হেনরি ডেভিড থরোর লেখায় যেসব হিউমার আপনি মিস করে যেতে পারেন

৯২৫ পঠিত ... ২১:১৭, জুলাই ১৪, ২০২০

আপনি যদি 'এ্যামেরিকান হিউমারিস্টস' লিখে  গুগল করেন, অনেক লেখকের নাম পাইলেও হেনরি ডেভিড থরোর নামটা পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

'ওয়ালডেন', বা 'লাইফ ইন দি উডস' নামের ক্লাসিক বইয়ের রচয়িতা থরো আরও নানান কারণে বিখ্যাত৷  দার্শনিক, লেখক, প্রকৃতিবাদী, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবাদী, নাগরিক অধিকার নিয়া লড়াই করা এক্টিভিস্ট ছিলেন তিনি। 

তার মৃত্যুশতবর্ষে ষাটের দশকে বিট জেনারেশন, সিভিল রাইটস মুভমেন্ট৷ আর এনভায়রনমেন্টালিজমের কারণে হেনরি আমেরিকানদের কাছে নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়া ওঠেন। বর্তমানে চলমান ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনে হেনরি এক অনুপ্রেরণার নাম। 

আমি কলেজে থাকতে প্রথমবারের মতো হেনরির লেখা পড়ি। ওয়ালডেন। তারুণ্যের উদ্দামতা ও সবকিছু ভেঙেচুড়ে ফেলার জোশ তখন শরীরে। হেনরির লেখা তখন সেই উত্তেজনা আরও বাড়ায়ে দিছিলো। কী ছিলো সেই বইয়ে?

প্রতিষ্ঠান খারাপ: তারা আমার ভাবনা ও সৃজনশীলতা গৎবাঁধা রাস্তায় আটকাতে চায়। বড়রা হয় করাপ্ট না হয় এবসেন্টমাইন্ডেডলি হিপক্রিটিক্যাল, স্বৈরাচারী না হয় ব্রেইনওয়াশড। ফ্যাশন বা উন্নত রুচি প্রায় সবসময় হাস্যকর জিনিস, টাকা সোনার বাছুর, সচ্ছলতা ওভাররেটেড জিনিস, আর সরকার হইলো নীতিবর্জিত বিশাল একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এইসবই ছিলো হেনরির বইয়ে। উদাহরণ দিই ওয়ালডেন থেকেই। 

প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে
যেখানে আপনি যান, লোকে চেষ্টা করবে আপনারে নোংরা প্রতিষ্ঠানের দড়ি দিয়া বান্ধতে। এবং তাদের বস্তাপচা সমাজের মধ্যে ঢুকায়ে দিতে৷ 

মুরুব্বিদের ব্যাপারে
এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মের এন্টারপ্রাইজগুলারে ভাঙা নৌকার মতো ছুড়ে ফেলে।  

ফ্যাশনের এবসার্ডিটি
সৌন্দর্য না, আমরা পূজা করি হেড মাঙ্কি প্যারিসে বইসা মাথায় একটা ট্রাভেলার্স ক্যাপ পরে আর আমেরিকার সব মাঙ্কি অনুসরণ করে।   

বস্তুবাদিতার ব্যাপারে
ব্যক্তি ধনী হইলো কত বেশি সংখ্যক জিনিস না হইলেও চলে তার সমানুপাতে।
বা আমাকে এমন দারিদ্র দাও যার প্রকৃত সম্পদরে উপভোগ করতে দেয়।

কয়েকদিন আগে আরেকবার হেনরির রচনা পড়তে গিয়া অবাক হইলাম। মনে হইছে আগেরবার অনেক কিছু মিস কইরা গেছি। 

গভীর আদর্শবাদিতা ও সিরিয়াস বিষয়ে প্রাসঙ্গিক হেনরিরে নিয়া এমনই যুক্ত হইছি আমরা তার লেখক সত্ত্বার একটা বড় অংশ আমরা খেয়াল করি নাই হয়তো। বিশেষত, আমরা তার জোকগুলার মর্ম বুঝি নাই। 

আমাদের কমন একটা অনুমান হইতেছে কেউ যদি সিরিয়াস বিষয়ে কথা বললে সেইটা শুধু সিরিয়াস ভঙ্গিতেই বলা লাগবে। এই সিরিয়াস বিষয় যিশু খ্রিস্টের জন্যে যেমন, আত্মার মুক্তি, থরোর জন্যেও একই জিনিস জাস্ট সেক্যুলার ভার্সন- এমনই যেন আমাদের প্রত্যাশা। 

অদ্ভুত ব্যাপার হইতেছে, তার জীবদ্দশায় হেনরির সমস্যা ছিলো ঠিক উল্টা। ছাপা কাগজে হোক বা ডায়াসে দাঁড়ায়ে বক্তৃতা হৌক, হেনরির অডিয়েন্সরা অপেক্ষা করতো হাসির কিছুর জন্যে। 

তার বেশ কয়েকটা হিউমারাস বক্তৃতার পরে একই ধরনের কাজের অফার আসতে থাকে তার কাছে। জার্নালে লিখছেন, ‘Curators of lyceums write to me, “Dear Sir,—I hear that you have a lecture of some humor. Will you do us the favor to read it before the Bungtown Institute?’

১৮৫৪ সালে, এমারসনের এক বন্ধুর ব্যাপারে হেনরির জার্নাল: He was much interested in my Walden, but relished it merely as a capital satire and joke, and even thought that the survey and map of the pond were not real, but a caricature of the Coast surveys.”

আরেক জায়গায়, ১৮৫৫ সালে, লিখছেন: 

আমার ত্রুটি:
প্যারাডক্সিকাল কথা বলা, উল্টাটা বলা- প্রয়োজনের সময়ও রাশভারী না হইতে পারা। 

গুণ: শব্দ নিয়া খেলা করা-হাসাইতে পারা- অবশ্য সবসময়ই সহজ, প্রশস্ত হো হো হাসি না।

এই হেনরিরে  আপনি বর্তমানের পরিচিত সিরিয়াস দার্শনিক, লেখক হেনরির সাথে কিভাবে মিলাবেন? 

রচনাবলিজুড়ে হেনরি নির্ভর করছেন, অতিরঞ্জন, সারকাজম, প্যারাডক্স আর এফরিজমধর্মী অতিকথনের উপ্রে। যা যেকোনো হিউমারিস্টদের সাথে পুরোপুরি মিলে।  

ভাষার সোজাসাপ্টা ব্যবহার না, তীর্যক আর সাহিত্যিক স্বাধীনতা নেয়া রূপটাই কাজে লাগাইছেন হেনরি। ফলে তার বাক্যগুলিতে নিয়মিত দেখা যায় পান (pun) আর ডাবল মিনিং। যা প্রায়ই পাঠকদের হাসাইতে ইউজ করছেন। এইসব দেখে মনে হইলো, হেনরির হিউমারিস্ট সত্তাটা পাঠকদের কাছে অবহেলিতই রইয়া গেছে। এই বিষয়ে কথা বলা দরকার।

তার রসবোধের নমুনা দেখা যাইতে পারে কিছু। তার উইটের নমুনা 'ওয়াল্ডেন'-এর 'বইপড়া' চ্যাপ্টারে আছে: 

I confess I do not make any very broad distinction between the illiterateness of my townsmen who cannot read at all, and the illiterateness of him who has learned to read only what is for children and feeble intellects. We should be as good as the worthies of antiquity, but partly by first knowing how good they were. We are a race of tit-men, and soar but little higher in our intellectual flights than the columns of the daily paper.

'নিঃসঙ্গতা' অধ্যায়ে লিখছেন: 

সমাজ মূলত সস্তা জিনিস। নিয়মিত আমরা মেলামেশ করি, একে অপরের কাছ থিকা নতুন কোনো কিছু জানার থাকে না। দিনে তিনবার খাইতে গিয়া দেখা করি আর একে অপররে পচা চিজের স্বাদটাই খালি জানাইতে থাকি। 

অতিথিদের ব্যাপারে
জঙ্গলে বাস করার কালে যত অতিথির দেখা পাইছি, জীবনের অন্য কোনো সময় সেইটা পাই নাই; মানে জঙ্গলে কয়েকজন অতিথির দেখা অন্তত পাইছি। 

সরকারের ব্যাপারে
সবচাইতে ভালো সরকার সেইটা যা জনগনরে শাসন করে সবচাইতে কম। 

অন্যের ভালো করা বিষয়ে
যদি জানতাম যে কেউ একজন আমার ভালো করার সচেতন প্রয়াস নিয়া আমার বাসায় আসতেছে, আমি পালাইতাম।

হেনরি মনে করতেন, সিরিয়াস আলাপ লঘু ভঙ্গিতেও করা দরকার মাঝেমধ্যে। বেশি সিরিয়াস বা গুরুগম্ভীর ভঙ্গি সাধারনের থেকে দূরের সরায়ে দেয় দার্শনিকদের। দুর্বোধ্য করে তোলে: 

দার্শনিকেরা এত রাশভারী হয়ে থাকেন কেন বুঝি না। দার্শনিকদের উচিত রসবোধ ও হাসি ঠাট্টার চর্চা করা যাতে তার গভীর চিন্তা সহজপাচ্য হয়।

এমনকি প্রকৃতি নিজেই হাসি-ঠাট্টা পছন্দ করে। খেয়াল করছেন, মানবজাতিরে নিয়া কী মজার খেলাটাই না সে খেলে।

প্রচন্ড অর্থকষ্টে পড়ছেন জীবনে অনেকবার কিন্তু তার রসবোধ কমে নাই। এমারসনের কাছ থেকে টাকা ধার কইরা চলছেন (মার্ক্সের যেমন ছিল ধনী এঙ্গেলস তেমনি হেনরির ছিলো এমারসন। কী বোঝা গেলো? মহৎ কাজ করতে চাইলে অবশ্যই ধনী বন্ধু বানাবেন দুই একজন!)। ওয়ালডেন ছাড়া বাকি বইগুলা চলে নাই। বই সম্পর্কিত একটা ঘটনা লিখে লেখা শেষ করবো।

হেনরি ‘কনকর্ড ও মেরিম্যাক নদী-অঞ্চলে এক সপ্তাহ’ নামে একটি বই লিখছিলেন। বইটা তেমন বিক্রি হয় নাই। প্রকাশক স্থান সঙ্কুলানের সমস্যায় পড়লে হেনরি অবিক্রীত বইগুলো তার ঠিকানায় পাঠায়ে দিতে বলেন। প্রকাশক এক হাজার কপির মধ্যে অবিক্রীত সাতশ’ ছয় কপি বই থরোর কাছে পাঠায়ে দেন। হেনরি বইগুলো তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রেখে ডায়রিতে লেখেন, ‘আমি এখন নয়শ’ বইয়ের এক বিশাল ব্যক্তিগত লাইব্রেরির মালিক। এর মধ্যে সাতশ’রও বেশি আমার নিজের লেখা।’ 

হেনরি ডেভিড থরোর লেখা পড়েন। সিরিয়াসলিই পড়েন। কিন্তু আমার একটা অনুরোধ: পড়তে গিয়া হেনরির হিউমারিস্ট সত্ত্বার প্রতিও একটু সুবিচার কইরেন। হেনরির জোকগুলা মিস কইরেন না। হাইসেন।

৯২৫ পঠিত ... ২১:১৭, জুলাই ১৪, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top