শিবরাত্রি কিংবা হিন্দু চান্দ্রমাসের রোম্যান্টিক অরিজিন 

৮৪৫ পঠিত ... ১৮:০২, মার্চ ০১, ২০২২

Shibratri

[মহাশিবরাত্রি ১ মার্চ, ২০২২] 

মহাশিবরাত্রি বা শিবরাত্রি হিন্দু শৈব সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। এই মহাশিবরাত্রি ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয়। মহাশিবরাত্রি হল হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবাদিদেব মহাদেব ‘শিবের মহা রাত্রি’। অন্ধকার আর অজ্ঞতা দূর করার জন্য এই ব্রত পালিত হয়। অগণিত ভক্ত এইদিন শিবলিঙ্গে গঙ্গাজল, দুধ, বেলপাতা, ফুল দিয়ে পূজা করে থাকে।  

শিবরাত্রির উৎপত্তি বিষয়ে অনেকগুলো বয়ান ও কাহিনী প্রচলিত আছে। 

'এর মধ্যে কোনটা সঠিক বয়ান?'- এমন প্রশ্ন করলে আপনি আসলে কনটেক্সট মিস করতেছেন। প্রশ্নটাই ভুল।  

সত্যি বা ট্রুথ অনেক রকম। সাব্জেক্টিভ, অবজেক্টিভ, কালেক্টিভ, কালচারাল ট্রুথ৷ অবজেক্টিভ ট্রুথ- বিজ্ঞান যেমনটা প্রস্তাব করে- মিথলজি ও ধর্মীয় সত্যি থেকে আলাদা। বিজ্ঞান মূলত 'কীভাবে?' প্রশ্নে বেশি আগ্রহী।  

মিথলজি বা ধর্ম, বেশি আগ্রহী 'কেন?' প্রশ্নে। যা জ্ঞান ও উপলব্ধির দুইটা ভিন্ন ডোমেইনে কাজ করে। মিথের সত্যির সঙ্গে তাই ফ্যাক্ট বা অব্জেক্টিভ ট্রুথের তুলনা চলে না। 

প্রাচীন ভারতের গল্প/কাহিনীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়: 

১. ইতিহাস 

২. পুরাণ 

'ইতিহাস' মানে যে গল্পগুলা কাহিনীকার নিজে 'দেখছেন'।  ইতি হাস ( ইতি= আসলেই, হাস= ঘটছে)। ইতিহাস মানে যা আসলেই ঘটছে। 

অন্যদিকে, পুরান বা মিথ বলতে বোঝায় দেব দেবী, রাজা-রাজরা আর ঋষিদের গল্প যা কাহিনীকার অন্যদের ( পুরাণ= পুরোনো) কাছ থেকে জাস্ট শুনছে। 

ফ্যাক্ট হইতেছে সকলের সত্যি। ফিকশন কারও সত্যি না। মিথ হইতেছে কারও কারও সত্যি। মিথ  সাংস্কৃতিক সত্যি, ধর্মীয় সত্যি, কোনো জাতির সত্যি, এমন সত্যি যা একটা কমন ওয়ার্ল্ডভিউ দিয়া কমিউনিটির মধ্যে সম্পর্ক/বন্ড তৈরি করে। 

ফলে, শিবরাত্রির কোন বয়ান বা বিশ্বাস সঠিক এই প্রশ্নটাই অপ্রাসঙ্গিক। আমি বরং বলতে পারি কোন বয়ানটা আমার পছন্দের। শুরুতে শিবরাত্রির উৎপত্তি বিষয়ক প্রচলিত বিশ্বাস ও কিংবদন্তীগুলো সংক্ষেপে বলে নিই।  

একটা কিংবদন্তী অনুযায়ী, সমুদ্র মন্থন করে বিষ পান করে দুনিয়ারে এই দিনেই বাচাইছেন শিব। এই বিষ শিবের গলায় জমা হয় এবং গলা (কণ্ঠ) নীলবর্ণ ধারণ করে। এ কারণে মহাদেব শিবের আরেক নাম নীলকণ্ঠ। 

শিবপুরাণ মতে, তিন প্রধান হিন্দু দেবতার দুইজন- ব্রহ্মা আর বিষ্ণু- নিজেদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় লড়াই করতেছিলেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও অর্থহীন মারামারি দেখে, অন্য দেবতারা শিবরে হস্তক্ষেপ করতে অনুরোধ করলো। 

শিব তখন ব্রহ্মা আর বিষ্ণুর মাঝখানে বিশাল অগ্নিস্তম্ভের রূপ ধারণ করে আবির্ভুত হইলেন। ব্রহ্মা আর বিষ্ণূ, সেই অগ্নি স্তম্ভের চুড়া খুঁজে পেতে চেষ্টা করলেন। ব্রহ্মা হংসীরূপ ধারণ করে উড়াল দিলেন এবং বিষ্ণু বরাহরূপ ধরে পাতালে গেলো। শিবের অগ্নিস্তম্ভের আলো যেহেতু অন্তহীন, ব্রহ্মা বা বিষ্ণু কেউই সেই অগ্নিস্তম্ভের উচ্চসীমায় পৌঁছাতে পারেন নাই। এবং তারা পরস্পরকে ধ্বংসও করতে পারেন নাই। মহাদেব শিবের কারণে এভাবে পৃথিবী রক্ষা পায়। 

আরও একটা বিশ্বাস মতে, দেবী পার্বতী পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে অনুরোধ করেন। মহাদেব শিব পৃথিবীকে রক্ষা করতে রাজি হন, তবে একটা শর্তে, দুনিয়াবাসী তাকে গভীর আবেগে ও ভালোবাসায় পূজা করবে। ওই দিনটাকে মহাশিবরাত্রি বলে। বিশ্বাস করা হয় যে, মহাশিবরাত্রিতেই ফুল ফোটে, যা পৃথিবীর উর্বরতার রূপক।    

এক কিংবদন্তী অনুসারে এই রাত্রেই শিব সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের নৃত্য করেছিলেন। এই নৃত্যের নাম তাণ্ডব নৃত্য। নটরাজ- নৃত্যের সর্বোচ্চ দেবতা- আসলে শিবেরই আরেক রূপ। শিবের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়ে ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পীরা, শিবের দুই নৃত্য 'তাণ্ডব' আর 'লাস্য' পার্ফম করেন। আবার এইরাত্রেই শিব ও পার্বতীর বিবাহ হয় অর্থাৎ শিবরাত্রিতে শিব ও শক্তির একাকার হয়ে যাওয়া উদযাপন করা হয়।     

শিবমহাপুরাণ মতে, পুরাকালে বারাণসী তথা কাশীধামে এক নিষ্ঠুর ব্যাধ বাস করতেন। তিনি প্রচুর পরিমাণে জীবহত্যা করতেন। একদিন জঙ্গলে শিকার করতে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেন এবং কোন উপায়ান্তর না পেয়ে হিংস্র জীবজন্তুর ভয়ে রাতে বেল গাছে আশ্রয় নেন । কোনো শিকার না পেয়ে ব্যাধ হতাশ হয়ে বেলগাছ থেকে একটা করে পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলতে থাকেন। আর সেই বেলপাতা গাছের নিচেয় থাকা শিবলিঙ্গের উপর পড়তেছিল। সেদিন ছিল শিব চতুর্দশী অর্থাৎ মহাশিবরাত্রি এবং সেই শিকারী ছিলেন উপবাসী। ফলে তার ফেলে দেওয়া বেলপাতাগুলো শিবলিঙ্গের মাথায় পড়ে অজান্তেই শিবচতুর্দশী ব্রতের ফল লাভ হয় । পরদিন তিনি বাড়ী ফিরে এসে তার খাবার এক অতিথিকে দিয়ে দেন। এতে তার ব্রত পালনের ফল লাভ হয়।  

এর কিছুদিন পরে সেই ব্যাধ মারা গেলে যমদূতরা তাকে নিতে আসেন। কিন্তু শিবচতুর্দশী ব্রতের ফল লাভ হেতু শিবদূতরা এসে যুদ্ধ করে যমদূতদের হারিয়ে ব্যাধকে নিয়ে যান। যমরাজ  মেনে নিতে বাধ্য হন যে শিবভক্ত শিবচতুর্দশী ব্রত পালন করেন তার উপর যমের কোনো অধিকার থাকে না। ফলে ব্যাধ মুক্তিলাভ করেন। এইভাবে মর্ত্যলোকে শিবচতুর্দশী ব্রতের প্রচার ঘটে। 

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শিবরাত্রি উদযাপনের উৎপত্তির একটা কাহিনী আমার বেশি পছন্দের। বলা যায় কিছুমাত্রায় রোম্যান্টিকও। এই কাহিনী চান্দ্রবর্ষ বা লুনার ক্যালেন্ডারেরও পৌরাণিক ব্যাখ্যা।   

কাহিনীটা মোটামুটি এমন: 

দক্ষরূপে ব্রহ্মার  সাতাশ জন কন্যা ছিলো। তাদেরকে বলা হইতো নক্ষত্র। দক্ষ তার সাতাশ কন্যাকে বিয়া দিলেন চাঁদের দেবতা অর্থাৎ চন্দ্রের সাথে।    

কিন্তু চন্দ্র তো প্রেমে একগামী। চন্দ্র তার স্ত্রীদের মধ্যে রোহিনী নামের মাত্র নক্ষত্ররে ভালোবাসে। সবটা সময় রোহিনীর সাথেই কাটায়। বাকি স্ত্রীরা- বাকি নক্ষত্রেরা- দক্ষের কাছে অভিযোগ করলেন।  

কন্যা অন্তপ্রাণ দক্ষ চন্দ্ররে বললেন সব স্ত্রীরে সমান ভালবাসতে।  

চন্দ্র প্রেমিকসুলভ বললো, সম্ভব না। হৃদয় তো নিয়ম-কানুন দিয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। 

ক্ষুব্ধ দক্ষ চন্দ্ররে অভিশাপ দিলেন। পুরাকালের  মুনি-ঋষিদের অভিশাপ ছিলো ভয়ংকর। ডাইরেক্ট অ্যাকশন টাইপ ব্যাপার। দিনে দিনে চন্দ্র ক্ষীণজ্যোতি ও দূর্বল হয়া যাইতে শুরু করলো। ছোট হইতে হইতে যখন বিলীন হয়া যাবে এমন সময় কেউ কেউ তারে শিবের কাছে প্রার্থনা করতে পরামর্শ দিলো। 

হিন্দু পুরাণে শিব হইলেন বিগ বস টাইপের চরিত্র। অকল্পনীয় শক্তিধর, রাগী কিন্তু অসীম তার ক্ষমতা। একমাত্র শিবেরই আছে সঞ্জীবনী বিদ্যা অর্থাৎ পুনরুজ্জীবন লাভের বিজ্ঞান। শিব আগেও অসুরদের সঞ্জীবনী দিছিলেন। এ কারণে দেবতারা যতই অসুরবধ করুক না কেন, অসুরেরা পুনরুজ্জীবন পায়।  

নিরুপায় চন্দ্র যথারীতি প্রার্থনা করলো শিবের কাছে। প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব তার কপালে চন্দ্ররে স্থান দিলো। শিবের কপাল চন্দ্ররে আবার আকারে বড় হইতে দিল। সেই থেকে শিবের আরেক নাম চন্দ্রশেখর, যার কপাল ক্ষয়ীষ্ণু চিকন চন্দ্রকলায় (ক্রিসেন্ট) শোভিত।   

চন্দ্রের আরেক নাম সোম, যার অর্থ পুনরুজ্জীবনী পানীয়। শিব যেহেতু এই জিনিস চন্দ্ররে দিছেন, শিবের আরেক নাম তাই সোমনাথ। 

চন্দ্রের আকারে বৃদ্ধি হওয়া আর আমাদের জীবনে পুনরুজ্জীবনের স্মারক হিসেবে, চাদের ১৪তম দিনে শিবের পূজা করা হয়। এই রাতই শিবরাত্রি। শিবরাত্রির মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মহাশিবরাত্রি, যা পড়ে বসন্তের শুরুর দিকে৷   

চন্দ্র, প্রতি রাতে এক স্ত্রী থেকে অন্য স্ত্রীর কাছে যায় চন্দ্র আকারে ও জ্যোতিতে বাড়তে থাকে যখন তার প্রিয়তম স্ত্রী রোহিনীর কাছে যাইতে থাকে। আর ক্ষীনজ্যোতি হইতে থাকে যখন রোহিনীর থেকে দূরে সরে যায়৷   

রোহিনীর সঙ্গে থাকা রাত্রিতে চন্দ্র হয় উজ্জ্বলতম। এই রাত পূর্নিমা। আর অমাবশ্যায় চন্দ্র থাকে রোহিনী থেকে সবচাইতে দূরে।  

এইভাবে হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, চন্দ্রের এই জ্যোতির্ময় আর ক্ষীণজ্যোতি হওয়া রোমান্টিক মুড ও উর্বরতার মেটাফোর। 

 

৮৪৫ পঠিত ... ১৮:০২, মার্চ ০১, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top