বাংলাদেশির মৎস্যপ্রীতি ও 'কম মাংস' খাওয়ার অপবাদ

১১০ পঠিত ... ১৭:৩৬, এপ্রিল ২৯, ২০২৪

18 (6)

লেখা: শুভজিৎ ভৌমিক

(১)

পৃথিবীর সবচেয়ে "কম মাংস খাওয়া" যে দেশগুলা আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে নিচে আছেঃ ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশ। গুগল করলেই পাবেন।

ইন্ডিয়ার কথা বাদ। ধর্মীয় কারণে বহু লোক নিরামিষ খায়।

লিস্টের বাকী দেশগুলা যদি দেখেনঃ প্রায় সবই আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত অনাহারী গরিব দেশ। ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া এইসব। তাহলে বাংলাদেশের কেইস কী?

(২)

কেইসটা হলো আমাদের মাছ। বাংলাদেশ প্রোটিন কনজামশন প্রধানত কাভার দেয় আমাদের এই মাছ। অথচ, ফেসবুক আর অনলাইন ট্রেন্ড যদি আপনি দেখেন, তাহলে মনে হবেঃ গরুর মাংসের কেজি হচ্ছে দেশের প্রধান আলোচ্য বিষয়। 

ইউটিউব দেখলে মনে হবে, ফুডব্লগিং বলতে আমরা বুঝিঃ কালাভুনা, মেজবান, বিরিয়ানি, রোস্ট - এইসব। অনলাইন জায়গাটা যে রিয়েল লাইফকে এক ফোঁটাও রিফ্লেক্ট করেনা, এই মাংসপ্রীতি দর্শন সেইটার একটা ভালো উদাহরণ।

(৩)

লজ্জার ব্যাপারঃ একটা দেশের প্রধান প্রোটিন সোর্স নিয়ে কোনো ব্লগার ভিডিও বানায় না। ইউটিউবে খুঁজলে আপনি বাংলাদেশের খুব ভালো, ইউনিক কোনো মাছের রেসিপি বা ব্লগ পাবেন না।

ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে - ইয়াং পোলাপান, কোনো মাছই চেনেনা। একটা মাছ থেকে আরেকটা মাছ আলাদা করতে পারেনা। মাছের কাঁচা বাজারে - এদের নিয়ে ছেড়ে দেন। বাজি লাগায় বলতে পারি, এরা বোকার মতো তাকায় থাকবে।

অথচ, আমরা সবাই স্মরণ করতে পারিঃ আমাদের বাপ দাদারা - একটা ভালো মাছ কিনলে, বড় মাছ কিনলে, মাছের বড় লট কিনলে, ঘাটের জেলেদের কাছ থেকে ফ্রেশ মাছ কিনলে - গর্বে বুক ফুলিয়ে বাসায় ফেরার দিনগুলা। মনে আছে নাকি নাই?

(৪)

আমার ধারণা, ঢাকা কেন্দ্রিক বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমানের "মাছ বিমুখ" হওয়ার এই ব্যাপারটার পিছে অনেকখানি দায়ীঃ মুসলমানদের মাছ রান্নার টেকনিক।

রান্না ব্যাপারটা যদি বোঝেন, তাহলে আপনি জানবেনঃ দুইটা আলাদা রান্না, তাদের চরিত্রে যতোই মিল থাকুক না কেন - পাশাপাশি খেতে আকাশ পাতালের মতো আলাদা লাগতে হবে। আলাদা যদি না লাগে, তাহলে রান্নাটা ফেইল করবে।

ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে "বাটার চিকেন" আর "চিকেন টিক্কা মাসালা" পাশাপাশি রেখে খাবেন। যদি দুইটার স্বাদ আলাদা করতে না পারেন - তো ভাই, হয় ওই রেস্টুরেন্ট ভালো না। অথবা, স্বাদ বোঝার জায়গাটায় আপনি ধরা খেয়ে গেছেন।

(৫)   

টেক মাই ওয়ার্ডস ফর ইট। বাংলাদেশি মুসলমানদের মাছ রান্না - সিরিয়াসলি বোরিং। এইটার প্রধান কারণঃ সব মাছে পেঁয়াজ ব্যবহার। থিক গ্রেভি তৈরি করতে গিয়ে প্রত্যেকটা মাছে পেঁয়াজ দেয়া - সব মাছের স্বাদ হরেদরে একই বানিয়ে ফেলেছে। 

ধর্ম নিয়ে মাইরপিট করতে করতে তো আমাদের আর কিছু বাকী নাই। তো ধর্মটা সাইডে রেখে - আমি আপনাকে হিন্দুবাড়ির মাছ রান্না খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাই। গরুও না, শুয়োরও না। নো হারাম কাজ-কারবার।

হিন্দু-মুসলমান এই একটা জায়গায় সিনোনিমাস। মাছ। হান্ড্রেড পার্সেন্ট হালাল সার্টিফায়েড, দুই ধর্মের জন্যই। চারশো পদের মাছ প্রত্যেকদিন বাংলাদেশে খাওয়া হচ্ছে। এইগুলা যে আমরা চিনিনা, এবং এইগুলা রান্নার পার্থক্য জানিনা - এইগুলা সম্পর্কে জানার দরকার আছে নাকি নাই?

(৬)

বাঙালি হিন্দুদের মাছ "প্রধানত" রান্না হয় - ফোড়ন দিয়ে।

আর এইখানেই মূল পার্থক্যটা তৈরি হয়। ঝোল হবে খুবই পাতলা। বেইজ মশলা সাধারণত আদাবাটা। সাথে যায় ফোড়ন। কাঁচা মরিচ। হলুদ। দ্যাটস ইট। মশলা কম, স্বাদ বেশি।

বাজি লাগায় বলতে পারি। হিন্দুবাড়িতে খেয়ে দেখেন। এই খাবারগুলা - পেট ঠাণ্ডা রাখা খাবার। গরমের দেশে পেট ঠাণ্ডা, তো দুনিয়া ঠাণ্ডা। হিন্দু রেসিপিগুলা বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগেই, সব ব্লগার এবং ভ্লগারদের আহবান জানাই - এই রেসিপিগুলা কোথাও না কোথাও ডকুমেন্ট করে রাখেন।

একবার হারিয়ে গেলে কিন্তু আর পাওয়া যাবেনা এইসব!

(৭)

এইখানে অবশ্যই উল্লেখ করার মতো ব্যাপারঃ বাংলাদেশে মাছের জগতে (আমার মতে) সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো - ছোট চিংড়ি। কুচা, ইচা, হরিণা - যে নামেই ডাকেন।

এই সম্ভবত একটা জিনিস চিংড়ি, যেইটা ফার্মে চাষ করার পরেও - স্বাদে খুব সাংঘাতিক কোনো পার্থক্য আসে নাই। দুর্দান্ত টেস্টবাড না থাকলে, আপনি ধরতেই পারবেন নাঃ কোনটা চাষের চিংড়ি আর কোনটা ফ্রি-রেঞ্জ চিংড়ি।

চিংড়ির দাম খুব বেশিও না। খুব কমও না। মূল ব্যাপারঃ চিংড়ির স্মেল, আর এই স্মেলটার কারণেই চিংড়ি পরিমাণে লাগে কম। সুতরাং দামে পোষায়। যে কোনো সবজির সাথে চিংড়ি মিশিয়ে দেন। স্বাদ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। যে কোনো ভর্তায় চিংড়ি মেশান। আমূল বদলায় যাবে ভর্তার স্বাদ।

ছোটবেলায় মায়েদের রান্না করার সময়, জাস্ট লবণ-হলুদ দিয়ে ভাজা দুইটা চিংড়ি মুখে নিয়ে আমরা দৌড় দিতাম। সত্যি কইরা বলেন দেখিঃ ওই ছোট্ট দুইটা চিংড়ি ভাজার স্বাদ - দুনিয়ার অন্য কোনোকিছুতে পাইছেন কি?

(৮)

লেখা এইখানেই শেষ। লাস্টে একটা সাজেশন। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুস্বাদু ছোট চিংড়ি খুব সম্ভবত পাওয়া যায় - সাতক্ষীরা আর পটুয়াখালি রিজিওনে।

পটুয়াখালি সদর থেকে আমতলী পার হয়ে কুয়াকাটার দিকে একটা সোজা, লম্বা রাস্তা চলে যায়। এই রাস্তাটার নাম কুয়াকাটা মহাসড়ক। স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞাসা করবেনঃ এই লম্বা রাস্তার মধ্যে "হেতালিয়া বাঁধঘাট" কোথায়।    

সেই হেতালিয়া বাঁধঘাটে আছে - একটা ছাপড়া মার্কা ছালাদিয়া হোটেল। নাম হচ্ছে "জলিল হোটেল"।

মহাবিশ্বের শ্রেষ্ঠতম চিংড়ি ভুনা এই জলিল হোটেলে তৈরি হয়। পদ্মাসেতু তৈরি হওয়ার আগে - বরিশাল বিভাগটা বিশেষ সুগম ছিলোনা। একের পর এক ফেরি পার হওয়া লাগতো, বরগুনা-পটুয়াখালি এইসব অঞ্চলে যাওয়ার জন্য। ওই দুর্দিনেও আমি মানুষজন দেখেছি, ঢাকা থেকে পটুয়াখালি এসেছে - জলিল হোটেলের চিংড়ি ভুনা খাওয়ার জন্য।

জীবনের বাকেট লিস্টে অনেক কিছুই তো রাখেন। আমি বলবোঃ জলিল হোটেলের চিংড়ি ভুনা খাওয়া - আপনার বাকেট লিস্টে থাকা উচিত।

গরম ভাত।

গরম ডাল।

সাথে চিংড়ি ভুনা।

খাওয়া শেষ!

১১০ পঠিত ... ১৭:৩৬, এপ্রিল ২৯, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top