পাঁচফোড়ন ও গরম মশল্লার কালচার

১৫৪ পঠিত ... ১৫:৩৬, মার্চ ২৪, ২০২৪

33 (3)

ঢাকার পরে কলকাতা ও করাচি শহরকে আমি সবচেয়ে কাছে থেকে জানি। এর কারণ প্রথমত আমার আব্বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্র ছিলেন; ফলে শৈশব থেকে আব্বার কাছে এর আদ্যপান্ত সম্পর্কে জেনেছি। কলেজ পাশ করে দুইমাসের দীর্ঘ ভারত ভ্রমণে গিয়ে কলকাতায় থেকেছি। সে সময় এক তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে কলকাতার অলিগলি ঘুরেছি। এর হৃদস্পন্দ টের পেয়েছি। মনীষীরা পরামর্শ রেখেছেন, যদি কোন সমাজ -সংস্কৃতি ও ভাষাকে বুঝতে চাও; ঐখানে একজন নারীর সঙ্গে বন্ধুত্ব কর। সুতরাং করাচির এক তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্বসূত্রে করাচি শহরটিকে চিনেছিলাম। এই দুটি শহরের অন্তঃমিল হচ্ছে দুটোই আড্ডার শহর; মনের মধ্যে কিছু না রেখে সাবলীলভাবে সব কথা বলে দেয়ার শহর। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতাকে অপছন্দ করে কসমোপলিটান হয়ে ওঠা শহর।

২০০২-২০০৭ ডয়চেভেলের কর্মসূত্রে জার্মানিতে কলকাতার অধিকাংশ সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের হোস্ট হয়ে উঠেছিলাম যেন। আর কলকাতার সহকর্মীরা এটা চেয়েছিলেন; জার্মানিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী থেকে সুবোধ সরকার ; অথবা আনন্দবাজার পত্রিকার সেসময়ের সম্পাদক সুমন চট্টোপাধ্যায়কে আমি এটেইন করি; সময় কাটাই, সাক্ষাতকার নিই। ২০০৬ সালে ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায় ভারত ছিলো থিম কান্ট্রি; ফলে শাশি থারুর থেকে জাভেদ আখতার-গুলজার তাদের সঙ্গে ম্যারাথন আড্ডা দিয়ে ভারতকে জানার বিরাট সুযোগ এসে যায়।

আর ২০১০ সালে পাকিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে ও সাংবাদিকতা করতে এসে শিল্প-সংস্কৃতি জগতের বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা সূত্রে পাকিস্তানকে জানার সুযোগ পেয়ে যাই।

কলকাতা ও করাচি হচ্ছে ঠোঁট কাটাদের শহর; রবীন্দ্রনাথ থেকে ইকবাল, গান্ধী থেকে জিন্নাহ; কাউকেই খাতির করে কথা বলে না এই দুটো শহরের লোক। আবার এই দুটি শহরের অন্তঃমিলের জায়গা হচ্ছে; কলকাতার রয়েছে উর্দু সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ; করাচির মানুষের রয়েছে বাংলা সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ। এরা কোন এক অজানা কারণে একে অপরের বিরুদ্ধে কিছু বলে না। বরং বলে নিজের বিরুদ্ধে।

১৯৭১ সালের ট্র্যাজেডি নিয়ে করাচির ঘরে ঘরে যে সমালোচনা হয়; কিংবা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে প্রজাশোষণের ট্র্যাজেডি নিয়ে কলকাতার ঘরে ঘরে যে আলোচনা হয়; ঢাকায় তা হয়না। কারণ আমরা ব্যস্ত থাকি ফাঁপা-দলান্ধ ও ধর্মান্ধ আলোচনা নিয়ে।

আমি ঢাকায় বড় হওয়ায় প্রথমে বেশ কালচারাল শক পেয়েছিলাম কলকাতা ও করাচির লোকের সঙ্গে মিশে। কারণ আমি মেলামেশার ক্ষেত্রে কৌশলী। কক্ষণো ঢাকা শহরের কিংবা সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজের খামতির দিকটা তুলে ধরিনা। ফলে বিশেষত কলকাতা ও করাচির যারা আমার বন্ধু; তারা ঢাকাকে নিখুঁত শহর বলে জানে। এটা শিখেছিলাম ঢাকার এক প্রবাদ প্রতিম শিল্পীর দৃষ্টান্ত দেখে। উনি ঢাকা হাইকোর্ট দেখিয়ে নিজের আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বলেছিলেন এক বিদেশিনীকে। আমি তাই খুঁজে খুঁজে জয়নুল আবেদীন, জহির রায়হান, আবুল হাসান, সেলিম আল দীন এরকম নিখুঁত লোকেদের নিয়ে একটা ঢাকাইয়া সিলেবাস বানিয়েছি। কলকাতা ও করাচির বন্ধুদের তাদের গল্প করেছি। ফলে মিথ্যা বলিনি; বাড়িয়েও বলিনি। আমি শুধু চেপে গেছি ট্র্যাশ লেখক-কবি-ফিল্ম মেকারদের কথা। একে সাদা মিথ্যা বলা যায়; কিন্তু মিথ্যা নয়।

ফেসবুকে যাদের জন্ম হলো; মানে যারা মনে করে ফেসবুক আসার আগে জীবনের কোন অস্তিত্ব ছিলো না; তারা রবীন্দ্র অনুভূতি, ইকবাল অনুভূতি,  এমন গুচ্ছ গুচ্ছ আশ্রম ও মাজার গড়ে তুলেছে যে; আমি বিস্মিত হই। যেখানে কলকাতার লোক নিজেরাই রবীন্দ্রনাথকে ধুয়ে দেয়; সেইখানে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করলেই শিবব্রত দাদা এসে মৌলবাদি তকমা দিয়ে দেবে আপনাকে। করাচির লোক যেখানে ইকবালকে ধুয়ে দেয়, সেখানে ইকবালের সমালোচনা করলেই আপনি শরিয়ত ভাইয়ের কাছে পেয়ে যাবেন মোদিভক্তের তকমা।

বিশ্বাস করুন, আমাদের মতো এমন মাঠা প্রগতিশীল আর কুঁচকুঁচানি মুসলমান-হিন্দু অন্য কোন সমাজে নেই। বাংলাদেশ পরিশ্রমী কৃষক ও শ্রমিকের দেশ হওয়ায়; অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। ফলে একটু ফর্সা কাপড় আর সুযোগ পেলে চারজন ২০ প্লেট ভাত ও ১১৮ পদের তরকারি খাওয়ার সামর্থ্য হয়। ফলে আমাদের চর্বি ও অনুভূতি দুটোই বেড়ে গেছে। দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ ছাত্রগুলো এখানে শিল্প-সাহিত্যের আলোচনা স্ল্যাং দিয়ে করে। রবীন্দ্রনাথকে ডিফেন্ড করার সময় মুখ দিয়ে পাঁচ ফোড়নের ভ্যাপসা গন্ধ আর ইকবালকে ডিফেন্ড করার সময় মুখ দিয়ে গরম মশল্লার ভ্যাপসা গন্ধ বের হয়। ফেসবুক মৌ মৌ করে তাতে।

আমাদের এতো রাগ কেন বা আমরা এতো চিকিমাতারি কেন! কলকাতা ও করাচিতে যে আলাপ লোকে মুচকি হেসে তির্যক বাক্যে ঠেস দিয়ে করে; সেই আলাপ করতে আমরা ত্রিশূল ও তরবারি বের করি।

বিশ্বখ্যাত রেড লাইট এরিয়াগুলো তো ভারত ও পাকিস্তানে ছিলো; অথচ সেখানে কেউ রেড লাইট এরিয়ার দালালের ভাষায় কথা বলে না; আমরা কেন বলি! আমাদের এখানে তো সেরকম কোন রেড লাইট এরিয়াই ছিলো না।

আমাদের ইনসিকিউরিটি কমাতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ও ইকবাল তাদের জীবদ্দশায় যে সাহিত্য কর্ম করে রেখে গেছেন; সেখানে তাদের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য আমাদের জগন্নাথ বা জগলুকে প্রয়োজন নাই একেবারেই ।

আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা যোগীর আশ্রমের সেবায়েত কিংবা মাজারের খাদেমের মনোজগতে পড়ে আছি। ধর্ম-রাজনীতি-সাহিত্য সব কিছুতেই আমাদের সেবায়েত ও খাদেম মানসের আদিমতা।

আমাদের সমাজে আত্মসমালোচনার অভাবে এরকম পিছিয়ে থাকা মনোবৃত্তি। এইজন্য আত্মসমালোচনাটা আমি গুছিয়ে করি। বিদেশিদের সামনে যেহেতু দেশের একটা আদর্শ সিলেবাস নিয়ে আলাপ করি; স্বদেশীদের সামনে আমি তাই আমাদের সিলেবাসহীনতা নিয়ে আলাপ করি।

যে কোন আলোচনা-সমালোচনাতেই আমাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে; হাইপারটেনশনের রোগীর মতো আচরণ করি আমরা। হয়তো বন্যা ও নদীভাঙ্গনের দেশের মানুষ বলে আমাদের  ডিএনএ-তে ঘুমের মধ্যে ঘরে পানি ঢুকে যাবার; গৃহ বিলুপ্ত হবার ট্রমা আছে। তাই কেউ আমাদের প্রিয় কোন কবি বা নেতার সমালোচনা করলে মনে হয়; ভাবমূর্তির আশ্রম বা মাজারটা ধসে গেলো।

জীবনকে সহজভাবে নিতে হবে; শিল্প-সংস্কৃতি-সমাজ-রাজনীতির আলোচনায় তীব্র সমালোচনা হবেই। সেগুলোকে সহজভাবে নিতে হবে। বাংলাদেশের ফেসবুকোত্তর বুদ্ধিজীবী সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক কাইজ্জা দেখে মনে পড়ে যায় প্রাচীন বাগদাদের কথা। সেখানে খেলনা বুদ্ধিজীবীরা কাজের কাজ ফেলে ঠুনকো সব বিষয় নিয়ে বিরাট ইন্টেলেকচুয়াল বাহাজ করতো; বাস্তব জীবনের সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক নাই। এরকম এক বিকেলে বাগদাদের স্থানে স্থানে মিডিওকার বুদ্ধিজীবীরা যখন শখের ঝগড়ায় ব্যস্ত; তখন হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করেন। পরাধীনতার শৃংখল পরিয়ে দেন বাগদাদের গলায়।

১৫৪ পঠিত ... ১৫:৩৬, মার্চ ২৪, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top