কুষ্টিয়া থেকে বেশ কয়েকজন পুলিশ এসেছে লালনকে গ্রেফতার করতে। লালন মোটেও ঘাবড়ে না গিয়ে তাদের বলে, ভিখিরির গৃহে আজ রাজকীয় অতিথি; যা আছে চাট্টে খেয়ে নিন পুলিশরাজ। তারপর যাবো আপনাদের খাঁচায় বন্দী হতে না হয়।
কনস্টেবল খায়ের বলে, কাঁটাচামচ ছাড়া বিসিএস সাহেব কী খেতি পারে! সময় নষ্ট কইরোনে; চলো দেখি!
: তা কী ঘাট কইরিচি আমি!
: তুমি আমগের সবার অনুভূতিতে আঘাত দিইচো। তোমার না হয় কোন জাত নাই; কিন্তু এই যে কুষ্টে শহর ভর্তি আশরাফ আর ব্রাহ্মণ; তাদের দিকটা একবার দেখপানা!
বিসিএস অফিসার ধমকে বলে, কীসের এত কথা! ওকে নৌকায় তোলো!
লালন মিনতি করে, একবার কী বলবেন বিসিএসরাজ কী করে কার অনুভূতিতে আঘাত দিইছি আমি!
বিসিএস অফিসার কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করে, এই খায়ের তুমি জানো কিছু!
খায়ের বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। কনস্টেবল ধনঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করে, তুমি কিছু জানো ধনু!
ধনঞ্জয় গাইহারা বাছুরের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ওরা কেউই কিছু জানে না। বিসিএস অফিসার বলে, ফাইলে সব সব লেখা আছে; থানায় গিয়ে জানবে সব।
পুলিশেরা লালনকে নিয়ে পৌঁছালে দেখে থানায় গণ্যমান্য চক্কোত্তি মশয় ও সৈয়দ মহোদয় বসে দাঁত খিলান করছে। লালনকে দেখেই দুজনে সমস্বরে ধমক দেয়, অই ব্যাটা চাষা, এইসব কী গান বেঁইধেছিসরে চণ্ডাল কুতাকার!
ফাইল হাতে নিয়ে বিসিএসরাজ গোপালগঞ্জের ভাষায় বলে, কী ছাতার মাথা লিখেছো এইসব সাওয়া!
‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীলোকের কি হয় বিধান।
বামন চিনি পৈতে প্রমাণ
বামনী চিনি কি করে।।’
লালন হ্যান্ডকাফ বাঁধা হাত জোড় করে বলে,
‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।’
সৈয়দ সাহেব চোখে সুরমা দিতে দিতে বলে, তোর নাহয় কোন জাত নেইরে লালন। আমি তো আরব থেকে জাত নিয়ে এসেছি।
চক্কোত্তি পাঞ্জাবির ভেতরে পৈতেটাকে আদর করে বলে, শোনরে লালন আমি হলেম আর্য আর তুই অনার্য! তুই কী বুঝবি জাতের মর্ম।
লালন করুণ চোখে চক্কোত্তির হাত ধরতে গেলে চক্কোত্তি চিৎকার করে, ছুঁসনি ছুঁসনি; গঙ্গাজলে চান করতে হবে আমায় তাহলে।
থানায় গণ্যমান্য অতিথিদের জন্য আনা সিঙ্গাড়া খেয়ে সৈয়দ ও চক্কোত্তির তলপেটে মোচড় দেয়। দুজনের মধ্যে কে আগে প্রক্ষালন কক্ষে যাবে তা নিয়ে টস করে কনস্টেবল ধনঞ্জয়। খায়ের তাদের রাষ্ট্রীয় প্রটোকল দিয়ে একে একে সূর্য ডোবাতে নিয়ে যায়।
থানার বাইরে জমা হয়েছে বিক্ষুব্ধ হিন্দু ও মুসলমান। তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগায় ক্রোধে ক্ষিদেয় আর রোদে হি হি করে কাঁপছে সবাই। লালনকে হাতের কাছে পেলে জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে এমন অবস্থা। চক্ষুলাল সবার; চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। অনুভূতিতে আঘাত লাগলেই তারা নরভোজি হয়ে ওঠে। এলাকার এক মোল্লা আর এক পুরোহিত ‘বেজাত লালনের ফাঁসি চাই’ শ্লোগান দিচ্ছে কেঁপে কেঁপে।
সৈয়দ ও চক্কোত্তির তলপেট শান্ত হলে তারা এসে বসে তসবিহ ও মালা টিপতে থাকে। ফুসফুস করে সুরা ও মন্ত্র পড়ে তারা।
বিসিএস রাজ আবার ফাইল দেখে বলে, কত বড় সাহস ব্যাটার; বলে কীনা!
‘কেউ মালা কেউ তসবিহ গলে
তাইতে কি জাত ভিন্ন বলে।
আসা কিংবা যাওয়ার কালে
জাতের চিহ্ন রয় কারে।।’
লালন কাঁচুমাচু করে বিড় বিড় করে,
‘জগৎ জুড়ে জাতের কথা
লোকে গল্প করে যথাতথা।
লালন বলে জাতের ফাতা
ডুবাইছি সাধবাজারে’
বিসিএস অফিসার ধমক দেয়, তা এইসে যখন পইড়েছো সাধবাজারে; যাও সাধ মিটিয়ে জেল খাটো ব্যাটা লালন শয়তান কুনহানকার! সাইবার সিকিউরিটি আইন ভইরে দিয়েছি।
লালন সবার দিকে তাকিয়ে বলে, আজকাল আমার গান তো শহরের ফ্যাশান হইয়েছে; দেখপেননি অনেক সাহেব-বাবু মামা-মেশো, খালা-পিসি জুইটে যাবেনে আমার মুক্তির দাবিতে। ফেসবুক ভইরে যাবেনে হ্যাশট্যাগ ফ্রি লালনে; কিন্তু ঐ যে এক রিক্সাওয়ালা শাকিল বেচারাকে মিথ্যা চুরির অভিযোগে ছাদ থেকি ফেলি দিয়ে মেইরে ফেইলেছে; ঐডে তো আর কোন ফ্যাশানের মধ্যে নাই হে পুলিশ রাজ! তার আড়াই বছরের ছেলে আর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কী এই খুনের বিচার পাবেনে! নাকি আপনেরা খালি বড় লোকের ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে পইড়েছেন!
কনস্টেবল খায়ের হিড় হিড় করে লালনকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে, লালন মুখ তোমার শত্রু। বিসিএস স্যার ক্ষেইপে ফায়ার হইয়ে গেছেন তুমার ওপরে। তুমারে কাল কোর্টে চালান করা হপে। মুখ বন্ধ রাকলে আজই পা ধইরে মাফ চেয়ে ‘মুক্তি’ নিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারতে গো।
লালন মুচকি হেসে বলে, মুক্তি দেবার মালিক তো ঐ বাড়ির পাশের আরশীনগরের পড়শী। তুমরা কিডা কও দেহি!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন