চামকিলা: পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না

২৪৬ পঠিত ... ১৭:২৭, এপ্রিল ২০, ২০২৪

36 (5)

ভারতের খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার ইমতিয়াজ আলী পাঞ্জাবের এক চারণশিল্পী অমর সিং চামকিলাকে নিয়ে একটি বায়োপিক নির্মাণ করেছেন। চামকিলার জন্ম পাঞ্জাবের দারিদ্র্যের অগমে-দুর্গমে। শিশুকাল থেকে সে কবিতা লিখত; মনে মনে তাতে সুর বসাতো। জনঘনত্বের লোকালয়ে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ইতিউতি আলোছায়া লুকিয়ে দেখে শিশুটি তার সংগীতের বিষয় হিসেবে বেছে নেয় লোকজ প্রেমের আদিরস।

ফলে শুরুতে খানিকটা স্ট্রাগল থাকলেও একবার বাই চান্স জনসমক্ষে গান গাওয়ার সুযোগ পেতেই; আর তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। জনপ্রিয়তাই তাকে সামনে টেনে নিয়ে গেছে।

চামকিলা নরম শরম মানুষ; গাড়িতে নারী সহশিল্পীর সঙ্গে পাশে বসতেও তার আড়ষ্টতা। অথচ গান লেখা, সুর করা আর গায়কীতে সে সাবলীল।

ঢাক ঢাক গুড় গুড় করে জীবনের চিরন্তন সত্য যৌনতাকে ঢেকে রাখে যে দুনীতিপ্রবণ সমাজ; যেখানে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা করতে দেয়া হয়না সমাজ উচ্ছন্নে যাবার ভয়ে; সেইখানে চামকিলা তার গানে গানে যেন হ্যাঁচকা টানে খুলে দেয় রসভরী জীবনের রহস্যের আড়াল।

পাঞ্জাব কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে যৌন অবদমনের কারণে আদিরস এসে ঠাঁই নেয় পুরুষের জিভে। নারী সমাজ লুকিয়ে চুরিয়ে তার অপ্রাপ্তির গল্প বলে। আসলে জীবনের সমস্ত রোমান্টিকতাকে অচল সমাজপ্রথার ফতোয়া দিয়ে ঢেকে ফেললে; যৌনতার গল্পে সাধারণ মানুষ তার জীবনের অতৃপ্তির কথা বলে। চামকিলা তাই তার শিল্পের মাঝ দিয়ে সমাজকে রিলিফ দিতে চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু নির্জনে নারীকে পেলে জোর করে আখক্ষেতে নিয়ে গিয়ে বলাৎকার করা মাতবর, বিয়ের নামে নারী ধর্ষণের পাষণ্ড, পাওডর মেখে সংস্কৃতি করতে গিয়ে মঞ্চের উইংস-এর আড়ালে ঘাপ করে চেপে ধরা সংস্কৃতি মামা, ধর্ম শিক্ষা দিতে গিয়ে পেডোফিলিক হওয়া লোকেরা; চামকিলার গানের বিরুদ্ধে অবসিনিটি বা অশ্লীলতার অভিযোগ আনে; তাকে বার বার জীবনের হুমকি দেয় তারা।

সতী সাবিত্রী সাজা নারীরা চামকিলার গান নিয়ে ছ্যা ছ্যা করলে বৃদ্ধারা বলেন, চামকিলার গান আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে শুনি।

চামকিলার গানের লং প্লে রেকর্ড, ক্যাসেট বিক্রি পাঞ্জাবের সব যুগের রেকর্ড ভঙ্গ করে। এক জিনস-শার্ট পরা আধুনিক নারীবাদী সাংবাদিক এসে চামকিলাকে সাক্ষাতকারের নামে গ্রিল করে; পত্রিকায় তার বিরুদ্ধে যা তা বলে। এইভাবে সমাজের রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল অংশ যৌথভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে গানের পাখি চামকিলার বিরুদ্ধে।

জীবন নাশের হুমকি দিয়ে উড়ো চিঠি আসে। চামকিলার গাড়িতে গুলি করে ভয় দেখানো হয়। বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে চাঁদা নিয়ে যায় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। পুলিশ থানায় ডেকে হুমকি দেয়, চামকিলাকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগ এনে ক্রসফায়ারে দেয়া হবে। চামকিলা অভিমান করে বলে, সেটাই করুন স্যার; জ্বালা জুড়াক তাতে।

পাঞ্জাবের নেতৃস্থানীয় লোকেরা তাকে ডেকে ভক্তিমূলক গান গাওয়ার হুকুম দেয়। চামকিলা ভক্তিমূলক গান লিখে সুর করে গেয়ে; নিজের ক্যাসেট বিক্রির রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলে। কিন্তু ভক্তদের অনুরোধে তাকে আবার প্রেমের গান গাইতে হয়।

স্বর্ণমন্দির অভিযানের পরে গোটা পাঞ্জাব পুলিশি হামলায় কবরস্থানের মতো নীরব হয়ে গেলে; চামকিলা সিদ্ধান্ত নেয় সে জীবনমুখী গানের জলসা করে জাগিয়ে রাখবে পাঞ্জাবকে।

একজন নারী সহশিল্পীর প্রয়োজনে সে গায়িকা অমরজোতকে দ্বিতীয় বিয়ে করে। পঞ্চায়েত তার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল তোলে। অথচ চামকিলা কেবল একজন গানের সঙ্গীর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য বিয়ে করতে বাধ্য হয়। নইলে অমরজোতের অর্থ গৃধনু পিতা চামকিলার সঙ্গে তার মেয়ের গানের জুটি ভেঙ্গে দেবার হুমকি দেয়। চামকিলা তার গানের জনপ্রিয়তা দিয়ে সে প্রতিবন্ধক অতিক্রম করে। কারণ পঞ্চায়েতের লোকেদের নিজেদের চরিত্রে শতছিদ্র; তারা চামকিলার সূঁচের একটি ছিদ্র খুঁজে অনেকটা ফেসবুক ট্রায়ালের মতো বিচারের ব্যর্থ মজমা বসিয়েছিলো যেন।

ক্যানাডায় স্ত্রীকে নিয়ে সে গান গাইতে গেলে, শিখ নেতারা তাকে ডেকে গান গাওয়া, খুশিজল পান ও ধুমপান বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। এদিকে দেশে গোটা পাঞ্জাব জুড়ে চামকিলা বিরোধী ডিফেমেশন আর গোবর ছোঁড়ার ক্যামপেইন চলতে থাকে।

বন্ধুদের অনুরোধ উপেক্ষা করে চামকিলা স্ত্রীকে নিয়ে গানের জলসা করে বেড়াতে থাকে। কারণ তার গান তখন পাঞ্জাবের যাপিত জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু শত সহস্র ভক্ত শ্রোতা দর্শক; সংখ্যাগরিষ্ঠ অহিংস মানুষের চেয়ে গুটিকতক হিংস্র মানুষের শক্তি অনেক বেশি। আর মিডিওকার গায়কেরা চামকিলাকে ঈর্ষা করে; দিকে দিকে বিষ নিঃশ্বাস ছাড়তে থাকে। অবশেষে মুখ ঢেকে বন্দুক হাতে এগিয়ে আসা কতিপয় ঘাতক এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে চামকিলা ও তার স্ত্রী-সহশিল্পী অমরজোতকে হত্যা করে। গুলিতে নিহত হয় তার ট্রুপের দুজন বাদ্যযন্ত্রী।

গোটা পাঞ্জাবে শোক নেমে আসে। তার হত্যার বিচার দাবি করে মিছিল ও মানববন্ধন হয়। পুলিশ দায়সারাভাবে কথা বলে মিডিয়ায়। উলটো চামকিলা অশ্লীল গান গাইতো বলে ভিক্টিম ব্লেমিং করে। আবার পুলিশের মাঝে তার গানের ভক্তরা নীরবে অশ্রু ফেলে।

সংগীত শিল্পি বব মার্লিকে কনসার্টে আততায়ীর গুলি করা আর গায়ক চামকিলার গানের জলসা করতে এসে গুলি খাওয়া পৃথক ভূগোলে একই রকম ট্র্যাজেডি হিসেবে ইতিহাসে রয়ে যায়।

ফ্ল্যাশ ব্যাক আঙ্গিকে এমন জীবন্ত গল্প বলা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু ইমতিয়াজ আলী তার সিনেমাটোগ্রাফির ভাষায় এই মিউজিক্যাল বায়োপিককে অনবদ্য এক উপাখ্যান হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ইরশাদ কামিলের লেখা গান আর এ আর রহমানের সুরে মিউজিক্যালটি হৃদয় জিতে নিয়েছে। চামকিলার চরিত্রে দিলজিত দোসাঞ্ঝ আর অমরজোতের চরিত্রে পরিণীতি চোপড়া তাদের সেরাটুকুই দিয়েছেন এই চলচ্চিত্রে।

 যে চামকিলা পাঞ্জাবের মানুষের হৃদয়ে বেঁচে ছিলেন এতদিন; এখন তিনি বেঁচে থাকবেন গোটা পৃথিবীর সংগীত প্রিয় মানুষের মনে।

২৪৬ পঠিত ... ১৭:২৭, এপ্রিল ২০, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top