কেরোসিনের চুলার স্টোভটা নিভিয়ে দিয়ে কেরামত আলী নিভিয়ে দিয়ে বললেন- ও রতন, চান রাইত তো আইসে গেলো। এবার তো বাড়িত যাতি হয়।
রতন গামলার মধ্যে শেষ খদ্দেরের চায়ের কাপটা ধুতে ধুতে মুখ তুলে তাকায়। 'চান রাইতের' ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার না। তবে কেরামত আলীর বাড়ি যাওয়ার মানে সে বোঝে। আগের বছরে এইরকম বাড়ি গিয়েছিলো কেরামত আলী। সাতদিনের জন্য। এই সাতদিন রতনের কেটেছে দুর্বিষহ!
কালাম মিয়া নামে এক দারোয়ানের কাছে রেখে গিয়েছিলো রতনকে।
কালাম মিয়া দিনে খুব ভালো। রতনকে দেখেশুনে খাওয়ায়-টাওয়ায়। মাঝেসাজে মায়া করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এমনকি একদিন সামনের মুড়িওয়ালার কাছ থেকে মুড়ি এনেও খাইয়েছিলো। কিন্তু রাতের বেলায় মদের বোতল নিয়ে বসলেই কালাম মিয়া অন্য মানুষ। কেমন যেন লাল লাল চোখ হয়ে যায়। রতনকে গালিগালাজ শুরু করে। রতন কিছু বুঝতে পারে না। কেমন যেন ভয় ভয় লাগে।
কালাম মিয়া মাতাল গলায় বলতো- আরে তুই হইলি গিয়া পাগলির পুত। তোর মায়ে রাস্তায় ফ্যা ফ্যা কইরা ঘুরতো, ভিক্ষা কইরা খাইতো। ফকিন্নীর ঘরে জন্মাইয়া তুইও ভিক্ষা করবি; তা না কইরা হোটেলে বাসন মাজোস। যা ফকিন্নীর পুত...
বলেই লাথি কষায় রতনের কোমরে। লাথি খেয়ে রতন কুঁকড়ে যায়। আরেকটু দূরে গিয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে। ভয় লাগলেও ও দৌড়ে পালায় না। স্বাভাবিক বুদ্ধি না থাকলেও রতন প্রবৃত্তি দিয়ে বোঝে যে কালাম মিয়ার অন্তর ভালো। এমনিতে অতো আদর তাকে মালিক কেরামত মিয়াও করে না।
তিনদিন কালাম মিয়ার আস্তানায় রতনের ভালোভাবেই কেটেছিলো। সমস্যা হলো চতুর্থদিন। বোতলের পানি কালাম বোধহয় সেদিন বেশিই খেয়ে ফেলেছিলো। জড়ানো গলায় রতনকে বললো- তোর তো বাপের ঠিক নাই। কোন ব্যাটার কোন আকামে জন্মাইছিলি, পাগলীর পো তুই এমুন আবাল রইছোস ক্যান?
রতন ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকে। কথা কিছু না বুঝলেও সে বোঝে যে কালাম আজকে অন্যদিনের মতো না। চোখের মাঝে যেন অন্যরকম একটা ঘোর। রতনের দিকে সে হেলতেদুলতে এগিয়ে আসে, কালাম মনে মনে তৈরী হয় একটা রাম লাথি খাওয়ার। কিন্তু কালাম একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলো। লাথি মারার বদলে সে সাপটে রতনকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর প্যান্ট ধরে দিলো হ্যাঁচকা একটা টান! এমনতেই তার শত ব্যবহারে জীর্ন একটা প্যান্ট, কালামের টানে তার কাপড় একটু ফড়াৎ করে ছিঁড়ে গেলো। কালাম ঘোর লাগা গলায় বলে- আয় আয়...
রতন ভয়ে সেদিন দৌড়ে পালায়। হোটেলের মালিক কেরামত আলী ফিরে আসে আরও তিনদিন পর, সেই তিনদিন রতন লুকিয়ে লুকিয়ে থেকেছে কালাম মিয়ার কাছ থেকে। ক্ষুধা লাগলে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে কাছিয়ে খাবার মত কিছু পেলে খেয়ে নিতো।
কাজেই কেরামত আলীর আবার বাড়িতে যাবার কথা শুনে রতনের ভয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। কেরামত আলী অবশ্য গতবারের ব্যাপারটা কিছু আঁচ করতে পেরেছে। এমনিতে তার হোটেলেই খায়-দায় রতন, রাতে ঘুমায় হোটেলের ভিতরেই। কেরামত আলী বাইরে তালা লাগিয়ে চলে যায়। কিন্তু ঈদের সময় সাতদিনের বন্ধে তো আর ভিতরে কাউকে আটকে রেখে যাওয়া যায় না। আবার রতনের মতো আধা পাগলের কাছে তো হোটেলের চাবিও দিয়ে দেয়া যায় না।
কাজেই কেরামত আলী এবার রতনের ব্যবস্থা করলো হাজী রশিদের বাড়িতে। তার পাঁচতলা ফ্ল্যাট। নিচের তলার গ্যারেজে কোলাপসিবল গেট আটকানো থাকে। রতন থাকবে সেখানেই।
যাবার আগে কেরামত আলী তার হাতে শ'দুয়েক টাকা গুঁজে দেয়। তারপর বলে- বাড়িত যাচ্ছিরে রতন। সুবিধা থাকলি তোকে ঝিনাইদা'র বাড়িতে নিয়ে যাতাম। এখানিই থাক। হাজী সাব ভালো মানুষ। খিদা লাগলি আবার তিনার বাড়িতে যাসনি। টাকা দিয়ে কিছুমিছু খেয়ে নিস।
রতন টাকা নিয়ে হাজী সাহেবের গ্যারেজে ঘুমাতে যায়। ওপাশে দারোয়ান ঘুমায়, আর রাতে ঝমঝম করে বাজে বেঁধে রাখা একটা বিরাট কুকুর। রতনের ঘুম আসে না ভয়ে।
ভোরের দিকে একটু ঘুম ঘুম আসতে লাগলো। হঠাৎ কী যেন সরে গেলো রতনের হাত থেকে। রতন ধড়মড় করে উঠে বসে। দারোয়ানের দরজাটায় একটা শব্দ হলো। হুড়াহুড়ি করে মানুষ ঘরে ঢুকলে এমন শব্দ হয়। রতন হাতের দিকে তাকায়। কেরামত আলীর দেয়া টাকা হাতের মধ্যে নিয়েই ঘুমিয়েছিলো। টাকাটা নেই! রতন হাতের দিকে তাকিয়েই থাকে...
বেলা বাড়লে রতন দেখে কুকুরকে গোসল করানোর আয়োজন। দারোয়ান শ্যাম্পু ডলে ডলে কুকুরকে গোসল করায়। রতন চুপ করে বসে থাকে। খিধেয় তার পেট চোঁ চোঁ করছে। সে কী বলবে ভেবে পায় না। অবুঝ চোখে সে ডাস্টবিন খুঁজে বেড়ায়, ফ্ল্যাটবাড়িতে যে ডাস্টবিন নেই!
হাজী রশিদ নিচে নেমেছেন তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে। গায়ে ঈদের নতুন পাঞ্জাবী। হাতে জায়নামাজ। বের হবার সময় রতনকে চোখে পড়লো। তাঁকে দেখে রতন কুঁকড়ে বসলো আরও। হাজী রশিদ ডাকলেন- এই... এদিকে আয় তো। জায়নামাজগুলা ধর।
হাজী সাহেব ছেলেদের নিয়ে আগাচ্ছেন। পিছে পিছে জায়নামাজ নিয়ে রতন। মসজিদে ঢোকার আগে হাজী সাহেব চিন্তা করলেন- একেও কি ঢোকাবেন ঈদের জামাতে? পরক্ষণেই ভাবনা নাকচ করে দিলেন। এর তো জামাকাপড়ে ধুলামাটি, গায়ে বোঁটকা গন্ধ। নাপাক ছেলেপুলে নিয়ে আরও গুনাহগার হবার মানে হয় না।
রতনকে বললেন- তুই জুতার কাছে বসে থাক। কেউ যেন জুতা না নেয়...
রতন বসে থাকে জুতার কাছে। হাজার হাজার কত রকমের জুতা! তার জুতা দেখতে ভালো লাগে। পেটে ক্ষুধা নিয়ে তার কাছে জুতাগুলোকেই মনে হয় হরেক রঙের খাবার...
ধীরে ধীরে ঈদের নামাজ শেষ হয়। মানুষজন বাইরে বেরোতে শুরু করেছে। একটা বাচ্চা রতনের পাশ দিয়ে যায়, রতনেরই বয়সী। যেতে যেতে বাচ্চাটা আবার রতনের দিকে ফিরে আসে। হাতে পাঁচটাকার একটা চকচকে নোট।
রতন পাঁচ টাকা হাতে নিয়ে বিমুঢ় বসে থাকে। কেন কেউ টাকা ঘুমের মধ্যে নিয়ে যায়, কেন কেউ টাকা এমনি এমনি দিয়ে দেয়; তার বুদ্ধির অগম্য!
'শালার শালা নতুন মাল দেহি! ভিক্ষা করতে আইছোস? লাইসেন আছে?'
রতন তাকিয়ে দেখে ঘেঁষটাতে ঘেঁষটাতে এক ফকির তার কাছে এগিয়ে এসেছে। তার পা দু'টো নেই। হাতই তার পা! চোখে খুনে দৃষ্টি।
রতন 'লাইসেনের' মানে বোঝে না। ফকিরের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকে। ঠাস করে রতনের গালে চড় বসালো পাড়ার ফকির সিন্ডিকেটের অন্যতম পাণ্ডা লুলা করিম। তারপর পাঁচটাকা রতনের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে শাসায়- আর যদি এই এলাকায় ভিক্ষা করতে দেখছি, টেংরি ভাইঙ্গা দিমু!
যার নিজেরই টেংরি নেই, সে আরেকজনের টেংরি ভাংবে কিভাবে সেটা এক রহস্য। রতনের সে রহস্য চিন্তা করারই ক্ষমতা নেই! চড় খেয়ে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে লুলা করিমের দিকে। কেনই বা সে টাকা পেলো, কেনই বা আরেকজন সে টাকা নিয়ে তাকে চড় কষালো সে কিছুই বুঝতে পারে না!
হাজী সাহেবরা বের হলেন একসময় ঈদগাহ থেকে। রতনও এলো। ক্ষুধা লেগেছে প্রচণ্ড। কাকে বলবে? আসার সময় ডাস্টবিন দেখে যেতে ইচ্ছে করেছিলো, হাজী সাহেবকে ভয় করে যায়নি। পরে একসময় যাবে।
এরইমধ্যে কুকুরের গোসল শেষ হয়েছে। হাজী সাহেবের ছেলে উপর থেকে তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। আদর-যত্ন পেয়ে কুকুরটা দেখতেও হয়েছে বেশ। কেমন আরাম করে চেটে চেটে হাডি খাচ্ছে।
হাজী সাহেবের ছেলে রতনের দিকে তাকালো- আরে, এই ছেলেটাকে ঈদের দিনে কিছু একটা খেতে দে।
দারোয়ান বললো- হের খাওন তো হেয় নিজেই কিন্যা খাইবো কইয়া গেলো কেরামত আলী!
ছেলেটা বললো- তা খাক। ঈদের দিনে এর সামনে কিছু একটা এনে দে বাসার থেকে। দেখিস না কেমন ভুখা মানুষের চোখ?
রতন খেতে বসেছে। তার সামনে পরোটা আর কোরমা। পাশে সেমাইয়ের বাটি। পরোটা ছিঁড়ে কোরমা দিয়ে মাখিয়ে মুখে তুললো।
পাশে কারা যেন কোলাকুলি করছে- ঈদ মোবারক।
রতনের মাথার ভেতর শব্দটা মৌমাছির মত বোঁ বোঁ শব্দে খেলা করতে লাগলো- ঈদ... ঈদ...
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন