লালন সাঁই সম্পর্কে যেসব তথ্য আপনি নাও জানতে পারেন

২৭৬৭ পঠিত ... ১৪:৩৭, অক্টোবর ১৪, ২০২০

লালন শাহ, যিনি লালন ফকির বা লালন সাঁই নামেও পরিচিত, তিনি মৃত্যুর ১২৯ বছর পর আজও বেঁচে আছেন তাঁর গানের মাঝে। তাঁর লেখা গানের কোন পাণ্ডুলিপি ছিল না, কিন্তু গ্রাম বাংলায় আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তাঁর রচিত গান ছড়িয়ে পড়ে লোকের মুখে মুখে। 

ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লালনের জীবনি নিয়ে 'মনের মানুষ' উপন্যাস লিখেছিলেন বটে, কিন্তু তিনিই সেটিকে ঐতিহাসিক দলিল বলতে নারাজ। লালনের জীবন সম্পর্কে এতোই কম জানতে পারা যায়, সেটা সত্যি মিথ্যার কষ্টি-পাথরে মেপে আনা খুবই দুঃসাধ্য। এই যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর দেখা হবার ঘটনা। লালন ঠাকুরের জীবন নিয়ে এমনই কিছু তথ্য তুলে আনা হলো eআরকির পাঠকদের জন্য।  

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও লালন সাঁইয়ের কি দেখা হয়েছিলো?

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও লালন সাঁইজির মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে কি না, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত রহস্যই রয়ে গেছে। পক্ষে-বিপক্ষে উভয় মতই প্রচলিত রয়েছে। কারও ধারণা, দুজনের সাক্ষাৎ হয়েছে। অন্যপক্ষের মত, দেখা হওয়ার সপক্ষে প্রামাণ্য কোনো দলিল-দস্তাবেজ নেই। তবে লালন গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর এক বইতে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের দেখা হয়েছে কি না এ নিয়ে লালনের প্রথম জীবনী লেখক বসন্তকুমার পাল রবীন্দ্রনাথকে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন লালনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কি না। তখন রবীন্দ্রনাথ চিঠির উত্তরে বলেছিলেন, `তিনি ফকির সাহেবকে জানতেন। কিন্তু সেই স্মৃতি ধূসর।’

 

‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে’

লালন হিন্দু না মুসলমান ছিলেন, এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কম তর্ক-বিতর্ক হয়নি। এখনো সেটি চলছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন-জীবনীকার বসন্তকুমার পাল, গবেষক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, অন্নদাশঙ্কর রায় প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা এই বাউল কবিকে হিন্দু পরিবারের সন্তান বলেই উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে, কবি জসীমউদ্‌দীন, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন প্রমুখ লেখকেরা লালনকে ‘ধর্মান্তরিত মুসলমান’ বলে মতামত দিয়েছেন। তবে মজার বিষয় হলো, নিজের একটি গানে লালন লিখেছেন, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ লালন কয় জেতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।’ লালনের মৃত্যুর পর, ১৮৯০ সালের ৩১ অক্টোবর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে, ‘লালন নিজে কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না; অথচ সকল ধর্মের লোকেই তাঁহাকে আপন বলিয়া জানিত।’

 

লালন সাঁইয়ের পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রভারতীতে ১৮৮৯ সালের ৫ মে শিলাইদহে বোটের উপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালনের যে পেনসিল স্কেচটি রয়েছে, তাতে লালন ন্যুব্জ। অসম্পূর্ণ হলেও, সেটিই একমাত্র লালনের পার্থিব অবয়ব। ছবির উপর লেখা ‘লালন ফকির। শিলাইদহ বোটের উপর।‘ গবেষকদের অনুমান, এ ছবি লালনের মৃত্যুর এক বছর আগে আঁকা। নন্দলালও এক সময় এই স্কেচটি দেখে লালনকে এঁকেছিলেন। তবে নন্দলালের লালন-এর খাড়া নাক। মাথার চুল বাঁধা।

‘হিতকরী’-র নিবন্ধকার স্বচক্ষে দেখেছিলেন লালন ফকিরকে। তাঁর লালন একটু অন্য।

বাবরি চুল, একটি চক্ষু দৃষ্টিহীন। মুখে বসন্তের দাগ।

 

‘ওরে, আমার পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে’

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় নিজের আখড়ায় শিষ্য-পার্শ্বচরদের নিয়ে জীবন যাপন করতেন লালন। ‘অধর মানুষ’-এর সন্ধানে সাধনপথে তাঁর ছিল নিরন্তর পথচলা। বিষয়াসক্তি কিংবা জাগতিক সমস্ত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি। যখন মনের ভাব প্রবল বেগে জেগে উঠত, তখনই কেবল তিনি শিষ্যদের ডেকে বলতেন, ‘ওরে, আমার পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে’। অর্থাৎ তাঁর ভেতরে গানের পঙ্‌ক্তি ঘুরপাক করছে। এ কথা শোনামাত্রই সাঁইজির আশপাশে ছুটে আসতেন শিষ্যরা। লালন তখন ভাবের আবেশে গান ধরতেন। শিষ্যরাও লালনের সঙ্গে তাল মেলাতেন। সময়-অসময়ে তাঁর এমন ‘পোনা মাছের ঝাঁক’  আসত।

 

লালন সাঁইয়ের গানের খাতা সযত্নে ছিলো রবীন্দ্রনাথের কাছেই

লালনের সাথে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল কি না, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। নিশ্চিত কোনো খবর এ বিষয়ে পাওয়া যায় না। তবে লালনের শিষ্যদের অনেকের সঙ্গে যে রবীন্দ্রনাথের অনেকবার দেখা ও কথা হয়েছে, সে বিষয়ে অনেক ঐতিহাসিক দলিল রয়েছে। শিলাইদহে অবস্থানকালে তিনি লালনের গান সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। জানা যায়, ছেউড়িয়ার আখড়া থেকে লালনের গানের খাতা আনিয়ে ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারী বামাচরণ ভট্টাচার্যকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ২৯৮টি গান নকল করিয়ে নেন। এই খাতা সম্পর্কে সনৎকুমার মিত্র বলেছেন-

‘...রবীন্দ্র ভবনের খাতা দুটিই ছেউড়িয়ার আশ্রমের আসল খাতা এবং যেভাবেই হোক তা রবিবাবুর হাতে পৌঁছানোর পর আর আখড়ায় ফিরে আসেনি।‘

লালনগীতির সংগ্রাহক মতিলাল দাশকে লালন শিষ্য ভোলাই শাহ বলেছিলেন-

‘দেখুন, রবিঠাকুর আমার গুরুর গান খুব ভালোবাসিতেন, আমাদের খাতা তিনি নিয়া গিয়াছেন, সে খাতা আর পাই নাই, কলিকাতা ও বোলপুরে চিঠি দিয়াও কোনো উত্তর পাই নাই।‘

কবিগুরুর জগতে লালন যে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তা বুঝতে এর বেশি জানার প্রয়োজন পড়ে না।

 

‘আমি চলিলাম’

লালন সাঁই জীবিত ছিলেন ১১৬ বছর বয়স পর্যন্ত। শেষ বয়সেও ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করতেন। মারা যাওয়ার এক মাস আগে তাঁর পেটের পীড়া হয়। তখন পানি জমে হাত-পা ফুলে যায় তাঁর। সে সময় দুধ ছাড়া তিনি অন্য কোনো খাবার খেতেন না। তবে খাবারের পাতে মাঝেমধ্যে মাছ চাইতেন। অসুস্থাবস্থায়ও শিষ্য-ভক্তদের নিয়ে গানের আসর বসাতেন। সে সময়টাতে বেশ কিছু গানও রচনা করেছেন লালন। মৃত্যুর আগের দিন ভোররাত পর্যন্ত গান শুনেছেন। এরপর ভোর পাঁচটার দিকে শিষ্যদের ডেকে বলেছেন, ‘আমি চলিলাম।’ এর কিছুক্ষণ পরই মারা যান লালন।

২৭৬৭ পঠিত ... ১৪:৩৭, অক্টোবর ১৪, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top