ফুলটাইম ফাকবয়, অলটাইম ডিবেটার

২৬৬ পঠিত ... ১৭:৩৪, এপ্রিল ২২, ২০২৪

4 (9)

ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমের সূত্রে অনেকই জানেন যে,  আসনা তাবাসসুম চৌধুরী নামের এক স্নাতক শিক্ষার্থীকে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া।

এই মেয়েটির প্রাপ্ত রেজাল্ট অনুযায়ী, এই ভ্যালেডেক্টোরিয়ান বক্তৃতার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের একটা বিশেষ দেশের আগ্রাসনের  বিরুদ্ধে  লেখালেখি করায় ওর এই বক্তব্য বাতিল করা হলো। অজুহাত হিসেবে বলা হচ্ছে, অন্য শিক্ষার্থীরা অনিরাপদ বোধ করছে, তাই তারা দাবী জানিয়েছে। নিঃসন্দেহে মার্কিন মুলুকে বাকস্বাধীনতার 'ডাবল স্ট্যাণ্ডার্ড-এর একটা উদাহরণ হয়ে রইলো এমন পদক্ষেপ।  

যাই হোক, ধান ভানতে আরেক শিবের গীত গাই। আজকের এই ঘটনায়, ৭৫ বছর আগে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়া আরেক শিক্ষার্থীর আলাপ করতে মন চাইলো। একদিন আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষের গণহত্যার সাথে লেপ্টে থাকবে যার নাম। আলোচ্য ওই ছোকড়া দক্ষিণ এশিয়ার এক জমিদারপুত্র। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়াতে পড়তে পাঠানোর আগেই শর্ত হিসেবে বাপ উনাকে বিয়ে দিয়েছিল। কারণ ইতোমধ্যে বন্ধুমহলে তার খ্যাতি হয়েছে- ফুলটাইম ফাকবয়, অলটাইম ডিবেটার- হিসেবে। বেপরোয়া ছেলে যেন বিদেশে গিয়ে বখে না যায়, তাই এই বিয়ের জোয়াল।  

কিন্তু ওই সদ্য বিবাহিতা বউকে কৌশলে ফেলে রেখেই ক্যালিফোর্নিয়ার জাহাজে চেপে বসেছিল সেই জমিদারপূত্র। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ক্যাম্পাসে পড়তে আসা সারা বিশ্বের এলিট সন্তানদের সোসাইটিতে যোগ দেয়া হলো অচিরেই। মদ, মেয়ে আর পার্টি এই জগতের সাথে হলো বন্ধুকৃত্য। কিন্তু আরেকটা জিনিস মন দিয়ে করতেন, সেটা হচ্ছে ডিবেটিং। ইউনিভার্সিটি ডিবেট টিমের উজ্জ্বল সদস্য হিসেবে ইতোমধ্যে নাম কুড়িয়েছেন।সেই জনপ্রিয় বিতার্কিক হিসেবে নামের বদৌলতেই একদিন ক্যাম্পাসে তার ডাক পড়লো স্থানীয় মুসলিম সোসাইটির আয়োজনে বক্তব্য দেয়ার।

ওই সময় মধ্যপ্রাচ্যে নতুন একটা ’বিশেষ' দেশ হয়েছে;  মুসলিম দেশ ফি/লি/স্তিনের  বুক চিরে। ইউরোপ থেকে বাস্স্তুচ্যুত নতুন মাইগ্রেন্টদের হাতে দেশ হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন সেই ভূমির সন্তানেরা। ক্রমশঃ দেশ হারানো মানুষদের পক্ষ হয়েই বক্তৃতা দিলেন তিনি। যিনি কিনা কিছুদিন আগে উপমহাদেশ ভাগের লভ্যাংশ ভোগকারী  এক নেতার সন্তান। ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সাংবাদিকেরা মুগ্ধ হয়ে শুনলো উনার যুক্তি।পরদিন প্রায় সব পত্রিকায় ছাপা হলো এই ইয়াং মুসলিম ছাত্রটির কথা। বক্তব্যে তিনি কোট করেছেন বিভিন্ন দার্শনিক আলাপ। বক্তৃতার শেষে ইংরেজিতে আবৃত্তি করেছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের আরেক নোবেলজয়ী জমিদারপূত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদী কবিতা।

পরের সপ্তাহে মার্কিন সংবাদমধ্যম তো বটেই, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে নিজের দেশ পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমেও পরিচয় লেখা হলো তার। আলোচ্য ওই ফাকবয়ের নাম, জুলফি। পুরো নাম জুলফিকার আলী ভূট্টো। পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশ-এর জমিদার  শাহনেওয়াজ ভূট্টোর ছেলে। কিছুদিনের মধ্যেই পুরনো ক্যাম্পাস ছেড়ে ভূট্টো যোগ দিলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলি ক্যাম্পাসে। একসময় হলেন বার্কলি ডিবেটিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট।ওইখানে স্নাতক শেষে পড়তে গেলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। সেখানেও হলেন ডিবেটিং সোসাইটির  প্রেসিডেন্ট। জুলফিকার আলী ভুট্টোই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি পৃথিবীর সেরা দুইটা ডিবেটিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।

পড়াশোনা শেষে ইতোমধ্যে নাম কামানো জুলফিকার আলী ভূট্টো ফিরে গেলেন পাকিস্তানে। বন্ধুদের বললেন, এবার তার লক্ষ্য একদিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়া। বন্ধুদের লবিং-এ ভিড়লেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সুনজরে। ভারতের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে উনাকে পাঠানো হলো জাতিসংঘে বিতর্ক করতে। যুদ্ধের ময়দানে পাকিস্তান হেরেছে। কিন্তু জাতিসংঘের তর্ক বিতর্কে ভূট্টো ছিলেন সপ্রতিভ উজ্জ্বল। হতাশাগ্রস্থ পাকিস্তানে নতুন হিরো হয়ে উঠলেন ওই বক্তৃতাবাজ ভূট্টো।

আইয়ুব পতনের পর উনার পাকিস্তানের ‘প্রেসিডেন্ট’হওয়ার স্বপ্ন যখন প্রায় কাছাকাছি। তখন আবিষ্কার করলেন, তার পথের বাধা গোপালগঞ্জের ‘এক দরিদ্র মুহুরির ছেলে’ শেখ মুজিব। বক্তৃতার মঞ্চে তার চেয়ে উজ্জ্বল; তার চেয়েও তীক্ষ্ণ এবং পুরুষালী কণ্ঠের জোর যার।  সর্বোপরি তার চেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজ পাশ শেখ মুজিব।

তবুও জমিদারী রক্ত, ইংরেজি-দক্ষতা  আর বিদেশে পড়ালেখার গৌরবে বলীয়ান ভূট্টো ‘বিতর্কে’ আমন্ত্রণ জানালেন শেখ মুজিবকে। বিতর্কের বিষয়, 'ছয় দফা কর্মসুচির ভালো মন্দ'। সেই আহ্বানে সাড়া দিলেন; শেখ মুজিবের সহচর তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বললেন, মুজিব ভাই নয়; ছয় দফা নিয়ে আলাপে তিনিই যথেষ্ট।

তাজউদ্দীন ছিলেন এই ছয়দফার কৌশলীদের একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির আরেক ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। দেশভাগের আগে দুই বাংলার সম্মিলিত মেধা তালিকার চতুর্থ হয়েছিলেন তিনি। স্কুল লাইফে মুখস্ত করেছেন আল কোরআন, হয়েছেন হাফেজ। আর স্কুল পেরোনোর পর যিনি অন্তঃস্থ করেছিলেন বিপ্লবী বিভিন্ন লেখাপত্র।

যেহেতু আওয়ামী লীগ ঠিক করেছে তাজউদ্দীনকে। তাই ভূট্টোর অনাগ্রহে এই বিতর্ক আর হলো না। কেননা, ঢাকায় রাজনৈতিক ফুটেজ পেতে তিনি বিতর্কে আগ্রহী ছিলেন স্বয়ং শেখ মুজিবের সাথে। বক্তৃতার সেই জেদ মিটিয়েছিলেন ১৯৭০ এর সালের নির্বাচনী ইশতেহার বক্তব্যে। ইউটিউবে পাবেন ঐ বক্তব্য। কিন্তু ইশতেহার বক্তব্যে কিছুটা জিতলেও নির্বাচনে হারলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য দাবীদার শেখ মুজিব।

এমন অপমান মেনে না নিতে পেরেই; নিজের ক্যারিশমা উৎসর্গ করলেন বাঙালি গ/ণ-হত্যা জাস্টিফাই করতে সারবিশ্বে। একদিন ফি/লি/স্তি/ন গ-ণ-হ-ত্যার প্রতিবাদ করে হিরো হওয়া ভূট্টো; সারাবিশ্বে বক্তৃতা দিয়ে যুক্তিতর্ক করতে লাগলেন বাঙালি গ-ণ-হ-ত্যার পক্ষে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এই গ-ণ-হ-ত্যা-র বিপক্ষে তখন স্বর হিসেবে আবিভূর্ত অক্সফোর্ড ইউনিয়নের আরেক উজ্বল বিতার্কিক ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী।

যুদ্ধে হারলেন ভূট্টো।

হয়তো বুঝলেন যুদ্ধের ময়দানে হারলে, বিতর্কের মঞ্চে জিত মূল্যহীন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কাগজ ছিঁড়ে চিৎকার করতে করতে বের হয়ে হয়ে যাওয়া ভূট্টোর ওই বক্তব্য তো এখনও ভাইরাল ফুটেজ। ইন্টারনেট ঘাঁটলেই পাবেন। যাই হোক, এই স্রষ্টাপ্রদত্ত  বিতর্ক দক্ষতা ভূট্টোকে কম দেয়নি। কিন্তু কেড়েও  নিয়েছে অনেক। কেড়ে নিয়েছিল প্রাণটাও।

যুদ্ধে হারলেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ভূট্টো। সংবিধান সংশোধন করে কিছুদিন ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭৭ সালে নিজের বানানো সেনাপ্রধান জিয়াউল হক যখন ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে তাকে কারাগারে পাঠালো। তখনও তিনি চিঠি লিখে জানালেন; তার কোনো আইনজীবীর প্রয়োজন নাই। নিজেই লড়বেন যুক্তি তর্কে। তবে, শর্ত হচ্ছে- আদালতের সেই যুক্তিতর্ক টেলিভিশনে জাতির সামনে সম্প্রচার করতে হবে।

আদালত সেই দাবী নাকচ করে দিল। আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হলো। ভূট্টো নিজের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য প্রদেয় সময়ে চুপ করে রইলেন। রায় ঘোষণার পরে যদিও কথা বলতে চাইলেন। কিন্তু তখন আর কথা বলবার অনুমতি মিললো না।

একদিন একটি গণহত্যার প্রতিবাদে বক্তব্য দিয়ে লাইমলাইটে আসা এক ইয়াং ফাকবয়.. আরেকটি গণহত্যার পক্ষে গলাবাজি করে প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করা এক পলিটিশিয়ান.. নিভৃত ফাঁসিকাষ্ঠে নিজের বানানো একসময়ের পুতুল সেনাপ্রধানের হাতে হত্যার শিকার হলেন। কিন্তু নিজের জীবনের শেষ বক্তব্যের খায়েশ অপূর্ণ রেখেই...

২৬৬ পঠিত ... ১৭:৩৪, এপ্রিল ২২, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top