তাজউদ্দীন আহমদের বিষ্ময়ভরা জীবনের ১৪টি ঘটনা

২১৪৭ পঠিত ... ১৬:২০, জুলাই ২৩, ২০২০

বাংলাদেশের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নাম তাজউদ্দীন আহমদ। সততা, মেধা আর কর্মদক্ষতার সবটুকু তিনি আমৃত্যু দিয়ে গেছেন দেশের জন্য। ক্ষুরধার এক নিভৃতচারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাকে ভয় পেত  স্বৈরাচারী সামরিক শাসকরা, আর তেমনি তার নীতির কাছে হার মানত হেনরি কিসিঞ্জারের মতো বাঘা বাঘা নেতারা। তিনি যাবতীয় আলোর ঝলকানি থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। তাজউদ্দীন আহমদকে বাংলাদেশের জন্য পরশপাথর বললেও অত্যুক্তি হবে না, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যার নেতৃত্ব ও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলে আমরা মাত্র নয় মাসে এই স্বাধীনতা পেয়েছি।

এই প্রচার বিমুখ নেতার বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন তাঁর আশেপাশের মানুষ, গুনী মানুষেরা। তারই একটা সংকলণ করেছিলেন অরিন্দম গুস্তাভো বিশ্বাস। eআরকির পাঠকদের জন্য এর মাঝে বাছাই করা কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো। আপনাদেরকে স্বাগতম তাজউদ্দীন আহমদের বিষ্ময়ভরা জীবনে।

  

১#

আব্বুকে ঘিরে আছে কত মানুষ। আব্বু মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছেন। এই শিশু দেশকে কিভাবে গড়ে তুলতে হবে, সে কথা বলছেন।

সমবেত মানুষের মধ্যে থেকে কয়েকজন আব্বুকে বলেছিলেন: আর চিন্তা কি, তাজউদ্দীন ভাইসাবের পোড়া ভিটায় নতুন বাড়ি উঠবে।

এই কথার উত্তরে আব্বু বললেন: যত দিন পর্যন্ত এই বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই না হবে, ততদিন এই ভিটায় বাড়ি উঠবে না (আজও সেখানে বাড়ি হয়নি)

আব্বু বললেন: মনে রেখ, আমি শুধু এই এলাকার মন্ত্রী না, আমি সমস্ত বাংলাদেশের। এখন তোমাদের দ্বায়িত্ব আগের চাইতে অনেক বেশী। কারন সমস্ত দেশের মানুষ তোমাদের কাপাসিয়ার এই মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমি স্বার্থপরের মত আমার এলাকার উন্নয়নের কাজে হাত দিতে পারি না। আমাকে সমস্ত দেশে সব কিছু সমানভাবে ভাগ করে দিতে হবে।

[আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ ― সিমিন হোসেন রিমি]

 

২#

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সময়ের পার্থক্য ছিল ৩০ মিনিট। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ভারতের মাটিতে থেকে কাজ করত, চলত ভারতের সময়ে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ কোনো দিন তাঁর হাতঘড়ির সময় পরিবর্তন করেননি, সেটি চলত বাংলাদেশের সময়ে।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি দানবেরা এই দেশের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। তখন আকাশে শকুন উড়ত, নদীর পানিতে ভেসে বেড়াত ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ, শুকনো মাটিতে দাউ দাউ করে জ্বলত আগুনের লেলিহান শিখা, বাতাস ভারী হয়ে থাকত স্বজনহারা মানুষের কান্নায়। শুধু বাংলাদেশের সময়টুকু তারা কেড়ে নিতে পারেনি। তাজউদ্দীন আহমদ পরম মমতায় সেই সময়টুকুকে তাঁর হাতঘড়িতে ধরে রেখেছিলেন।

ঘাতকের বুলেট তাজউদ্দীন আহমদের হৎস্পন্দনকে চিরদিনের জন্য থামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তাঁর হাতের ঘড়িতে ধরে রাখা বাংলাদেশের সময়টিকে কোনো দিন থামাতে পারবে না।

যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন তাজউদ্দীন আহমদের ঘড়ি আমাদের হূদয়ে টিকটিক করে চলতে থাকবে। চলতেই থাকবে।

[তাজউদ্দীন আহমদের হাতঘড়ি ― মুহম্মদ জাফর ইকবাল ]

 

৩#

হাসপাতালের বিছানায় বসে অপলক নেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিল একজন সৈনিক। হানাদার পশুদের একটি মর্টার শেল ওর দু'টি হাতকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'বল তুমি কি চাও?' ধীর, শান্ত অথচ ইস্পাত কঠিন কন্ঠে ও পাল্টা প্রশ্ন করল, 'পারবেন আমি যা চাই তা আমাকে দিতে'? প্রধানমন্ত্রী নির্বাক। ও বলল, 'স্যার, হৃদয়ের জ্বালা আমার থামেনি, আমি আবার যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চাই। প্লাষ্টিক সার্জারি করে আমার হাত দুটিকে ভাল করে দিন'। কয়েক মূহুর্তের জন্য আমরা সকলে স্থবির হয়ে গেলাম― মন ডেকে বলল, যে মাটি এমন বীর সন্তানকে জন্ম দিয়েছে সে মাটিতে হানাদার পশুদের কোন স্থান নেই।

[রণাঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী (মুক্তিযুদ্ধের সময় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর থেকে প্রকাশিত একটি প্রচার পুস্তিকা)]

 

বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন

 

৪#

এই ঘটনাটি তাঁর যে সচিব ছিল মতিউর রহমান, তার কাছ থেকে শোনা। উনি একদিন সকালে অফিসে এসে দেখে যে প্রধানমন্ত্রী নেই। তো ও খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের চত্বরে একটা আউটহাউজে তাজউদ্দীন সাহেবের পিয়ন থাকত। পিয়ন সকালবেলা আসেনি তাই উনি খুঁজতে গেছেন, গিয়ে দেখেন তার জ্বর। মতিউর রহমান গিয়ে দেখে, তাজউদ্দীন সাহেব বদনা দিয়ে পিয়নের মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছেন। এই হচ্ছে ওঁর মানবিক গুনের কথা।

― অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

[ তাজউদ্দীন আহমদঃ নিঃসঙ্গ সারথী ]

 

৫#

বাংলাদেশ তখনও বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়নি। ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারী ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ গেছেন দিল্লীতে। মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন ভূমিকার জন্য তাজউদ্দীন যে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা'কে ঠিক পছন্দ করেন না সেটা ভারত সরকার বেশ ভালভাবেই জানত। তাই তারাও সেই অনুষ্ঠানের আসন বিন্যাস এমনভাবে করেছে যে যেখানে ম্যাকনামারাকে বসিয়েছে ঠিক তার পাশেই তাজউদ্দীন আহমদের সিট। তাজউদ্দীন আহমদ একটা কথাও বললেন না, এমনকি ঘুরেও তাকালেন না। ম্যাকনামারা কয়েকবার উনার দিকে তাকালেন, ভাবটা এমন যে কথা বললে আমি এখনই কথা বলব।

এরপর ফেব্রুয়ারিতে ম্যাকনামারা আসবেন ঢাকায়। তাকে রিসিভ করতে তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুকে তো যেতে দিলেনই না, নিজেও গেলেন না, প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানকেও তিনি যেতে দিলেন না, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর'কে পাঠানোর ব্যাপারে তিনি সম্মত হলেন।

ম্যাকনামারা ঢাকায় আসার পর তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে মিটিং এ বসে জানতে চাইলেন বাংলাদেশের জন্য কোথায় কি ধরনের সাহায্য দরকার। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, 'আমাদের যা দরকার তা আপনি  দিতে পারবেন কিনা আমার সন্দেহ আছে'। ম্যাকনামারা বললেন, 'মিস্টার মিনিস্টার, আপনি বলুন, আমরা চেষ্টা করব দিতে'। তখন তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, 'মিস্টার ম্যাকনামারা, আমার গরু এবং দড়ি দরকার। যুদ্ধের সময় গরু সব হারিয়ে গেছে। এখানে ওখানে চলে গেছে, মরে গেছে। পাকিস্তান যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, চাষীরা সব এদিক সেদিক পালিয়ে গেছে, তখন গরু হারিয়ে গেছে। এখন যুদ্ধ শেষ, চাষী ফিরেছে কিন্তু গরু নাই, তাই চাষ করবে কীভাবে? কাজেই আমাদের অগ্রাধিকার চাহিদা হল গরু।' ম্যাকনামারার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, 'আর আমাদের সমস্ত দড়ি তো পাকিস্তানীরা নষ্ট করে ফেলেছে, এখন গরু পেলে গরু বাঁধতে দড়ি প্রয়োজন। গরু এবং দড়ি প্রয়োজন খুব তাড়াতাড়ি, না হলে সামনে জমিতে চাষ হবে না'। ম্যাকনামারার মুখ লাল হল বটে, কিন্তু পরে ফলাফল ভাল হয়েছিল।

তাজউদ্দীন আহমদ সাংঘাতিক দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি বুঝতেন আমরা বড় দেশকে কিছু করতে পারব না। সেই ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের আত্মসন্মানবোধ আছে, আমরা কারও দয়া চাই না, এই জিনিসটি তিনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, আর কোন উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না।

আরও পরে বিশ্বব্যাংকের একটি অফিসিয়াল ডিনারে তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম সাহেবকে ম্যাকনামারা বলেছিলেন, 'He is probably the best finance minister at present in the world'.

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা(প্রথম খণ্ড) থেকে আবু সাইদ চৌধুরী ও নূরুল ইসলাম এর সাক্ষাৎকার এবং 'তাজউদ্দীন আহমেদ:  নিঃসঙ্গ সারথি' তথ্যচিত্র ]

 

বঙ্গবন্ধু ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথে আলাপচারিতায়

 

৬#

স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত দূর্জয় সেনানীদের সাথে ব্যাক্তিগতভাবে আলাপ-আলোচনার পর বুড়িমারি স্কুলগৃহে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সাথে আগত অতিথিদের দুপুরের খাওয়া পরিবেশন করা হল। হঠাৎ উইং কমান্ডার বাসারকে ডেকে প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন-'আমাদের যোদ্ধারা খেয়েছে?' উত্তর এল―'ওরা মাটির মধ্যে খেতে বসেছে'। একটি মূহুর্ত মাত্র। দেখলাম প্রধানমন্ত্রী আস্তে করে উঠে চলে গেলেন। সমস্ত জিনিসটাই বুঝতে পারলাম যখন বাইরে এসে দেখি একটি টিনের থালায় খাবার হাতে নিয়ে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বসে প্রধানমন্ত্রী পরম তৃপ্তির সাথে আহার করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দুই পাশে উপবিষ্ট দু'জন মুক্তিযোদ্ধা সংকোচ ও জড়তায় খাবার কথা ভুলে অবাক নেত্রে চেয়েছিল। নিজের থালা থেকে দু'টি মাংসের টুকরা ওদের হাতে তুলে দিয়ে স্নিগ্ধ হাসি হেসে প্রত্যয়দৃঢ় কন্ঠে প্রধানমন্ত্রী বললেন- 'বাংলার সাড়ে সাত কোটি নর-নারীর প্রত্যেকেই আজ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তি ও স্বাধীনতার এই যুদ্ধে আমি, তুমি, সে আর তিনি সবাই সমান'।

[ রণাঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী (মুক্তিযুদ্ধের সময় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর থেকে প্রকাশিত একটি প্রচার পুস্তিকা) ]

 

৭#

শরৎ রচনাবলীর নতুন আটটি খণ্ড তখন বাজারে এসেছে। আমি আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে তার একটি খণ্ড নিয়ে এসেছিলাম পড়তে। কিন্তু সময়মত পড়ে আর শেষ করতে পারিনি। যে দিন বইটি ফিরিয়ে দেব সেদিন গাড়িতে বসেই তাড়াহুড়া করে পড়ছিলাম। আমি স্কুলে নেমে যাবার আগে আব্বু বললেন: কী বই এটা?

আমি বললাম:  শরৎ রচনাবলী।

আব্বু বললেন: এইভাবে বই পড়ে কি কিছু বোঝা যায়?

স্কুল ছুটির পর আমি মিমিকে জুনিয়র সেকশনে ডাকতে গিয়ে দেখি আমাদের ড্রাইভার সাহেব এদিকের গেটেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই বললেনঃ তাড়াতাড়ি আসেন, সাহেব অনেকক্ষণ ধরে এই গরমে গাড়িতে বসে আছেন। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি, আব্বু ঘেমে ভিজে গেছেন। মুখে স্বভাবসুলভ এক টুকরো হাসি, পাশে অনেকগুলা বই। শরৎ রচনাবলীর আটটি খণ্ড। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করব। বোবার মত বাসায় ফিরেছি। খুশিতে কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছিল।

[ আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ ― সিমিন হোসেন রিমি ]

 পরিবারের সাথে

৮#

তাঁর (তাজউদ্দীন আহমদ) সীমাবদ্ধতা বোধহয় একটা ছিল:  তিনি হঠাৎ কখনও সারক্যাস্টিক মন্তব্য করে ফেলতেন। যেমন, একটি ঘটনার উল্লেখ করতে পারি। একবার বাংলাদেশের কোন একটি অঞ্চল থেকে  দলীয় কিছু লোকজন এসে তাজউদ্দীন সাহেবের সাহেবের সাথে দেখা করলেন। তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন অভাব-অভিযোগের কথা বলে নানা রকম কিছু দাবী করছিলেন এবং বলছিলেন, সহায়-সম্পত্তি পরিবার-পরিজন সব তাঁরা দেশে ফেলে এসেছেন। তাজউদ্দীন সাহেব বলে ফেললেন, 'সব কিছু ফেলে এসেছেন সত্যি, কিন্তু স্বভাবটা তো ফেলে আসেননি, সাথে করে নিয়ে এসেছেন'। অবশ্য আমার মনে হয়, যে প্রচণ্ড  ধরনের চাপের মধ্যে তিনি থাকতেন এবং আমাদের কিছু মানুষের চরিত্র যে ধরনের তাতে তিনি কেন আমিও চটে যেতাম।

― এ. কে. খন্দকার

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খণ্ড) ]

 

৯#

মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস তিনি পরিবারের সাথে বসবাস করেননি। এমনকি ছেলের কঠিন অসুখের সময় বাসায় যেতে অনুরোধ করলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'আপনারা যদি এইসব আলাপ করতে আসেন তাহলে তো দেশ স্বাধীন করে ফিরে যাওয়ার দরকার নাই। সোহেলকে নিয়েই আমি থাকি, আমার জন্য এইখানে একটা বাড়িঘর করে এখানেই থাকার ব্যবস্থা করেন। ভারত যদি আপনাদেরকে রাখার জন্য রাজী থাকে তাহলে সেই সংস্থান করে এখানেই থাকেন। সোহেলের মত তো কত ছেলে আমার চারদিকে। তাই এটা নিয়ে আমার সঙ্গে আলাদাভাবে আলাপ করার প্রয়োজন নাই।'

― আরহাম সিদ্দিকী

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খণ্ড) ]

 

১০#

তাজউদ্দীন আহমদের সাথে শ্রীমতি গান্ধীর প্রথম আলোচনায় তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'এটা আমাদের যুদ্ধ। আমরা চাই ভারত এতে জড়াবে না। আমরা চাই না ভারত তার সৈন্য দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার লড়াই আমাদের নিজেদের এবং আমরা এটা নিজেরাই করতে চাই। এই ক্ষেত্রে আমাদের যা দরকার হবে তা হচ্ছে, আমাদের মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলবার জন্য আপনার দেশের আশ্রয়, ট্রেনিং এর সমস্ত রকম সুবিধা এবং সে ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য-সহযোগিতা এবং অস্ত্র সরবরাহ'।

― আমীর-উল ইসলাম

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খণ্ড) ]

 

১১#

যখন ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ইয়াহিয়া খান ভারতের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিল এবং ভারতের সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হওয়া ছাড়া উপায় নেই, সেই সময়ে তাজউদ্দীন সাহেব শ্রীমতি গান্ধিকে বললেন যে, বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য ঢুকবার আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং কিভাবে সৈন্য ঢুকবে তার একটা ভিত্তি তৈরি করতে হবে। সেই ভিত্তি ছাড়া বাংলাদেশে ঢোকা যাবে না।

তাজউদ্দীন সাহেবের কত বড় দূরদর্শিতা, এবং তিনি কত বেশী সজাগ থাকলে এই কথা বলা সম্ভব, এটা ইতিহাস নিশ্চয়ই বিচার করবে। অথচ এটার জন্যই তাঁকে দোষারোপ করা হয় যে, তিনি নাকি ভারতের সাথে চুক্তি করেছিলেন। চুক্তি যদি বলা হয়, চুক্তি নিশ্চয় করেছেন, কিন্তু সেই চুক্তি ছিল যে, ভারত আমাদেরকে স্বীকৃতি দেবে, তারপরে ভারতের সৈন্য বাংলাদেশে ঢুকবে এবং যৌথ কমান্ডের মাধ্যমে ঢুকবে। যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে ভারতকে সবসময় আমাদের সাথে, আমাদের কমান্ডের সাথে একত্রিত থাকতে হবে। এবং যখনই বাংলাদেশ সরকার বলবে তখনই ভারতের সৈন্যদের বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।

― আমীর-উল ইসলাম

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খণ্ড) ]

 

১২#

তাজউদ্দীন সাহেব অত্যন্ত শিক্ষিত এবং পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। এটা হয়ত অনেকেই জানে না যে, তিনি সমস্ত কাজের ফাঁকে লেখাপড়ার জন্য সময় বের করে নিতেন। বিশ্বের চিন্তাধারা, ভাবনার সাথে নিজেকে ওয়াকেবহাল রাখার একটা প্রচেষ্টা তাঁর ছিল। সম্পূর্ণ প্রচারবিমুখ ছিলেন বলেই এটা কিন্তু প্রকাশ করতেন না। তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে গিয়ে আমরা ব্যাপারগুলোর সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। মাঝে মাঝে বলতাম, 'স্যার, আপনি তো আসলে রাজনীতিবিদ না'। তিনি প্রতিক্রিয়া দেখাতেন না। খুব সাধারণভাবে বলতেন, 'আসলেই রাজনীতিটা ডিফারেন্ট গেম'।

― আবুল মাল আব্দুল মুহিত

[ তাজউদ্দীন আহমদ ― আলোকের অনন্তধারা (প্রথম খণ্ড) ]

 

১৩#

জুলাই মাসের লাস্টে তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে একটা অথেনটিক রিপোর্ট আসল, আর্মি ইন্টেলিজেন্সের ভেতরে একটা খুব ডিপ রুটেড কন্সপাইরেসি ম্যাচিউরড হয়ে গেছে। এই খবরটা এসেছে। ওরা একদম কনফার্মড যে বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে দেবে। ওরা হটিয়ে দেবে এই গভর্মেন্ট। দেশের একটা ভয়াবহ ক্রাইসিস।

এই খবর পেয়ে সেদিন রাত্রে ১১টায়, তাজউদ্দীন সাহেব গেঞ্জী আর লুঙ্গি পরে গেট খুলে বাইরের দিকে যাচ্ছেন। আমি বললাম, 'এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছ?'। আমি উনার সঙ্গে সঙ্গে নীচে নেমেছি। উনি কিচ্ছু না বলে চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর বাসায়। এইগুলো আমি পরে শুনেছি। মুজিব ভাই ঘুমানোর ব্যবস্থা করছিলেন। তাজউদ্দীন পরিষ্কারভাবে বললেন, 'মুজিব ভাই, আমি একটা কথা বলার জন্য এসেছি, আপনি খুব সিরিয়াসলি নেবেন। হাল্কাভাবে নেবেন না যে আমার দেশের মানুষ আমাকে ভালবাসে। আর্মি      ইন্টেলিজেন্সের দিকে কালকেই নজর দেন। একটা গভীর কন্সপাইরেসি ম্যাচিউরড হয়ে এখনই টাইম ওদের জন্য'।

― জোহরা তাজউদ্দীন

['তাজউদ্দীন আহমেদঃ নিঃসঙ্গ সারথি']

 

১৪#

তাজউদ্দীনকে পাকিস্তানিরা- বিশেষ করে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার সহকর্মীরা কি ভয় করতেন তার একটা ঘটনা বলি। ১৯৭১ সালে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের সেই রুদ্ধশ্বাস দিনগুলোর কথা। ভুট্টোও এসেছেন ঢাকায়। আছেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। কড়া মিলিটারি পাহারা। আমরা ক’জন বাঙালি সাংবাদিক তার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি পেয়েছি। মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বেশি কিছু বলতে চাইলেন না। দুজন সহকর্মীর সঙ্গে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে আলাপ করছিলেন। একসময় আমাদের উপস্থিতি ভুলে গিয়ে উর্দুতে বলে উঠলেন : আলোচনা বৈঠকে মুজিবকে আমি ভয় পাই না। ইমোশনাল এপ্রোচে মুজিবকে কাবু করা যায়। কিন্তু তার পেছনে ফাইল-বগলে চুপচাপ যে ‘নটরিয়াস’ লোকটি বসে থাকে, তাকে কাবু করা শক্ত। দিস তাজউদ্দীন, আই টেল ইউ, উইল বি ইউর মেইন প্রবলেম। আমি তোমাদের বলছি এই তাজউদ্দীন হবে তোমাদের জন্য বড় সমস্যা। আমি সঙ্গে সঙ্গে কথাটা নোট বইয়ে টুকে নিলাম। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি, কথাটা একদিন কতবড় ঐতিহাসিক সত্য হয়ে দাঁড়াবে।

[ যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ― শুভ কিবরিয়া, আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬) ]

২১৪৭ পঠিত ... ১৬:২০, জুলাই ২৩, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top