হুমায়ূন আহমেদের অপ্রকাশিত হিমু: সবাই গেছে ফেসবুকে

৫৩৪১ পঠিত ... ২১:৪৭, জুলাই ১৯, ২০১৭

ঘুম থেকে উঠতেই দেখি মেসেঞ্জারে মাজেদা খালার নক।

মাজেদা খালা কখনও একবার নক দেয়ার মানুষ না। একবার নক দিলে তিনি মেসেজ দেখার আগ পর্যন্ত নক করতেই থাকবেন, করতেই থাকবেন। সাধারণত সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ নক হয় না। মেসেজ উইন্ডো খুললে দেখা যাবে, নতুন এক পদ রান্না করে সেটার ছবি দিয়ে রেখেছেন। এই ছবি দেয়ার মানেই হলো, বাসায় আয়, খেয়ে যা।

যেহেতু একবার নক দেয়া হয়েছে, ব্যাপারটা অবশ্যই সন্দেহজনক। বিভিন্ন রকম রিস্ক আছে। খালু আট নয় পেগ খেয়ে বিগড়ে গেছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে, এমন কিছু হতে পারে। আমি মোবাইল হাতে নিলাম, কিন্তু মেসেজ খুললাম না। বেশিক্ষণ যে ঘুম হয়েছে তাও না, ঘন্টা দুয়েক হবে। এরই মধ্যে নয়টা মেসেজ জমা হয়েছে ইনবক্সে। এর মধ্যে চারটা মেসেজ হলো ‘এড মি ভাই আপনাকে অনেকদিন ধরে ফেসবুক ফলো করি...’

আমি প্রথমেই বাদলের মেসেজটা খুললাম। বাদল লিখেছে, ‘হিমু ভাই আজকের চাঁদটা এত জোস উঠছে। আমি চাঁদের সাথে সেইরকম একটা সেলফি তুলছি, শেয়ার দিও তো। ছবিতে ইদানিং লাইক কম পড়তেছে। তুমি সেলিব্রেটি মানুষ, শেয়ার দিলে ধুমায়ে লাইক পড়বে। আর রাতে অনলাইন হইয়ো, একসাথে চ্যাট করতে করতে রাস্তায় হাটবোনে।’

বাদলের মেসেজ ক্লোজ করে খুললাম বিসমিল্লাহ হোটেলের মোতালেব ভাইয়ের মেসেজ। তার বক্তব্য পরিষ্কার না, শুধু লেখা, ‘হিমু ভাই আছেন?’ আমি এর অর্থ বোঝার চেষ্টা করলাম। কী প্রয়োজনে আমাকে দরকার হতে পারে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। নতুন কোনো স্বপ্ন দেখেছেন, এমন হতে পারে। মঙ্গলবার তার স্বপ্ন-রজনী, এই লোক প্রতি মঙ্গলবার রাতে একটা করে ফালতু স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন সর্বোচ্চ যতটুকু অর্থহীন হতে পারে, তার স্বপ্নগুলো তার চেয়েও অর্থহীন। তিনি খুব আগ্রহ করে সেইসব স্বপ্নের অর্থ জানতে চান। স্বপ্নের অর্থ জানার একমাত্র সোর্স- হিমু ভাই!

সেদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘হিমু ভাই, খুব আচানক একটা স্বপন দেখছি বুঝছেন। স্বপ্নে দেখলাম, নুসরাত ফারিয়া আমারে ফেসবুকে ডিলিট দিয়া ফলো মারছে। এইটা কেমুন স্বপন কন তো। হ্যা তো মার লিস্টেই নাই, আমারে ডিলিটই কেমনে দিবো আর ফলোই বা কেমনে দিব! হা হা হা! এইটার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো রূপক আছে, আপনি জ্ঞানী মানুষ, বলেন তো ব্যাপারটা!’

আমি প্রতিবারই প্রতিটা স্বপ্নের একটা ইতিবাচক অর্থ বলি। ভদ্রলোক খুশি হন। সম্ভবত এ কারণেই তিনি বারবার আমার কাছেই স্বপ্নের মানে জানতে চান। মানুষ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইতিবাচক কথা শুনতে পছন্দ করে।

এরপর খুললাম রমনা থানার ওসি মোফাজ্জল সাহেবের মেসেজ। আজ ছুটি পেয়েছেন, পরিবার নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের আজ রবিবার নাটকটা দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাচ্চারা নাকি গেম অব থ্রোনস ছাড়া কিছু দেখবেই না। অগত্যা সেটাই খুঁজছেন, টরেন্ট লিংক আমার কাছে আছে কিনা জানতে চান। আমি গট দেখিনা, সমাজ আমাকে মেনে নেবে কিনা এ সংক্রান্ত স্ট্যাটাসও দেই না। সুতরাং এই মেসেজের রিপ্লাই করা না করার কোনো মানে হয় না।

একদম শেষে খুললাম রূপার মেসেজ। সে বেশি কিছু লেখে নি। চারটা শব্দ, ‘ঠিক সাড়ে এগারোটায় এসো।’ বাসার নিচে গিয়ে দাঁড়াতে বলছে অবশ্যই। আজকের চাঁদটা কি খুব ফর্মে আছে নাকি! তেমনই তো মনে হয়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, পৌনে এগারোটা বাজে। এখনও বেশ সময় আছে হাতে।

আমি স্মার্টফোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পাঞ্জাবির পকেট না থাকায় স্মার্টফোনটা হাতে নিয়ে ঘোরাটা খুব যন্ত্রণার বিষয় হয়েছে। মনে মনে পরিকল্পনার তালিকায় নতুন একটা পরিকল্পনা অ্যাড করলাম, ‘পাঞ্জাবির একটা আলগা পকেট লাগাতে হবে। পকেটহীন ঘোরাঘুরি বন।’

মেসের নিচে টেলিফোন অপারেটর আনিসকে দেখলাম না। কাজের ছেলে বদিকে জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে সে বিরক্ত মুখে জানালো, আনিসের চিকুনগুনিয়া হয়েছে। আমি কেন জানি হেসে দিলাম!

আনিস থাকলে দুয়েকটা ফোন করা যেত। আমার ফোনে ডাটা থাকলেও, ব্যালেন্স জিরো। ডাটা মাজেদা খালা কত টাকা যেন লোড করে সরাসরি ভরে দেন। কোনো অদ্ভুত কারণে ব্যালেন্স ট্যালেন্স দেন না। স্মার্টফোন অবশ্য তারই কিনে দেয়া, তিনি যা চাইবেন, তা-ই ভরবেন! খারাপ কী!

ফেসবুকটা খুলে দিয়েছে বাদল। বাদলের এখন ফেসবুক সেলিব্রেটি হওয়ার ঝোঁক। প্রতিদিন চলমান ইস্যু নিয়ে পোস্ট দেয়। আমাকেও ইনবক্সে লিংক দিয়ে লাইক দিতে বলে। একদিন দেখলাম, আর্টস ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্র বাদল সাহেব ঈশ্বর কণা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ এক প্রবন্ধ লিখে ফেলেছে। আমাকে নক করে লিংক দিয়ে বললো, ‘হিমু ভাই দেখো, ফাটায়ে দিছি না একদম? দেড়শ শেয়ার হইছে। শেষে বুঝছো, তোমারও একটা ঈশ্বর সংক্রান্ত কোটেশন মাইরা দিছি। এতে ইফেক্ট বেটার হইছে। ভালো করছি না?’ আমি বাদলের মেসেজে একটা থাম্বস আপ রিঅ্যাক্ট মেরে রেখে দিয়েছি। মনে মনে একবার বলেছি, ‘হায় ঈশ্বর!’

ফেসবুকটা দ্রুত ডিঅ্যাকটিভ করা দরকার। কোনোভাবেই করা হচ্ছে না। মানুষ থেকে দ্রুত সবুজ রঙের বাতি হয়ে যাচ্ছি। ইদনিং মাথা সোজা করে রাস্তায় হাঁটতে আর ভালো লাগে না। মাথা ঝুঁকিয়ে স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে হাটার একটা আলাদা ফিলিংস আছে। মনে হয় অকারণেই হাঁটছি না, খুব জরুরী কাজ করতে করতে হাঁটছি। তবে ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। বাবা মাইন্ড করতে পারে।

ফেসবুক সম্পর্কে বাবা লিখেছেন, ‘নীল রঙের কোনো রঙ্গশালার মোহে পড়িয়া কখনো রঙিন দুনিয়া ভুলিয়া যাইবে না। লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতও হইবে না। নীল বেদনার রঙ। মহাপুরুষরা যেহেতু সকল প্রকার বেদনার ঊর্ধ্বে, তাহাদের বেদনার রঙের দিকে চব্বিশ ঘন্টা তাকাইয়া থাকিলে চলে না। নীলের মায়া কাটাইয়া নিজের লক্ষ্যে একাগ্র হও। আর যাই করিয়া থাকো না কেন, তামিল নায়িকার ছবিওয়ালা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ভুলেও একসেপ্ট করিবে না। ইহাতে অধিক ঝামেলা আছে।’

ফেসবুকের ইন্টারফেস নীল থেকে পরিবর্তন হয়ে লাল বা সবুজ হলে তা ব্যবহার করা যাবে কি না, এ ব্যাপারে বাবা কিছু লেখেন নি। হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ইন্সটাগ্রামের কথাও কিছু লেখেন নি। এখানেও অস্পষ্টতা থেকে যাচ্ছে। ইন্সটাগ্রামের কথা মনে পড়তেই আমি একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পায়ে শুধু জুতা স্যান্ডেল নেই দেখে দুই পায়ের জুতার ছবি তুলে ইন্সটাগ্রামে পোস্ট দেয়া হয় না। অতি দুঃখের বিষয়।

এলাকার পরিচিত কুকুরটা আমার পিছু পিছু হাঁটছে। আমি একটা মজার কাজ করেছি, ওকেও একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছি। অ্যাকাউন্টের নাম-কালু কালু। প্রোফাইল পিকচারে তার জিহ্বা বের করা একটা ছবি। ইনফোতে দিয়েছি, ওয়ার্কস অ্যাট ফেসবুক। ব্যাপারটা তো বিশেষ মিথ্যা না। দুনিয়া তো একটা ফেসবুকই বটে।

সাড়ে এগারোটা বাজে। আমি রূপার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে। সকালে বৃষ্টি হয়েছিল, তাও ভালো এতক্ষণে জমে থাকা পানি নেমে গেছে, নাহলে নৌকা নিয়ে আসতে হতো।

আমি দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ আবারও মেসেঞ্জারে মেসেজ আসার শব্দ। ভেবেছিলাম মাজেদা খালাই হবে বোধ হয়। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি, রূপা। নীল শাড়ি পরে মুখ পাউট করে একটা সেলফি তুলে পাঠিয়েছে। নীল রঙের একতা হাঁসের মতো লাগছে। আচ্ছা, হাঁস এত রঙের হয়, নীল রঙের হয় না কেন?

আমি রিপ্লাই করলাম, ‘আমি কিন্তু তোমার বারান্দার নিচে আসি নি।’

রূপা একটা হাইফেন আন্ডারস্কোর হাইফেন ইমো দিয়ে রিপ্লাই দিলো, ‘হ্যাঁ, আমি কি বারান্দার নিচে আসতে বলেছি? আমি তো বললাম সাড়ে এগারোটায় ফেসবুকে আসতে। এখন কিন্তু লাইভে আসবো। আছো না?’

আমি মেসেজ সিন করে রেখে দিলাম। হিমুদের সব কথার উত্তর দিতে নেই।

হাঁটতে ভালো লাগছে না। আমি রুপার বাসার কিছু দুরেই পরিচিত একটা চায়ের দোকানে বসে উদ্দেশ্যহীনভাবে হোমপেজ স্ক্রল করতে শুরু করলাম। দোকানদার বাচ্চু মিয়ার হাতেও ফোন, সেও ফেসুবুকিং করছে। ফেসবুকে সেও আমার ফ্রেন্ড। আমি মুখে কিছু না বলে চুপচাপ বাচ্চু মিয়াকে নক দিয়ে বললাম, ‘বাচ্চু মিয়া, দুই কাপ চা দাও তো।’

কুকুরটা ঠিক বেঞ্চের পাশেই বসে পড়েছে। তারও ফেসবুক আছে, অথচ হাতে স্মার্টফোন না থাকায় সে ফেসবুকিং করতে পারছে না। তবু আমি কালুকে ফেসবুকে নক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি রে কালু, তোর জন্য তো চায়ের অর্ডার দিয়ে ফেলেছি। চা খাবি তো?’

কালু উত্তর দেয় না। শুধু মানুষ না, প্রাণীরাও মেসেজ সিন করে রাখতে বড় ভালোবাসে।   

৫৩৪১ পঠিত ... ২১:৪৭, জুলাই ১৯, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top