মধুখালি হত্যাকান্ড: ফরিদপুরে চাই স্বস্তি 

৮৫ পঠিত ... ১৬:৫৯, এপ্রিল ২৭, ২০২৪

27 (6)

 

লেখা: মফিজ ইমাম মিলন

রাজনীতি ও আন্দোলনের উর্বর জেলা খ্যাত শান্ত ফরিদপুর শহরকে অশান্ত করার অপচেষ্টা থেকে  আমাদের বিরত থাকা উচিৎ। এ শহর হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির শহর। অতীত ঐতিহ্যের গরীমায় গৌরবান্বিত শহর। এখানে সমাজ সেবক হিসেবে যদি কাউকে সম্বোধন করতে হয় তা হলে তিনি বাবু অম্বিকা চরণ মজুমদার। যিনি একনাগাড়ে কুড়ি বছর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। তারই ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় রাজেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯১৮ সালে। করেছিলেন ফরিদপুর টাউন (অম্বিকা) হল। ৪টি বড় জলাশয় জুবিলী ট্যাঙ্ক, লালদিঘী, পুলিশ হাসপাতাল পুকুর ও  জুতাপট্টি পুকুর।  যা জনসাধারণের পানির চাহিদা মেটাতো। উকিল বার ভবন, খাবার পানির কল বসানো। এগুলো হিন্দু বা মুসলমানদের জন্য নয়!  করেছিলেন মানুষের জন্য । আর সে কারণে মানুষ আজও তাকে মনে রেখেছে।    

মধুখালি উপজেলার পঞ্চপল্লীতে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে, এর উত্তাপ রেষারেষি এখনও রয়ে গেছে । মন্দিরে অগ্নিকাণ্ড ঘটানোর উৎসাহে যা করা হয়েছে তা জঘন্যতম নিন্দিত ও কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গতকাল বৃহস্পতিবার চাঁদমারীতে বৃষ্টির জন্য ইস্তিস্কার নামাজ পড়বার আগে বিভিন্ন উপজেলা থেকে লোক জড়োর পায়তারা চলছিল। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের সচেতনতায় তা সম্ভব হয়নি। আজ শুক্রবার বাদজুমার ওর বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করা হয়েছে। মিছিল থেকে যদি দুষ্টচক্রের কেউ ঢিল ছোঁড়ে তা যেয়ে পড়বে দিল্লিতে। ১৩০ টি জুয়েলারি আর কারিগরি দোকান মিলে শ্রমিকের সংখ্যা তিন শতাধিক। এদের গায়ে চিমটি পড়লেও আমার ভাই আমাকে শাসানি দেবে দাদাকে কি বলেছিস? এটাই বাস্তবতা।

ফরিদপুর সংসদীয়-৩ আসন থেকে নির্বাচিত ১৯৮৬ সালে মেজর জেনারেল অবঃ মহব্বতজান চৌধুরী খাদ্য মন্ত্রীত্ব হারিয়ে ছিলেন তার একটি মাত্র বক্তব্যে। অম্বিকাপুর শ্মশান ঘাটে বলেছিলেন ‘আপনারা ব্যবসা করবেন এখানে আর ক্যাশবাক্সটা রাখবেন  ওপারে, তা করবেন না। মাতৃভূমি ও দেশাত্মবোধের কথা মাথায় রাখবেন।’

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শান্তিবৃক্ষপাতা তাজা রাখতেই তার মন্ত্রীত্ব খাওয়া হয়েছিল ।

মধুখালি পঞ্চপল্লীর সাথে লাগোয়া বর্তমান বালিয়াকান্দির জঙ্গল ইউনিয়ন। কয়েক ঘর বাদে পুরো ইউনিয়নই সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের বসবাস। ১৯৭০ এর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী ও বালিয়াকান্দির এ অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালেহ উদ্দিন। তিনিই '৭২ এ গণপরিষদের সদস্য এবং '৭৩-এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ( খেজুর গাছ ) হয়ে। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন এডভোকেট গৌর চন্দ্র বালা। নানান অকৌশলে হিন্দু মুসলমান মিলে গৌরবালাকে হারিয়ে ছিলেন ভোট যুদ্ধে। এ আসন থেকেই ১৯৭৮ সালে বিএনপির টিকেট নিয়ে এম পি হয়েছিলেন সিরাজুল ইসলাম মৃধা । এ সবই আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কৌশল ।

চাঁদাবাজী করতে গিয়ে, সাধারণ শ্রমিকদের পুঁজি বানিয়ে, মন্দিরে আগুন জ্বালানোর পিছনেও রাজনীতি যে নেই তা হলফ করে কেউ বলতে পারবেন না । সেদিন যদি জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার আর পুলিশ সুপার মোর্শেদ আলম, ইউএনও, ওসি ভোর ৪ টা পর্যন্ত দূর্ঘটনা স্থলে না থাকতো তবে দুই ভাইয়ের লাশ পুড়িয়ে ফেল বার মতো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল।  তারা তো চাকরি করতে এসেছেন। কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান সাহেবের কি ভুমিকা? আর চাঁদাবাজীর ঘটনার সুত্রপাত কোন্দল হিংসাত্মক রুপ নিলো কাদের হস্তক্ষেপে?

মধুখালির ক্রোকদীতে মাটি ও মানুষের জন্য নিবেদিত কত মানুষ জীবন বাজি রেখে গেছেন তা কি আমরা জানি?  মণি কৃষ্ণ সেন ২৯ বছর আত্মগোপনে ছিলেন, মনোরঞ্জন রায় ৮ বছর কারাগারে আটক ছিলেন। শ্যামেন ভট্টাচার্য, কমিউনিষ্টদের প্রবাদ পুরুষ  আশু ভরদ্বাজ এর ত্যাগের কথা আমরা কজন জানি।  

উপমহাদেশের এক কিংবদন্তির নাম নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস। তাঁর নেতৃত্বে একসময় রাজবাড়ীর উত্তপ্ত রাজনীতিকে শান্ত করতে কংগ্রেস স্বরাজ ঐক্যবদ্ধসূত্রে হিন্দু -মুসলমানদের ঐক্যের প্রচেষ্টা করেছিলেন। এখানে পূর্ব থেকেই অনুশীলন, কমিউনিষ্ট, স্বরাজ বিপ্লবীদের ঘাঁটি ছিল ক্রোকদিতে। ১৯৪৩ এ সুভাষ বোসের প্রতিকৃতির ব্যাস ও সাদা শাড়ী পরে সুঠাম দেহী বিপ্লবী মহিলারা বাঁশের লাঠি মহড়া দিয়েছিল । তাদের শ্লোগান ছিল ‘আসামের গুণ্ডামি, চলবেনা চলবে না’!

অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা বিষয় বলতে চাচ্ছি, তা হলো মাদারীপুরের কমরেড অরুণা সেনকে কোনো মুসলমান নির্যাতন করেননি, করেছিল রক্ষীবাহিনী! তার ছেলে চঞ্চলকেও রক্ষীবাহিনী গ্রেফতার করেছিল।

ফরিদপুর শহর সবসময়ই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসীদের বসবাস । রাজনীতির কিংমেকার খ্যাত ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়ার রাজনৈতিক সচেতনতা এবং তার পুত্র চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা শহরবাসীর কাছে পরিচিত। জননেতা সাহসী পুরুষ ইমাম উদ্দিন আহমেদ, এডভোকেট শামসুদ্দিন মোল্লা,  এস এম নুরুন্নবী, এডভোকেট মোশাররফ হোসেন, সৈয়দ হায়দার হোসেন , এডভোকেট কাজী খলিলুর রহমান, এডভোকেট আবদুস সালাম লাল ভাই, এডভোকেট আদেল উদদীন আহমেদ, সাংবাদিক লিয়াকত হোসেন, আলহাজ্ব দেলোয়ার হোসেন কোন আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করেছেন তা সকলেই অবহিত। আলহাজ্ব ফিরোজার রহমান সাহেব স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে অনেকের বাড়িতে এসে লুটপাট করা মালামাল উদ্ধার করে নিজে পৌঁছে দিয়েছেন।

সংস্কৃতির শীর্ষ সংগঠন দেড়শত বছর বয়সী ফরিদপুর টাউন থিয়েটার চালাতেন হিন্দু মুসলমান উভয়ই। এডভোকেট সরোয়ার জান মিয়া, কাজী খলিলুর রহমান, মহিউদ্দীন আহমেদ, এডভোকেট মজিবুর রহমান খান, অধ্যাপক মোঃ শাহজাহান, রত্নেশ্বর চক্রবর্তী, সুখসূর্য শিকদার আরও অনেকেই ছিলেন যারা কখনোই হিন্দু মুসলমান পার্থক্য খোঁজেননি কখনও।  অবশ্য 'কথা কৃষ্ণ কলি' নাটকের মতো ঘটনাও ঘটেছে । ২০০২ সালের ৬ আগস্ট এ নাটক কেন্দ্র করে ৩৪ জন নাট্যকর্মী ঘর ছাড়া রয়েছে আট বছর। সাংবাদিক অমরেশ রায় হাইকোর্টে রিট পিটিশনে এটাকে রাজনৈতিক মামলা গণ্য করায় সকলে মুক্তি পেয়েছে। মনোজ সাহা নামে একটা ছেলে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ইন্ডিয়াতে রয়েছে । তার আর দেশে ফেরা হবে না। নাটক মঞ্চস্থ করায় যে অভিযোগ উঠেছিল তা মধুখালি হত্যার মতো সত্য ঘটনা বলে অনেকেই মত দিয়েছেন। দুর্ভাগ্য নাটকটি দেখা হয়নি আমার।

সাংবাদিক গৌতম দাস হত্যা নিয়ে ফরিদপুর শহর নয় সারাদেশে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। সে সময়ের পুলিশ সুপার আবদুল জলিল কম সময়ের মধ্যে এ হত্যাকান্ডের চার্জশীট দাখিল করে নজির সৃষ্টি করে ছিলেন। আসামিদের শাস্তিও হয়েছে। এর আগে ২০০১ সালে ২১ এপ্রিল  সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে হত্যার উদ্দেশ্যে কারা ঘটনা ঘটিয়েছিল এবং পঙ্গু বানালো তাকে তা প্রবীর নিজেই জানে। অপরাধীদের শাস্তি কেন হলো না,  তা-ও সে জানেন।  

একসময় এ শহরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কান্ডারী ছিলেন  এডভোকেট যামিনী কান্ত লাহিড়ী, কিরণ লাহিড়ী, ডাঃ ননী গোপাল সাহা, মহি উদদীন আহমেদ , আব্দুস শুকুর শুকপাক, তরুণদের মধ্যে মুন্সি মোহাম্মদ আলী রুমি আর হায়দার আলী মোল্লা। এদের মধ্যে জাতিভেদ নিয়ে কথা ওঠেনি । রাজবাড়ী থেকে আসতেন বামন দাস গুহ। তিনি ছিলেন পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল এর অধ্যক্ষ। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তিনি ।

ফরিদপুরে চিকিৎসা স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান গুলোর শুরুতেই ডাঃ মোহাম্মদ জাহেদ সাহেবের নির্ভরশীল মানুষটি ছিলেন ডাঃ ননী গোপাল সাহা , অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ সাহা, রাধা গোবিন্দ সাহা, অমরেন্দ নাথ দাস নিমাইদা, বাবু হরিপদ সাহা। পাশাপাশি আব্দুস সালাম চৌধুরী, রকিব উদ্দিন আহমেদ, আলহাজ্ব জহুরুল হক, সাব্বীর ইউসুফ, অধ্যাপক এম এ সামাদ, অধ্যাপক শেখ আব্দুস ছামাদ , আবুল বাশার মিয়া, লিয়াকত হোসেন, আদেল উদদীন হাওলাদার, মীর নাসির হোসেন, এ কে আজাদ এর অবদানের কথা রেজুলেশন খাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। অন্যদিকে খোন্দকার মোশারফ হোসেনের হেলমেট বাহিনী যদি এডভোকেট সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে ভাংচুর না করতো তা হলে হয়তোবা  বাস্তবতায় এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হতো না।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে প্রেসক্লাবে আমারই এক সহকর্মী বললেন ‘মুসলমানদের মার খেয়ে মৃত্যু বরণ করতে হচ্ছে, পিটিয়ে জখম করেছে, নেতাদেরও না সাংবাদিকদেরও না, এদের কোন বিষদাঁত নেই। তা হলে এমন ভাবে মার খেতে হতো না।’  আমি হতবাক হয়ে চেয়ে ছিলাম।  সামনাসামনি কিছু বলার পরিবেশ ছিল না। এখন বলছি । বন্ধু,  বিষদাঁত থাকে কুকুরের, শিয়ালের সাপের।  আমার কেন থাকবে?  আমি তো মানুষ।  মানুষের বিষদাঁত থাকতে নেই।

আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কে অবিশ্বাস, ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানো ও একে অপরকে হুমকি ধামকি দেওয়া থেকে বিরত থাকি।

ফরিদপুর শহর শুধু নয় জেলাকে অশান্ত, অস্হিতিশীল দেখতে চাই না আমরা। তবে মধুখালি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীরা গ্রেফতার না হলে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে কষ্ট হবে । দোহাই লাগে কেউ অরাজকতার সৃষ্টি করতে যাবেন না । আমাদের ভাইয়েরা পাশের দেশেই থাকে।  এখানে ঢিল ছুঁড়লে ওখানে পাটকেল খেতে হবে তাদের।

মফিজ ইমাম মিলন: লেখক ও সিনিয়র সাংবাদিক

৮৫ পঠিত ... ১৬:৫৯, এপ্রিল ২৭, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top