শৈশবের প্রিয় কার্টুন 'মীনা' সম্পর্কে আপনি যা নাও জানতে পারেন

৩০৭৩ পঠিত ... ২১:২৪, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০

ছোটবেলায় মীনা কার্টুন আমরা কমবেশি সবাই দেখেছি। মীনার তুমুল জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করে সার্কভুক্ত দেশগুলো ১৯৯৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরকে মীনা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। সময়ের কাঁটা ঘুরে আজ আবার এলো ২৪ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব মীনা দিবস। চলুন, মীনা ও মিঠু-রাজুদের নিয়ে জেনে নেই কিছু অজানা তথ্য।

 

শুরুর পথচলা

১৯৯০-এর দশকে উপমহাদেশের মেয়েদের অধিকার সুংসহত করার লক্ষ্য মীনা কার্টুন প্রচারের উদ্যোগ নেয় ইউনিসেফ। সেজন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা। কিন্তু মেয়ে শিশুর অধিকারের ব্যাপারে কীভাবে সচেতন করা যায় এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীকে?

বাংলাদেশের চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার তখন বিটিভিতে ‘মনের কথা’ নামে একটি পাপেট শো করতেন। সেখানে ‘পারুল’ নামে এক বিখ্যাত মেয়ে চরিত্র বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেখান থেকেই কিছু আইডিয়া পায় ইউনিসেফ।

খ্যাতনামা কার্টুনিস্ট রাম মোহন ইউনিসেফের সহযোগিতায় মিনা কার্টুনের প্রথম অ্যানিমেশন করেন ১৯৯১ সালে। এরপর ১৬টি এপিসোড তৈরি করেন তিনি। এই ১৬টি এপিসোডের কার্যকাল ছিল ২০০১ সাল পর্যন্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁর এই কার্টুন বেশ সাড়া জাগায়। বাংলাদেশ কমিকস এর মাধ্যমে বিটিভিতে কার্টুনটি প্রচারিত হয়। এই পর্বগুলো রাম মোহনকে সাজাতে সাহায্য করে ইউনিসেফ, হান্না-বারবারা কার্টুনস এবং টুনবাংলা।

ফিলিপাইনের ম্যানিলাতে অবস্থিত হান্না-বারবারা স্টুডিওতেও মীনার প্রথম দিককার বেশ কিছু পর্ব নির্মিত হয়। পরে ভারতের রাম মোহন স্টুডিওতে মীনার বাকি পর্বগুলো নির্মাণ করা হয়। সিরিজগুলো পরিচালনা করেছিলেন রাম মোহন নিজেই।

 

মীনার নামকরণ

দক্ষিণ এশীয় সবগুলো দেশেই প্রচারিত হবে, তাই কেন্দ্রীয় চরিত্রটির এমন একটি জুতসই নাম হওয়া দরকার, যেন নাম শুনে প্রত্যেকটি দেশ মেয়েটিকে নিজেদেরই দেশের প্রতিনিধি বলেই মনে করতে পারে।

কিন্তু এমন নাম খুঁজে পাওয়া খুব সহজ ছিলো না। কারণ, সার্কভুক্ত সবকটি দেশেই (সে সময় ছিল ৭টি দেশ) নামটির গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে মেয়েটির নাম রাখা হলো ‘মীনা’। কারণ, ভারত-বাংলাদেশ-শ্রীলংকায় এই ধরনের নাম (যেমন- মীনাক্ষী, মীনা কুমারি) বেশ প্রচলিত। আবার, শোনা যায়, মীনা নামটির সাথে ‘আমিনা’ নামের কিছুটা সাদৃশ্য থাকায় মুসলিম দেশগুলোও, বিশেষত পাকিস্তান, এই নামে আপত্তি করেনি। অবশেষে সব দেশের অনুমোদন সাপেক্ষে চূড়ান্ত হয় ‘মীনা’ নামটি। উল্লেখ্য, সিন্ধী ভাষায় 'মীনা' শব্দটির অর্থ 'আলো'।

 

মীনার পোশাক

মীনার পোশাকে গ্রহণযোগ্যতা আনার জন্য রাম মোহন বাবু মীনার হরেক রকম স্কেচ আঁকতে থাকেন। কোনোটাতে মীনাকে সালওয়ার কামিজ, কোনোটাতে লেহেংগার (স্কার্ট) সাথে ব্লাউজ, শার্ট কিংবা ওড়না ইত্যাদি ছবি এঁকে তিনি মানুষের কাছে যেতেন এবং তাদের মতামত নিতেন। অবশেষে, মীনার লং-স্কার্টের পোশাকটিই চূড়ান্ত করা হয়।


কিভাবে এলো মিঠুর ধারণা?

কার্টুনটিকে একটু মজার, একটু রসাত্মক করে তুলবার জন্যই কোনো একটি প্রাণীর চরিত্র রাখার কথা বিবেচনা করা হয়। প্রস্তাব করা হয়, মীনা কার্টুনে মীনার পছন্দের পোষা প্রাণী হিসেবে থাকবে একটি বানর।

প্রস্তাবটি সব দেশে গ্রহণযোগ্য হলো, তবে বাধ সাধলো শ্রীলংকা। তারা বললো, বানরকে কৌতুক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না, কারণ, শ্রীলংকায় বানরকে ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানীয় বিবেচনা করা হয়। এ অবস্থায় ভারত প্রস্তাব দিলো, এই পোষা প্রাণী হিসেবে তোতাপাখি ব্যবহৃত হতে পারে। এরপরই আমরা দেখতে পেয়েছি দুষ্ট মিষ্টি কথা বলা মিঠুকে!

 

মূল সঙ্গীত

‘আমি বাবা মায়ের শত আদরের মেয়ে...’ অসম্ভব সুন্দর এই গানটি রচনা করেছেন প্রখ্যাত সঙ্গীতকার আরশাদ মাহমুদ এবং ফারুক কায়সার। আর গানে মিষ্টি কণ্ঠটি দিয়েছেন সুষমা শ্রেষ্ঠা। সুষমা সেই সত্তরের দশকের শুরু থেকে বিগত দশক পর্যন্ত দর্শক শ্রোতাদেরকে অসংখ্য কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন। এই গানটি পাকিস্তানে রচনা ও রেকর্ড করা হয়।

 

দেশে দেশে মীনা

মীনা কার্টুন শুধু বাংলা ভাষায় তৈরি হয়নি। হিন্দি, উর্দু, নেপালি, ইংরেজিসহ কমপক্ষে ২৯টি ভাষায় মীনা তৈরি হয়েছে। আরবিতেও মীনা কার্টুন ডাবিং করা হয়েছিলো। প্রথমে মীনার ১৩টি পর্ব বানানো হয়। প্রচার করা হয় সার্কভুক্ত সাতটি দেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে। এখন মীনার ৩৭টি পর্ব রয়েছে। মীনার কার্টুন ছবি নিয়ে ২৩টি কমিক বইও বের হয়েছে। এসব বই পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ের ওপর টেলিভিশন ও বেতারের জন্য স্পট তৈরি করা হয়।

 

বাংলাদেশে মীনা

বাংলাদেশে প্রথম ১৯৯৫ সালে বিটিভিতে মীনা কার্টুন দেখানো শুরু হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনে মীনা কার্টুন দেখানোর পাশাপাশি রেডিওতে প্রচারিত হয় মীনার অনুষ্ঠান। 'ইউনিসেফ' ও 'বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস' প্রথম রেডিওর জন্য মীনা সিরিজ তৈরি করে। ৬৮টি ভ্রাম্যমাণ ফিল্ম ইউনিটের মাধ্যমে মীনা পৌঁছে গেছে দেশের আনাচ-কানাচে।

মীনা চরিত্রের ভোকাল আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন 'প্রমিতা গাঙ্গুলি'। সেই সময়ের স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, 'তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি আমি। ২০০৫ সাল। মীনার কণ্ঠের জন্য অডিশন দিলাম। ভাবতে পারিনি, আমাকেই নির্বাচন করবে।খুব ভালো লেগেছিল আমার প্রিয় একটা চরিত্রে কণ্ঠ দিতে পারব ভেবে।'

তিনি আরও বললেন, খুব সম্ভবত আমার বলা প্রথম ডায়ালগটি ছিল—'ও রাজু ইশকুলে যাইবা না? ওহ্ মিঠু।'

একটা পর্যায়ে আমাকে সিলেক্ট করা হলো। কী যে খুশি হয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারব না।


রাজু ও মিঠু

রাজুর ভূমিকায় কণ্ঠ দিয়েছেন আবরার সাজিদ পাশা। বাবা-মা তাকে রোদ্দুর বলে ডাকেন।

প্রথম যখন অডিশনে রাজুর ভূমিকায় কণ্ঠ দেওয়ার সুযোগ পান আবরার, তখন পড়তেন প্রথম শ্রেণীতে। প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আবরার বলেন, 'রাজুর ভূমিকায় কণ্ঠ দিতে বেশ ভালো লাগে। বিভিন্ন পর্বে অনেক ভালো ভালো কথা বলে মানুষকে অনেক তথ্য জানাতে পারি।'

আর টিয়াপাখি মিঠুর সেই 'মধুর' কণ্ঠ দিয়েছেন কামাল আহসান। এক সাক্ষাৎকারে কবে থেকে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, 'আমি শুরু থেকেই মুস্তাফা মনোয়ার স্যারের সঙ্গে পাপেট শো করতাম। সেখানে বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠ দিতে হতো।'

তিনি আরও বললেন, '১৯৯৮ সালে সবেমাত্র ডিগ্রি পাস করেছি। আমাকে বলা হলো টিয়াপাখির মতো করে কণ্ঠ দিতে। আমি চেষ্টা করলাম। আর আমাকে নির্বাচনও করা হলো।'

টিয়া পাখির কণ্ঠ দিতে সমস্যা হয়েছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'যখন আমাকে টিয়াপাখির ভূমিকায় নেওয়া হলো, তখন থেকেই পাখিদের আচরণ দেখতে শুরু করলাম। পাখি কেমন করে বসে, কেমন করে খায়, কেমন করে ডানা ঝাপটায়—এগুলো পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম।'

 

কন্যাশিশু দশক

সার্কভুক্ত দেশগুলো যৌথভাবে ১৯৯০ দশককে ‘কন্যাশিশু দশক’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এই দেশগুলোতে সেসময় নারীদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। জীবনযাত্রার মান ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তাই ইউনিসেফ 'মীনা' কার্টুন প্রচারের উদ্যোগ নেয়, যা নারীশিশু অগ্রগতিতে শতভাগ সফল।

 

রাম মোহন

‘ফাদার অব ইন্ডিয়ান অ্যানিমেশন’-এর উপাধিপ্রাপ্ত রাম মোহন ১১ অক্টোবর, ২০১৯ সালে মুম্বাইয়ে মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।

৩০৭৩ পঠিত ... ২১:২৪, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top