হিমু এবং কয়েকটি নীল করোনা : পঞ্চম পর্ব

২০১৫ পঠিত ... ১৪:৫৬, এপ্রিল ১৫, ২০২০

অলংকরণ: তাইসির 

১৩ ই এপ্রিল ২০২০,
বাংলায় আজ ৩০ শে চৈত্র, ১৪২৬।
চৈত্র সংক্রান্তির অলস বিকেল।
কখন ঘুমিয়ে গেছি খেয়াল নেই। সারারাত রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে ভোরবেলা বাসায় এসে পাঞ্জাবি গায়েই ঘুমিয়ে গেছি। ডাইনিং রুম থেকে বিরাট চেঁচামেচির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। গিয়ে দেখি ঘটনা অত্যন্ত সিরিয়াস। মাজেদা খালা এক পাশে কাঁদছেন। বাদল উপুড় হয়ে সোফায় শুয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতেই মাজেদা খালা ফ্রিজ থেকে সদ্য বের করা বরফ ধোঁয়া ওঠা একটা মিল্ক ভিটা দুধের প্যাকেট বাদলের পেছনে (পাছায়) চেপে ধরে আছে। পাশে মাজেদা খালার মেজো ননদের মেয়ে সাব্রিনা দাঁড়িয়ে মুখে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। আমার যতদূর মনে হচ্ছে, মেয়েটা হাসছে। কিন্তু এই হাসি দেখে কাছে গিয়ে ঘটনা জিজ্ঞেস করতে ভরসা হল না। এসব মেয়ের হাসির আড়ালে মহা ঝামেলা থাকে। হেসে হেসে কাছে ডেকে ফণা তুলে দেবে!

বরং জমিলাকে আমার অনেক সেইফ শট মনে হল। কাজের বুয়ারা এইসব ঘটনা বেশ রসিয়ে বলে।
জমিলা আমার ধারণা ভয়াবহভাবে সত্যি প্রমাণ করে দিলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই।
: বাদলের কী হয়েছে জমিলা?
: হিমু ভাইজান! সেনাবাহিনীতে মাইরা বাদল ভাইজানের পু** ফাটাইয়া দিছে! আমার মনে কয়, বাদল ভাইজানের হাগন বন্ধ হইয়া যাবে!

আমি মুগ্ধ হয়ে জমিলার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সেনাবাহিনীর লাঠির বাড়িতে কারো হাগন বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং এ ব্যাপারে কারো চোখমুখে এমন আনন্দের আভা ফুটে উঠতে পারে, জমিলাকে না দেখলে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন হত।

আমি একটু ভয়ে ভয়ে মাজেদা খালার পাশে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম। মাজেদা খালার মুখে পাথরতুল্য নীরবতা। আমি গলায় কয়েক কেজি সুন্দরবনের খাঁটি মধু এনে জিজ্ঞেস করলাম, 'কী হয়েছে বাদলের, খালা?'
আমার কন্ঠে একটু আদ্রতা পেয়ে খালার কান্নার বাঁধ ভেঙে গেল।
: তোরা তো কোন খোঁজ রাখবি না, ছেলেটা রাস্তাঘাটে বের হয়ে মার খাবে। তোরা বসে থাকবি বাসায়...

তারপরের কয়েক মিনিট এমন কয়েক প্রকার অভিযোগ আর কান্নার যৌথ প্রতিক্রিয়ার পর ঘটনা যা জানা গেলো মোটামুটি এইরকম-
বাদল খামারবাড়ি থেকে আসাদ গেট অবধি মানিক মিয়া এভিনিউয়ের রাস্তায় প্ল্যাকার্ড নিয়ে টহল দিচ্ছিলো। বাদলের এই টহল একেবারেই পছন্দ করেন নাই টহলদার সেনাবাহিনী আর র‍্যাব ভাইয়েরা। প্ল্যাকার্ডের চেয়ে সেখানে লেখা কবিতার ভাষা তাদের বেশি অপছন্দ হওয়ার কথা। দুইপাশে দুইটা কবিতা লেখা।
একপাশে লেখা,
'করোনা করলো সর্বনাশ,
নববর্ষে কাটবো ঘাস!'

অন্যপাশে লেখা,
'শোভাযাত্রার আনন্দ শেষ,
এই কি সোনার বাংলাদেশ!'

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এটুক ঘটনা হবে আমি আগেই জানতাম। কারণ প্ল্যাকার্ড নিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউতে চক্কর দেয়ার বুদ্ধি বাদলকে আমিই দিয়েছি। তবে এমন বিচিত্র কবিতা ও কোত্থেকে পেলো, আমার কাছে পরিষ্কার না। ফেসবুকের ফালতু গ্রুপগুলোতেও এত বাজে লাইন চোখে পড়া মুশকিল।

পান্ডে নামে আমার এক পশ্চিমা ব্রাহ্মণ বন্ধু থাকে কাঁঠালবাগানে। এসব কবিতা লেখায় বেশ চটপটে। ওকে বলায় সুন্দর দুইটা কবিতা লিখে দিয়েছিল। একটা হচ্ছে,
'নববর্ষের প্রথম দিন
ঘরে থাকার শপথ নিন।'

আরেকটা হচ্ছে,
'আল্পনাটা কল্পনাতে যত্নে আঁকা হোক,
শোভাযাত্রার হল্লা এবার ঘরের মাঝেই রোক'

এগুলো ছেড়ে বাদল গাধাটা এই উস্কানিমূলক কবিতা কই থেকে যোগাড় করেছে সেটা বিরাট রহস্য। আমার যতদূর সন্দেহ বাদলের 'আহ করোনা, উহ করোনা' বন্ধু এইসব কবিতা ওকে লিখে দিয়েছে!

এই মুহূর্তে রাস্তায় মাইর খাওয়ার এরপরও আর কারণ লাগে না। তবে বাদলের আরো কারণ আছে। বাদলের এক হাতে প্ল্যাকার্ড ধরা ছিল, আরেক হাতে ছিল পাঁচটা মাটির হাড়ি। সেই হাঁড়ি ভর্তি ইলিশ পান্তা! আর হাড়ির মুখের উপর যে কাগজ বাঁধা, তাতে মাথায় কাপড় দেয়া মাজেদা খালার হাস্যোজ্জ্বল ছবি। তার নিচে লেখা,
'এই পান্তা-ইলিশ তোমাদের কে দিয়েছে?!'
তার সামান্য নিচেই লেখা,
বেগম মাজেদা দিয়েছে!

প্ল্যাকার্ডের ওই কবিতার জন্য মাইরের ডোজ এত বেশি হতো না বলে আমার বিশ্বাস। আমি শুধু বুঝলাম না, এই ভয়াবহ সাহসী প্রশ্ন করার আত্মঘাতী আইডিয়া বাদলকে কে দিয়েছে?

আমি বাদলকে হালকা স্বরে ডাকলাম, 'কিরে, বেশি ব্যথা পেলি নাকি?'
চওড়া হাসি দিয়ে বাদল হালকা মাথা উচু করে জানালো, 'হিমু ভাইয়া, আমি বেশি ব্যথা পাই নাই। তবে মাটির শানকিগুলো ফেরত দেয়ার কথা ছিল শাঁখারিবাজারে। আর্মি ভেঙে ফেলেছে। গরিব লোকের জিনিস। আমি তোমাকে টাকা দিয়ে দেব। তুমি পৌঁছে দিতে পারবা?
: পারবো, ঝটপট টাকা আর নাম্বার দে।
: আরেকটা কথা হিমু ভাইয়া।
: বল।
: আমি আসলে বেশি ব্যথা পেয়েছি। তুমি কি এটা সারাতে পারবে?
: না বাদল, পাছার ব্যথা মহাপুরুষরা সারাতে পারে না। এjন্য মহাডাক্তার দরকার।

বলেই আমি সাব্রিনার দিকে অল্প একটু তাকালাম, দেখলাম মেয়েটার ভ্রূ কুঁচকে আছে। আমি আবার কথা শুরু করলাম...

: শোন বাদল। তুই এভাবেই উপুড় হয়ে চুপচাপ শুয়ে থাক। আর খালা, তুমি রসুন সরিষার তেল গরম করার ব্যবস্থা করো। জমিলাকে বলো গরম করতে। গরম হয়ে গেলে সাব্রিনাকে বলবে বাদলের পাছায় তেল মেরে দিতে। ডাক্তার মানুষ। এগুলো ভালো বুঝবে।
খালা গর্জে উঠলেন, 'এগুলো তুই কী বলছিস হিমু?'
: একদম ঠিক বলছি খালা। এগুলো কর। নাহলে চৈত্র সংক্রান্তি শেষ হতে না হতেই বাদলের হাগন বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক বলেছি না জমিলা?
(আমি সম্মতির প্রত্যাশায় জমিলার দিকে তাকালাম, জমিলার মুখের হাসির উজ্জ্বলতা বেড়ে দুইশো ওয়াট হয়েছে। এই এক্সপ্রেশনকে রাজনৈতিক ভাষায় বলা হয় 'সহমত ভাই।')
: জ্বে ভাইজান। ঠিক বলেছেন।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে গটমট করে বাদল আর মাজেদা খালাকে বিস্ফোরিত রেখে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সাব্রিনার দিকে আর তাকানোর সাহস পাইনি! একজন রূপবতী তরুণী চিকিৎসকের বিস্ফারিত নেত্র দেখতে ইচ্ছা করছে না।


২.
রাতে বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হলো আমার। দেরিটা হয়েছে কমলাকান্ত গাঁড়লটার জন্যই।
মাজেদা খালা আমাকে বলেন, আমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই। সে হিসেবে আমার উকিল বন্ধু কমলকান্ত ঘরের খেয়ে বনের ডায়নোসর তাড়ায়!

একটি অদ্ভূত মামলায় আমাকে একরকম জোর করে মামলার সাক্ষী ময়না পাখি বানিয়েছে আমার আফিমখোর বন্ধু।

ঘটনা অতি হাস্যকর। এক বাংলাদেশি অভিনেত্রী। নাম কাবিলা নূর। বিষয় সেটা নয়। বিষয় হচ্ছে ইনস্টাগ্রামে বিখ্যাত হলিউডি অভিনেতা জেরার্ড প্লেটোর সাথে লাইভ সেশনে কথা বলার সময় এই দেশবিখ্যাত অভিনেত্রী নাকি দেশকে ছোট করেছেন। আমি কমলাকান্তকে বললাম, 'বাংলাদেশ তো এমনিই আকারে ছোট। আর কত ছোট করবে?'
: সাইজে নয়। ইমেজে ছোট করেছে। আজীবন সাইজ নিয়ে চিন্তা করে করে ক্যারিয়ার এগিয়েছে। এখন আর ইমেজের কথা চিন্তা করে না! নিজের হোক আর দেশের হোক!
কমলাকান্তের ইঙ্গিত অতি কুরুচিপূর্ণ!
: ওহ, আর কী করেছে?
: জেরার্ড প্লেটোকে কনভিন্স করার চেষ্টা করেছে যে বাংলাদেশ জায়ান্ট কালচার নয়।
: তারপর?
: তারপর জেরার্ড প্লেটো তাকে ডাল চিনিয়েছে, নান রুটি চিনিয়েছে।
: ভালো করেছে। আমাকে তুই শুধু এটা বল, এসব জায়ান্ট কালচার, বামন কালচার এইসবের মধ্যে আমাকে আসতেই হবে?
: হ্যাঁ, আসতেই হবে। কারণ তুই এই দেশে থাকিস। তোর একটা দায়িত্ব আছে। শুধু খালি পায়ে হাঁটা কোন দায়িত্ব পালনের মধ্যে পড়ে না।

আমি কথা বলার যুক্তি এবং ইচ্ছাশক্তি দুটোই হারিয়ে ফেললাম এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও মামালার সাক্ষী ময়না পাখির দায়িত্ব পালন করে বাসায় ফিরলাম রাত এগারোটায়। বাসায় ঢুকে দেখি সুনশান নীরবতা। দরজা খুলে দিল সাব্রিনা। আমি মেয়েটাকে দেখে বেশ লজ্জাই পেলাম। বিকেলে কি না কি বলেছি! আমি আমার রুমের দিকে হাঁটা শুরু করা মাত্রই সাব্রিনা পেছন থেকে ডাক দিল, 'হিমু সাহেব। আপনি একটু সোফায় এসে বসবেন? আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।'

কন্ঠে বিরাট রাগ আশা করেছিলাম। কিন্তু মেয়েটার কন্ঠস্বর আশ্চর্যজনকভাবে শান্ত। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। ঝড়ের আগে নাকি সেই বন্ধু চুপ হয়ে যায়। মানসিক ঝড়। সাব্রিনাও চুপ হয়ে গেছে!

আমি সোফায় গিয়ে বসলাম। টি-টেবিলের ওপ্রান্তে প্রায় মুখোমুখি আরেকটা সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে সাব্রিনা।
: হিমু সাহেব।
: জ্বি।
: আজ বিকেলে আপনি অত্যন্ত বিশ্রী একটা কথা বলেছেন আমাকে।
(আমি চুপ)
: আমি কিছু মনে করিনি। মনে করিনি বললে ভুল হবে। মন মেজাজ খারাপ হয়েছে। কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণে এনেছি।
: আচ্ছা।
: আপনার সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। আশা করি আপনারও নেই। আমি আপনার মানুষকে ভড়কে দেয়ার এসব খেলা জানি। মন থেকে বলেননি যা বলেছেন, তাই আপনাকে ক্ষমা করলাম।
: আমি ধন্য।
: আপনি এখনো ফাজলামোর মুডে আছেন বুঝতে পারছি।
: না না, আমি সিরিয়াস।
: আপনি একেবারেই সিরিয়াস নন। হবারও দরকার নেই। শুনুন হিমু সাহেব, বাবা-মা পরিবারের বাইরে ছাড়া এটা আমার প্রথম নববর্ষ। তার উপর এই আটকে পড়া অবস্থা। আমি চাই না আমার দিনটা এতটাও খারাপ কাটুক।

আমি এবার একটু মেয়েটার দিকে মন দিলাম। হুট করে মনে হলো, মেয়েটার মনটা ভালো। সরল মেয়ে। হাসিটাও সুন্দর মনে হচ্ছে।
: শুভ নববর্ষ সাব্রিনা। তুমি শুয়ে পড়। তুমি মেয়ে ভালো।
: আচ্ছা হিমু, আমি শুয়ে পড়ছি। তুমিও শুয়ে পড়। তুমি ভালো ছেলে।

এই মেয়ে তো ডেনজারাস! আমার টেকনিক আমার উপর ঝেড়ে দিল। সত্যি বলতে, আমি ভড়কেই গেলাম বেশ।
: কি হিমু সাহেব, কেমন দিলাম!?
বলে সাব্রিনা একটা উদ্ভট হাসি দিল। এই হাসি আমি ক'দিন আগে দেখেছি। এ তো 'রিপুন বিডিও' বা রিপন ভিডিওর হাসি। রিপন ছেলেটাকে আমার ভালো লেগেছে। স্বভাব কবি! আমিও রিপনের একটা কবিতা ঝেড়ে দিলাম,
'তুমি দেবে কিছু, আর আমি দেব কিছু,
সেই থেকে জন্ম নেবে ছোট্ট একটা শিশু!'

ছড়া বলেই আমি একটা ফাটাফাটি ঝাড়ি খাওয়ার অপেক্ষা করলাম। ঝাড়ি আর কই, মেয়েটা খিলখিল করে হেসেই যাচ্ছে আর হেসেই যাচ্ছে! আমি মেয়েটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
: হিমু সাহেব।
: জ্বি
: ঘরে যান। শুভ রাত্রি।
: শুভ রাত্রি সাব্রিনা!

আমি রুমে চলে এলাম। আমি নিশ্চিত আজ রাতের ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে বাবা এসে এই মায়ার খেলায় জড়ানোর জন্য ঝাড়াঝাড়ি করবেন। মহাপুরুষ ট্রেনিংয়ের নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য। আসুক। ভাবছি বাবাকেও আজ একটা রিপন ভিডিও কাব্য ঝেড়ে দেব,
'বৃষ্টি এল টুপুর টাপুর টুকুস মাথায় দিয়ে,
দরজা খুলে যারেই দেখুম তারেই করুম বিয়ে!'

সমস্যা হল, আজ রাতে দরজা খুলে সাব্রিনাকে দেখেছি! এই মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না।

৩.
আজকে নববর্ষের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ। কি আনন্দের একটা দিন বছরের! আমার আরো বিশেষ ভালো লাগে, কারণ এই দিনে যত হলুদ পাঞ্জাবি পরা মানুষ দেখি, বছরের আর কোন দিন দেখি না।
করোনায় এই বছরের পরিস্থিতি যথেষ্টই আলাদা দেখা যাচ্ছে। মানুষজন রাস্তায় বের হয় নাই। রাস্তায় না গিয়েও বোঝা যাচ্ছে কারণ, প্রতি বাড়ির ছাদেই মানুষ দেখতে পাচ্ছি। এই পাশের বাড়ির ছাদের মানুষগুলোকে দেখেও খুব ভালো লাগছে। নির্দিষ্ট দূরত্ব নিয়ে বসে বসে এরা বালিশ চোর খেলছে।
মাজেদা খালার বাসার ছাদে আমরা ছয়জন প্রাণী। আমি, সাব্রিনা, মাজেদা খালা, খালু, বাদল আর জমিলা। এর মাঝে সবচাইতে মাঞ্জা মেরেছে জমিলা!

জমিলা অদ্ভূত গেটআপে ছাদে এসেছে। জমিলার পরনে জিন্সের প্যান্ট! তার উপরে শাড়ি! অত্যন্ত অদ্ভূত লাগছে জমিলাকে। কমলাকান্ত দেখলে কাবিলা নূরের মত এই জমিলার নামেও কেস করে দিত! এই স্টাইল সে কই পেয়েছে জিজ্ঞেস করায় জানালো, বাসার পেপারে দেখেছে। সাব্রিনা জমিলাকে দেখে কোনভাবেই হাসি চাপতে পারছে না। এক ফাঁকে সাব্রিনা আমাকে ফিসফিস করে বললো, 'আড়ংয়ের বিজ্ঞাপন দেখেছে মনে হয়!'

খালা ওদিকে খালুকে 'যত খুশি তত মদ' খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। অনুমতি পেয়ে খালু আর কোন রাখঢাক রাখেননি। এন্তার মদ খেয়ে এখন যাচ্ছেতাই বকে যাচ্ছেন। মাজেদা খালাকে হঠাৎ হঠাৎই জমিলা বলে ডাকছেন, খালা তাতে ভীষণ চমকে উঠেছেন। এর মাঝে খালু জমিলাকে দেখিয়ে আবার খালাকে বলছেন,
'লুক এট দ্যাট ইয়াং লেডি! জাস্ট ওয়াও!'
আমি প্রসঙ্গ ঘুরাতে হঠাৎই বললাম, 'ঘুড়িতে নাটাই লাগাবেন খালু?'
: বুড়িকে কোথায় লাগাবো??! জানি না ইয়াংম্যান!

খালুর অবস্থা খুব খারাপ। কথাও এলোমেলো শুনছেন!

আজ একটা কেলেংকারি হবে বুঝতে পারছি।

বাদলকে আমি চোখ ইশারা করলাম। আমার চোখের ইশারায় বাদল বাসার ঘরে গিয়ে পাঁচ মিনিটের মাঝেই একটা ঘুড়ি নিয়ে আসলো। নীল একটা ঘুড়ি। বড় সাইজের।
সাব্রিনা দেখেই বললো, 'বাহ সুন্দর তো!'
: এই ঘুড়িটা তোমার জন্য বানানো হয়েছে সাব্রিনা।
: আসলেইই?
মেয়েটা দেখলাম বাচ্চাদের মত খুশি হয়ে উঠেছে। আমার ভালো লাগলো। মানুষের উচ্ছ্বাস দেখা আনন্দের।
: আসো সাব্রিনা, ঘরবন্দি আমরা আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে নববর্ষ উদযাপন করি!

সাব্রিনার চোখমুখে অদ্ভুত মায়াময় একটা হাসি। ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, 'আগে কখনো ওড়াইনি আমি।'
: পাখি তো আর জন্মেই ওড়ে না। উড়তে শেখে। তাকে শেখায় প্রকৃতি। আমি তোমাকে উড়তে শেখাতে পারবো না। তবে ওড়াতে শেখাতে পারবো।

সাব্রিনা কোন কথা বলছে না। হঠাৎই খেয়াল করলাম আমার সামনে দাঁড়ানো কমলা রঙের শাড়ি পড়া ছিপছিপে গড়নের লম্বা চুলের এই ডাক্তার মেয়েটির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। মেয়েটা কাঁদছে। হাসি-কান্না উভয় ক্ষেত্রেই সুন্দর এই মেয়ে। তার মানে তাহাকে পরিপূর্ণ সুন্দর নারী বলা যায়!
: সাব্রিনা।
: হু?
: চলো ঘুড়ি উড়াই।
: চলুন।

আমি সাব্রিনার হাতে নাটাই ধরিয়ে দিলাম। তার আগে নীল ঘুড়িটা হাতে নিয়ে একবার দেখে নিল সাব্রিনা। তাতে দু লাইনের একটা ছোট্ট কবিতা লেখা। এই কবিতা লিখে পাঠিয়েছে আমার সেই কাঁঠালবাগানের বন্ধু প্রিয়াংকা পান্ডে। কবিতা সাব্রিনার পছন্দ হয়েছে। খিলখিল করে হেসে দিয়ে বললো।
: এই কবিতা কেউ দেখলে বাদলের মত মার খেতে হবে না।
আমি হেসে দিয়ে বললাম, 'সত্য!'
আমি ঘুড়ি আকাশের দিকে ছুড়ে দিলাম। নাটাইটা নিয়ে দ্রুতই পেছনের দিকে চলে এসে সাব্রিনা চড়কা সুতা ছেড়ে দিতে শুরু করলো। আমি, আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখছি, একটা নীল ঘুড়ি আকাশে উড়ে যাচ্ছে...
শহরবন্দি মানুষদের জন্য লেখা আমার বন্ধুর ছোট্ট দুলাইন কবিতা,
'বর্ষ শুরুটা ঘরেই থাকি,
আসছে বছর পুরোটা বাকি...'

(চলবে)

 

আরও পড়ুন: 

হিমু এবং কয়েকটি নীল করোনা : ষষ্ঠ পর্ব

হিমু এবং কয়েকটি নীল করোনা : চতুর্থ পর্ব

হিমু এবং কয়েকটি নীল করোনা : তৃতীয় পর্ব

হিমু এবং কয়েকটি নীল করোনা : দ্বিতীয় পর্ব

হিমু এবং কয়েকটি নীল করোনা : প্রথম পর্ব

২০১৫ পঠিত ... ১৪:৫৬, এপ্রিল ১৫, ২০২০

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top