স্কুলে স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন: জ্যোতির এক অনন্য আলো ছড়ানোর উদ্যোগ

৯১২ পঠিত ... ১৭:১৪, এপ্রিল ০৬, ২০২২

Padman

তেরো বছরের আমি সেদিন স্কুলের ১৫ মিনিটের টিফিন টাইমে মাঠে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছি। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হুট করেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। মনে হলো দু’পায়ের মাঝে তরল কী যেন গড়িয়ে পড়ছে! কী হলো কী হলো ভেবে লজ্জায়, ভয়ে তখন আমার নাক-চোখ-মুখ গরম হওয়ার জোগাড়। বুঝতে পারলাম, বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। এক দৌঁড়ে স্কুলের যে নোংরা বাথরুমে জীবনে পা দেইনি, সেখানে নিঃশ্বাস আটকে ঢুকে গেলাম। বাথরুম থেকে বের হলাম আরেক দুঃশ্চিন্তা নিয়ে। যাহ বাবা, মরে টরে যাবো নাকি! কথা নেই বার্তা নেই রক্ত কেন পড়ছে!

আজ ৮ বছর পরও দিনটির কথা মনে পড়লে কেমন অদ্ভুত লাগে। কী বোকা ছিলাম! প্রথমবারের মত পিরিয়ডের রক্ত দেখে ভেবেছিলাম মরতে বসেছি বুঝি! তবে সেই বোকার হদ্য হওয়ার পেছনে আমার দোষ তো নেই। রয়েছে পরিবারের, রয়েছে স্কুলের, সঙ্গে এই সমাজেরও। ভাবুন তো, পিরিয়ডের মতো একটি বিষয়, যা পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যার শারীরিক ভাবে হওয়া বাধ্যতামূলক, তা নিয়ে আমায় আগে-ভাগে জানানোর কেউ কোনো প্রয়োজনই মনে করলো না! তেরো বছর বয়সে কিনা আমি প্রথম পিরিয়ডের রক্ত, যা সেদিনের পর থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমার শরীর থেকে প্রতিমাসে চক্রাকারে নির্গত হতে থাকবে, তা দেখে কিনা আমি মরে যাওয়ার কথা ভাবছি! সে যাত্রায় বাড়ি গিয়ে মা’কে ঘটনা খুলে বলতেই মা-ও আমায় খুলে বলেন সেই ‘নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ’ তথা পিরিয়ড নিয়ে।

তবে আজও নানা পরিবারে, নানা স্কুলে পিরিয়ড এক নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ। তবে তা বদলে দিতে, পিরিয়ডের জন্য ব্যবহৃত প্যাডকে সহজলভ্য ও সুলভ করে তুলতে, নারীকে নানা প্রতিবন্ধকতা ও অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাতে জন্ম নিয়েছে এক অসাধারণ উদ্যোগ ‘জ্যোতি’।

ভেন্ডিং মেশিনের সঙ্গে জড়িত জ্যোতির কর্মকুশলীরা

জ্যোতি একটি আলো ছড়ানোর উদ্যোগ। আমাদের দেশের শতকরা ৭০ ভাগ নারী স্বাস্থ্যসম্মত মাসিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে যেতে পারে না। মূল কারণ সচেতনতার অভাব। পিরিয়ডকে আমাদের দেশে এখনো একটি ট্যাবু হিসাবে দেখা হয়। সঠিক সচেতনতার অভাবে একটি বড় জনগোষ্ঠী পিরিয়ডকালে অপরিচ্ছন্ন কাপড় ব্যবহার করে। সঙ্গে রয়েছে স্যানিটারি প্যাডের উচ্চ মূল্য ও প্যাডের মূল্য সম্পর্কে সঠিক ধারনার অভাব। যে সকল জায়গায় প্যাড পাওয়া যায় সেখানে নেই নারীদেরই সহজ অ্যাক্সেস। এমনকি নারীর স্যানিটারি প্যাড কেনার সিদ্ধান্তও সে নিজে নিতে পারে না। এত প্রতিবন্ধকতা নারীকে রাখছে অন্ধকারে। এই কুসংস্কার, অসহজলভ্যতা, প্রতিবন্ধকতার অন্ধকার দূর করে আলো ছড়ানোর চেষ্টা করে চলছে ‘জ্যোতি’। পিরিয়ড পণ্য নারীর কাছে সহজলভ্য এবং সুলভ করাই জ্যোতির উদ্দেশ্য। এ জন্য নারীদের সংখ্যা বেশি এমন স্থানগুলোতে জ্যোতি স্থাপন করছে সহজে, ট্যাবুহীনভাবে এবং সুলভে কিনতে পারে এমন স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন!  

জ্যোতি উদ্যোগের মূলে আছেন তড়িৎ ও বৈদ্যুতিন প্রকৌশলী রেজওয়ান আহমেদ নূর শাব্বিন।

তার সঙ্গে রয়েছে আরও দুজন প্রকৌশলী, মানিক এবং রিজভি। প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে মানুষের সমস্যা সমাধান করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে তারা গড়ে তোলেন ‘ভার্টিক্যাল ইনোভেশন্স লিমিটেড’। রেজওয়ান আহমেদ নূর শাব্বিন প্রকৌশলের ছাত্র হলেও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার আগ্রহ থেকে বর্তমানে জনস্বাস্থ্যের উপর পড়াশোনা করছেন। তার গবেষণার ক্ষেত্র SRHR (Sexual and reproductive health and rights)। জ্যোতি নিয়ে তার প্রথম ভাবনাটা ছিল ঠিক এমন–‘মেয়েদের পিরিয়ড ব্যাবস্থাপনায় পরিচ্ছন্ন কাপড়, রিইউজেবল প্যাড, কম দামি প্যাড, কাপ নিয়ে অনেক কাজ হলেও সঠিক বিপণন ব্যবস্থা নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ এখনো হয়নি। কিভাবে পিরিয়ড সামগ্রী সহজভাবে বিপণন করা যায় তা থেকেই আমার এই উদ্যোগ। আমার দু’টি মেয়ে আছে। তাদের পিরিয়ড প্রোডাক্ট আমি কিনে আনি। আমার মনে হয়েছে এমন কিছু একটা তৈরি করবো যাতে তারা তাদের নিজেদের প্রয়োজন নিজেরাই মেটাতে পারবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এক উপেক্ষিত নাম পিরিয়ড। বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে সবথেকে বেশি যে STI (Sexually Transmitted Infections) দেখা যায় তা হলো ‘Trichomoniasis’। আর সঠিক মাসিক হাইজিন মেইন্টেন করতে পারলে এর থেকে সহজেই পরিত্রাণ পাওয়া যায়। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ায় টেকনোলজির  মাধ্যমেই এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছি আমরা।’

এখন পর্যন্ত মোট ২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্যোতি পরিসেবা দিচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন আছে, তেমনি রয়েছে রংপুর, গাজীপুরের গ্রাম পর্যায়ের স্কুলও।

'জ্যোতি আসলে কী ধরণের স্বপ্ন দেখে?' এমন প্রশ্নের উত্তরে শাব্বিন জানিয়েছেন, তারা অন্তত ১ বছর সারাদেশের মেয়েদের কাছে অর্ধেক মুল্যে প্যাড পৌঁছানর ব্যবস্থা করতে চান। অন্তত ১ লক্ষ জ্যোতি মেশিন বাংলাদেশের আনাচে কানাচে স্থাপন করতে চান।

image2

প্যাডম্যান সিনেমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে না? সিনেমাটিতে অক্ষয় কুমারেরও ছিল এমন এক লক্ষ্য–সুলভ মূল্যে নারীদের কাছে স্যানিটারি প্যাড পৌঁছে দেওয়া। তবে সিনেমার নায়ককে যেমন পার করতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতা, তেমনি জ্যোতিকেও পড়তে হয়েছে নানা ঝামেলায়। সামাজিক কুসংস্কার একটা বড় সমস্যা। অনেকেই পিরিয়ডের গুরুত্ব বুঝতে চায় না। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের একটি বড় অংশ পুরুষ হওয়ায় তারা ব্যাপারটিতে গুরুত্ব কম দেন এবং তাদের চক্ষুলজ্জার কারণে এ নিয়ে আলোচনাও হয় কম। স্কুল কলেজের কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই সরাসরি মেয়েদের কাছে ভেন্ডিং মেশিনের পাঞ্চকার্ড দিতে চান না, বিতরণ রাখতে চান নিজেদের দায়িত্বে। তবে স্কুলের মেয়েরা প্রযুক্তির সঙ্গে খুব দ্রুত খাপ খাওয়াতে পারে। অনেক স্কুলে মেয়েরা নিজেরাই জানে কিভাবে মেশিন থেকে প্যাড নিতে হয়, জ্যোতির দলকে শেখানোর প্রয়োজন হয় না।

জ্যোতির দলের প্রসঙ্গ এলে শাব্বিনের পাশাপাশি বলতে হবে দিনার কথা, যে কিনা রেডিও-টিভির তালিকাভুক্ত কণ্ঠশিল্পী হয়েও শুধুমাত্র নিজস্ব ভালো লাগা থেকে জ্যোতি নিয়ে কাজ করে চলছেন। জ্যোতির সফটওয়্যার দলের দায়িত্বে রয়েছেন প্রিয়া। জ্যোতির হয়ে আরও কাজ করছেন সজিব, রিফাত, রাইসুল, স্বর্ণা, আমিরুল, মুসা, আলম এবং রুবেল। সবাই মিলেই তারা জ্যোতি পরিবার। তারা আমাদের বাংলাদেশের এক অন্যরকম প্যাডম্যান টিম! জ্যোতি টিমের উদ্দেশ্য একদিন জ্যোতি বদলে দেবে বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক অবস্থান।

সবশেষে eআরকির eআরকি মূলক প্রশ্ন ছিলো, ‘স্মার্ট স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন স্থাপনের জন্য সরকার যদি আজ জ্যোতির ৫ সদস্যের দলকে বিদেশে পাঠায় তবে আপনারা কোন দেশটি বেছে নেবেন?’   

তাদের উত্তর ছিল, ভারত। কারণ একই সমস্যা সেখানও বিদ্যমান এবং জনসংখ্যাটা আমাদের ৭ গুণ! তাই সেখান থেকে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা হবে আমাদের। যেটা আমাদের দেশে এই সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে।

আমাদেরও আশা জ্যোতি একদিন দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের জ্যোতি ছড়াক। 

৯১২ পঠিত ... ১৭:১৪, এপ্রিল ০৬, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top