইটা সমুচা আর আপেল আছে। আপেল আমার একদম পছন্দ না, তাই চিন্তাটা আরেকটু বেশি। আব্বার আমাদের দিকে মুচকি হেসে কারো হাতেই প্যাকেট দিলেন না। একদম ভালো হয়েছে। তৃতীয়জনের একটা শিক্ষা হওয়া উচিৎ।

আব্বা প্যাকেটটা রাখলেন ডাইনিং টেবিলের ওপর। সাথে সাথে হুমড়ি খেয়ে আমরা পড়লাম প্যাকেটের ওপর। যেহেতু আমার বয়স এবং শক্তি বেশি, প্যাকেটের কন্ট্রোল পেতে খুব বেগ পেতে হলো না।

ভয়ে ভয়ে প্যাকেট খুললাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না। প্যাকেট ভর্তি পোলাও! একটা পলিথিনের প্যাকেটে মুরগীর বড় রান, আরেকটা প্যাকেটে শসা। চপের মতো একটা দলাও দেখা যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নিতেই হাত থেকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে প্যাকেটা নিয়ে নিলো দ্বিতীয় জন। চতুর্থ জন ধাক্কা খেয়ে মাটিতে বসে চিৎকার করে কাঁদছে।  

পোলাওগুলো চিকচিক করছে, এখনও হালকা গরমভাব রয়ে গেছে। শসা আর লেবুটা মনে হচ্ছে জিইয়ে গেছে, কিন্তু তাতে কী? মুরগীর রানের দিকে তাকাতেই লোভে আমার চোখ চকচক করে উঠলো। আম্মা ছুরি দিয়ে রানটাকে চার টুকরা করলেন, পোলাও, শসা, ডিমচপকেও চার ভাগ করে আলাদা প্লেটে দিলেন। আমি আশা করেছিলাম বড় হওয়ায় একটু বেশি পাবো। আশাহত হলাম। তারপরও মুখে লেগে রইলো সেই পোলাও-মাংসের স্বাদ! আজ সত্যিই একটি অন্যরকম দিন।

খাওয়া শেষ করে যখন হাত ধুতে যাবো, তখন দেখলাম আব্বা আম্মা খেতে বসছেন। ভাত, করলা ভাজি আর পাঙ্গাসের ঝোল...

 

২৩১ পঠিত ... ১৮:৫৭, জুন ১৮, ২০২৩

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top