পরিমল গোস্বামীর রম্যগল্প 'অভিনন্দন'

৬৮৯ পঠিত ... ১৮:৩৯, জুলাই ০৬, ২০১৯

 

সভায় লোক গমগম করছে। সে অবশ্য সভার ঘরটা খুব বড় নয় বলেই। মাঝারি হলঘর এক জমিদারবাড়ির। জমিদার স্বয়ং সভার একজন উদ্যোক্তা।

কবি হলধর হালদারের আজ ত্রিংশত্তম জন্মদিন। এই জন্মতিথি পালন করা হচ্ছে আজ বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের পক্ষ থেকে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ঘটনা অভিনব। কারণ এদেশে সাহিত্যের যদি বা কিছু মর্যাদা হয়েছে, কিন্তু সাহিত্যিকের মর্যাদা, বিশেষ করে এতো অল্পবয়সে কেউ পায় নি। রবীন্দ্রনাথও এত কম বয়সে দেশবাসীর তরফ থেকে প্রকাশ্য সভায় কোনো অভিনন্দন পান নি।

কিন্তু বাংলাদেশ ইতিমধ্যে অনেক এগিয়ে গেছে, দেশ উন্নতির পথে চলেছে বিদ্যুতগতিতে। এমন অবস্থায় হলধর হালধারের মতো কবিকে জাতির অভিনন্দন লাভের জন্যে বৃদ্ধকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে দেওয়া জাতীয় কলঙ্ক। দেশের মন জেগেছে, স্বাধীনতা এসে গেছে, এই তো বীরপূজার সময়। রাজনীতির দিকে এই বীরপূজা শুরু হয়েছে অতি ব্যাপকভাবে। ইংরাজ তাড়ানোর অভিপ্রায়ে যারা একদিনের জন্যেও গোপনে গুলি ছোড়া অভ্যাস করেছে তারা সবাই পূজনীয়। তাদের পূজা আগে। কিন্তু এই পূজা এমন আড়ম্বরের সঙ্গে শুরু হয়েছে যে এর মধ্যে সাহিত্যিকরা ভেবেছে তারাই দেশের সংস্কৃতির পরিচালক, স্বাধীনতার বাণী ছড়িয়েছে তারাই। কিন্তু স্বাধীনতালাভের পর থেকে তারা চাপা পড়ে গেছে। কলমকে লোকে ভুলে গেছে। চারিদিকে বোমা-পিস্তলের জয়ধ্বনি, আর কিছুই না। লোকে বলছে মশাই আত্মত্যাগ চাই। ক’টা সাহিত্যিক মরেছে? ১৯৬৪ সালের প্রথম দাঙ্গায় দু’জন সাহিত্যিক নিখোঁজ হয়েছিলেন মাত্র কিন্তু তাও বেশিদিনের জন্যে নয়।  

তাছাড়া দেশকে বাঁচানোর জন্যে শুধু আত্মত্যাগের কোনো দাম নাই। সেরকম আত্মত্যাগ তো মশাই, যারা নিজেরা না খেয়ে দেশকে খাইয়েছে সেই কোটি কোটি চাষাও করেছে। তাদের ভাগ্যে কটা অভিনন্দন জোটে? জোটে না, তার কারণ সে আত্মত্যাগে নাটকীয় গুণ থাকে না, সভা সমিতিতে তার ওপর বক্তৃতা দেওয়া যায় না। নাটকীয় গুণবিশিষ্ট আত্মত্যাগই আসল আত্মত্যাগ, ওকেই বলে দেশপ্রেম। বেছে বেছে এই দেশপ্রেমকে পুজো না করলে গণতান্ত্রিকতার সম্মান থাকে কোথায়?

সুতরাং সাহিত্যিকরা আর অপেক্ষা করতে পারে না। হলধর হালধারের মতো সাহিত্যিক তো নয়ই। আপাতদৃষ্টিতে হঠাৎ এ ঘটনাকে বিস্ময়কর মনে হতে পারে, কিন্তু ঘটনাটি তলিয়ে দেখুন। কবি ও কথাশিল্পীরাও দেশপ্রেমিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাদের ছবি টাঙিয়ে একটা প্রদর্শনীও হয় না। তারা ইতিপূর্বে যেটুকু সম্মান পেয়েছে তার জন্যে দেশের লোক হয়তো অনুতাপ করবে। এই সম্মান তারা এখন নিজেরা চেষ্টা করে যদি না উদ্ধার করতে পারে তাহলে দেশের পরিণাম অতি ভয়াবহ। হয়তো হঠাৎ একদিন প্রবন্ধ-লেখকেরা দেশপ্রেমিক হিসেবে পুজো পেয়ে বসবে, কারণ সাহিত্যক্ষেত্রে তারাও এখন একটা মর্যাদা পাচ্ছে। সুতরাং সবদিকে ভেবেচিন্তেই স্বাধীন বাংলার কবি হলধর হালদারকে নিয়ে প্রথম সাহিত্যিক পূজা শুরু হলো।   এতে অতঃপর পালাক্রমে সবাই অভিনন্দন পেতে পারবে তাদের জীবিতকালেই। বাংলাদেশের পরমায়ুর গড় তেইশ বছর। কে কবে মরে যায় ঠিক নেই। সে হিসেবে ত্রিশ বছএর হলধর হালধারের তো জীবনের মেয়াদ পার হয়ে গেছে। তাছাড়া রচনাসংখ্যার দিক দিয়ে তাকে প্রবীণ বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না। সে কবিতা লেখা শুরু করেছে তার আঠার বছর বয়স থেকে, তার বারো বছরের কাব্যজীবনে কবিতার সংখ্যা দাড়িয়েছে প্রায় পঁচিশ হাজার। এত অল্পদিনে এত কবিতা- দেশপ্রেমের চূড়ান্ত প্রমাণ।

সভা জমে উঠেছে। হলধর হালধারকে উপযুক্ত সম্মানই দেওয়া হচ্ছে সাহিত্যিকদের পক্ষ থেকে অর্থাৎ জাতির পক্ষ থেকে। হলধর রচিত গান দিয়েই সভার উদ্বোধন হল। তারপর বক্তারা উঠতে লাগলেন একে একে। প্রথম বক্তা বললেন, ‘হলধর হালদার বাংলার গৌরব। তিনি দেশের দুঃখ-দুর্দশার গান গেয়ে চলেছেন হৃদয়ের সকল আবেগ দিয়ে। যখন তিনি প্রথম কবিতা লেখা শুরু করেন- সে আজ বারো বছর আগের কথা- সে সময় তিনি বাংলার পাখি, বাংলার আকাশ এবং বাংলার বাতাসকে তার কাব্যের বিষয়বস্তু করেছেন। তারপর তার কাব্যজীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু। এই পর্বে আকাশ থেকে তার দৃষ্টি যে ক্রমশ মাটির দিকে ফিরছে তার প্রথম আভাস পাওয়া যায় তার ‘কেঞ্চু’ নামক গদ্য কবিতায়। এই কবিতাটি আমি পড়ে শোনাচ্ছি!-

কেঞ্চু, হচ্ছে আমাদের সুপরিচিত কেঁচো।
বক্তা পাঁচ মিনিট ধরে পড়লেন কবিতাটি।  

তারপর বলতে লাগলেন, ‘এ এক আশ্চর্য কাব্য। বাঙালিকে শেষপর্যন্ত কল্পনার আকাশে উড়ে বেড়ানোর শখ ছেড়ে তার চিরদিনের বাসস্থান মাটিতেই পড়ে থাকতে হবে। -সেই কথাটা এক কঠোর ব্যঙ্গের ভিতর দিয়ে কবি প্রকাশ করেছে এতে। কিন্তু বলতে পারেন এই কেঞ্চু কে? এই কেঞ্চু হচ্ছি আমরা, কারণ আমাদের মেরুদণ্ড নেই, আমরা গর্তে বাস করি। বিস্তীর্ণ পৃথিবী আমাদের অপরিচিত।  এইদিকেই কবি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এটাই হল কবিধর্ম। কবির কাজই হল নবযুগের সূচনা করা। কবি হলেন সত্যদ্রষ্টা, হলধর হালদারও সত্যদ্রষ্টা। আর সত্যদ্রষ্টা যিনি তিনি হচ্ছেন ঋষি। হলধর হালদার ঋষি।

করতালিধ্বনিতে হলঘর মুখরিত হল।

দ্বিতীয় বক্তা বললেন, ‘আমি ওঁর ‘হিমালয় ও বঙ্গোপসাগর’ নামক কবিতাটিকে একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে বিবেচনা করি। কারণ এ কবিতার মধ্যে তিনি ভবিষ্যৎ বঙ্গ-বিচ্ছেদের সুরটি ফুটিয়েছেন। ১৯৪৫ ও ১৯৪৭ –এর আভাস ধরা পড়েছে তার কল্পনায়। হিমালয়ের প্রস্তরীভূত তরঙ্গের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গের তুলনা করে তিনি যে অসাধারণ কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছেন, তার কথা আমি নতুন করে বলবো না; আমি বলতে চাই তার ঋষিসুলভ দৃষ্টির কথা। ১৯৪৫ সাল কবিতাটির রচনাকাল। কিন্তু তবু হিমালয় ও বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী দেশগুলোর কথা একেবারে বাদ দিয়ে গেছেন। কবি মধ্যবর্তী জেলাগুলোর কোনো বৈশিষ্ট্যই এই কবিতায় স্থান দেননি। দিতে পারতেন। পাহাড় ও জলের ঢেউয়ের সঙ্গে ধানক্ষেতের ঢেউ উল্লেখ করতে পারতেন্ম কিন্তু কোনো ধানক্ষেত কোন রাষ্ট্রে পড়বে তা নিয়ে পাছে গোলমাল হয়, সেজন্যে তার ধ্যানচিত্র ধানক্ষেত্রে কোনো ছায়াপাত করেনি। অতএব হলধর হালদার যে ঋষি এই কথাটি আশা করি আমিও প্রমাণ করতে পেরেছি।‘  

সভাঘর আবার হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হল।
বক্তৃতা চললো পাঁচ ঘন্টা ধরে। কেউ কবিতা পাঠ করলেন, কেউ গান গাইলেন, কেউ গান গাইলেন, কেউ নাচলেন এবং সব শেষ হলে সভাপতি বললেন-
‘আমরা আজ হলধর হালদারকে যে অভিনন্দন জানাচ্ছি এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী বক্তা বলেছেন, ‘ এ অভিনন্দন শুরহু আমাদের এই কয়েকজন সাহিত্যিকের নয়, এ হচ্ছে সমস্ত বাংলাদেশের অভিনন্দন।‘ কিন্তু কথাটা আমি একটু অন্যভাবে বলতে চাই। আমি বলি এ অভিনন্দন বাংলাদেশকেই অভিনন্দন। কারণ হলধর হালদারের কাব্যে দেশের মর্মকথা ব্যক্ত হয়েছে। অতএব হলধর হালদারই বাংলাদেশ।

সভাপতি বলতে লাগলেন, ‘আমি হলধর হালদারের কাব্যে একটি অতি গভীর ও মূল্যবান ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি। তিনি গত একবছরের মধ্যে ন্যাশনাল ফ্ল্যাগের ওপর এক হাজার, দাঙ্গার ওপর সাত শো, বোমার যুগের ওপর পাঁচ শো, ১৫ আগস্টের ওপর সাড়ে চার-শো এবং বাউন্ডারি কমিশনের ওপর তিন শো কবিতা লিখেছেন। কবির উদ্দেশ্য আপনারা কিছু বুঝতে পেরেছেন কি? মোটামুটি একরকম অবশ্যই বুঝেছেন, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য থেকে তার শাঁস গ্রহণ করতে হলে খোসা ছাড়িয়ে, খোল ভেঙে, ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। আমি তা করেছি। এবং করে যা পেয়েছি তা হচ্ছে এই যে, স্বভাবত উদ্যমহীন বাঙালির সম্মুখে অবিলম্বে- কর্তব্য কোনো কাজের লোভনীয় পরিকল্পনা নেই, অথচ স্বাধীণ বাংলার বাঙালিকে একদিন না একদিন কাজের ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তেই হবে। তাই বাঙালি জীবনের তৎপরটা ও কর্মচাঞ্চল্য জাগিয়ে তোলার জন্যে আপাতত হাতের কাছে যা আছে তারই দিকে তার মনোযোগ আকর্ষণ করা দরকার। তার মনে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি করা দরকার। আমরা কী ছিলাম তা বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার। দাঙ্গায় মাঝে মাঝে উসকানি দিয়ে হাত-পা চালনা শিক্ষা দেওয়া দরকার। তাই হলধর হালদার তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেছেন বাঙালি উদ্বোধনের কাজে। বাঙালিত্ব উদ্বোধনের কাজে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ গড়ে তোলার কাজে। তাই হলধর হালদার আমার মতে মহাবাঙালি এবং মহামানব।

সুদীর্ঘ আধ ঘন্টাব্যাপী হর্ষধ্বনি ও কোলাহলের মধ্যে সভা ভঙ্গ হল। হলধর খালি হয়ে গেল ধীরে ধীরে। সভার উদ্যোক্তারা দশ-বারোজন মিলে জমিদারের বৈঠকখানা ঘরে নিমন্ত্রিত হলেন চা খেয়ে যাওয়ার জন্যে। হলধর হালদারকে শোভাযাত্রা করে প্রকাশ্য-পথে বের করে নিয়ে গেল ভক্তরা।

চায়ের আসরে প্রথম বক্তা বললেন, ‘কেঞ্চু কবিতাটি একটা ধাপ্পা। রূপকটুপক কিছু নেই ওতে।‘

আর একজন বললেন, ‘হিমালয় ও বঙ্গোপসাগর’টাই বা কী হয়েছে?’

আর একজন বললেন, ‘গত এক বছরের সব কবিতাই দেখেছি- যেসব দাবি করা হল, যেসব ইঙ্গিত আছে বলা হল, সে অনেকটা জোর করে নয় কি?

সভাপতি বললেন, ‘ও শালা আবার লিখতে জানে নাকি?’

৬৮৯ পঠিত ... ১৮:৩৯, জুলাই ০৬, ২০১৯

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top