ওয়েলকাম টু দ্য রেটিং সিস্টেম ওয়ার্ল্ড (একটি ৪.৫ স্টার লেখা)

৬০৮ পঠিত ... ১৭:২৬, জুন ১১, ২০২০

উবারের রেটিং সিস্টেম টু-ওয়ে অর্থাৎ এখানে ড্রাইভার এবং যাত্রী পরস্পরকে রেটিং দেয়। এভারেজ ৪.৮৯ স্কোরের এক যাত্রী একদিন দেখলো এক  ড্রাইভার তাকে দিয়েছে ১-স্টার রেটিং। এই যাত্রী খুব মার্জিত-ভদ্র। সে কৌতূহলবশত ড্রাইভারের কাছে এতো লো রেটিং দেয়ার কারণ  বিনয়ের সাথে জানতে চাইলো। ড্রাইভার বললো, স্যার এটা লো রেটিং না। আমি আপনাকে নাম্বার ওয়ান রেটিং দিয়েছি! 

২০১৪ সালে চীন সরকার একটা সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেমের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে। সিস্টেমটা চালু  হওয়ার কথা ২০২০-এর শেষ নাগাদ। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে প্রচুর হৈচৈ হয়।  

চীন সরকার বলছে, এই সিস্টেমের উদ্দেশ্য হলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক আচরণের ভিত্তিতে নাগরিকদের পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া।  

আপনি হয়তো বলবেন, এই পুরস্কার/শাস্তির ধরন তো যে কোনো দেশেই আছে, আইনশৃংখলা বা সিভিল সোসাইটি তা-ই করে। এ আর নতুন কী?  

এক্ষেত্রে নতুন যা হবে, এই সিস্টেম আরও আরও বেশি দৃশ্যমান আর নির্দিষ্ট হয়ে যাবে। ধরা যাক, আপনি চুরি করেছেন, কিছুদিন জেল খেটে বেরিয়ে এসেছেন। ঝামেলা চুকে গেল!

কিন্তু এই নতুন সিস্টেমে কিন্তু আপনার ঝামেলা চুকে গেলো না। আপনার নামের পাশে চুরির জন্যে পয়েন্ট মাইনাস করা থাকবে, ভাল কাজের জন্যে প্লাস। অনেকটা ফেসবুক টুইটার ইন্সটাগ্রামের আপনার ফলোয়ার সংখ্যার মতো আপনার নাম্বারের সাথে ঝুলতে থাকবে। ফলে আপনার পয়েন্ট খারাপ হলে বিভিন্ন নাগরিক সু্যোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। আপনি অমুক বিমানে চড়তে পারবেন না, অমুক অনুষ্ঠানে যাওয়ার অনুমতি পাবেন না, প্রেস্টিজিয়াস চাকরি বাকরি বা অভিজাতদের জন্য বরাদ্দ নানা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।  

নেটফ্লিক্সের সিরিজ ব্ল্যাক মিরর-এর সিজন-৩ এপিসোড-১ এর নাম 'নোজডাইভ'। 'নোজডাইভ'কে বলা যায় এই রেটিং সিস্টেমেরই একরকম ডিস্টোপিয়া। ব্যবহারকারীরা তাদের সব ধরনের সামাজিক ইন্টারেকশন অনলাইনে (১ স্টার থেকে ৫স্টার পর্যন্ত)  রেটিং দেয়।  সমাজের স্ট্যাটাস থেকে বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সুযোগ- সুবিধা, চাকরিবাকরি সহ জীবনের সবকিছু নির্ভর করে ব্যবহারকারীর কারেন্ট রেটিং কত তার উপরে।  

কাগজে কলমে, অন্তত চীন সরকারের দাবি, ব্যক্তি ভালো আচরণের মাধ্যমে  ট্রাস্টওয়ার্দি হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রের দ্বারা পুরষ্কৃত হবে। বিপরীত ঘটলে বিপরীত। চীনে সরকারি ও বেসরকারিভাবে এই সোশ্যাল ক্রেডিট প্রোগ্রাম চালু হবার কথা। এমনিতে  কিছু কিছু পদক্ষেপ ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থি ও এক্সট্রিম বলে মানবাধিকারকর্মীরা দাবি করলেও, রেটিং বা রিভিউর মূল ধারণাটা তা নয়। রেটিং সিস্টেম বিশ্বজুড়ে খুব কমন প্র‍্যাক্টিস। উবার বা এয়ারবিএনবির মতো মার্কেটপ্লেস, রিভিউ প্ল্যাটফর্ম বা রিভিউ ড্রিভেন সাইট যেমন ইয়েল্প, আমাজন, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স এই সিস্টেমেই চলে। এমনকি ফেসবুক, টুইটার,  টিকটক বা  ইন্সটাগ্রামের মতো যে সোশ্যাল মিডিয়াগুলো আপনি ব্যবহার করেন সেগুলোতেও খুব গভীরভাবে কাজ করে এই রেটিং সিস্টেম।  

রেটিং আর রিভিউ ভোক্তাদের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করলেও জাস্ট ভালো-মন্দের বাইনারির বাইরেও গভীর মনস্তাত্ত্বিক খেলা চলে এই সিস্টেমের কারণে। রেটিং দেয়ার সময় মানুষের ব্রেইন কিভাবে কাজ করে বা রেটিং দেয়ার সময় মানুষের প্রবণতা নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। এই লেখায় গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছু গবেষণা নিয়ে সংক্ষেপে বলবো। 

 

কোনো বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা ওই বিষয়ে সাধারণত পজিটিভ রিভিউয়ার

এমআইটির একদল গবেষক দেখিয়েছেন, যে কোনো বিষয়ে আপনি যখন নিজেকে এক্সপার্ট  হিসেবে দেখবেন, খুব সম্ভব এই বিষয়ে আপনার রিভিউ পজিটিভ হবে। কারণ এটা প্রমাণ করবে আপনার চয়েস স্মার্ট ছিলো। আপনি জানেন কোন বইটা বা সিনেমাটা ভালো। শহরের কোন রেস্তোরার খাবার সবচেয়ে ভালো। আপনি অনেক দিন ধরে সিনেমা বানান বা বই লেখেন। সেক্ষেত্রে অন্য ফিল্মমেকারের ফিল্ম বা বইয়ের প্রতি খুব বেশি নেগেটিভ রিভিউ দেয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ সে-ও আপনার ট্রাইবের লোক। কোন ব্যক্তি তার নিজের ট্রাইবের লোককে নেগেটিভ বলে? 

 

গ্রুপ নর্মস ও কনফর্মিটি 

মুজাফর শেরিফের ১৯৩৬ সালের ক্লাসিক একটা এক্সপেরিমেন্ট আছে। অন্ধকার একটা এক্সপেরিমেন্টে অংশগ্রহণকারীদের বলা হলো ১৫ ফিট দূরের দেয়ালে কতগুলো আলোর বিন্দু নড়াচড়া করছে তা অনুমান করতে। 

দেখা গেলো অংশগ্রহণকারীরা যখন আলাদা আলাদা করে উত্তর দিচ্ছে তাদের উত্তরের রেঞ্জ অনেক বেশি ( ১১-৪২ টি আলোর বিন্দু)। অথচ এই অংশগ্রহণকারীরা যখন একসাথে কয়েকজন বসে উত্তর দিচ্ছে তখন তাদের উত্তরে রেঞ্জ বেশ ছোট ( ২৪-৩১)  হয়ে আসে। 

শেরিফের এক্সপেরিমেন্ট দেখায় গ্রুপ একটিভিটিজের ক্ষেত্রে মানুষের জাজমেন্টে প্রায়ই ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন ঘটে না। সবসময়ই গ্রুপের মেজরিটির সাথে একমত হতে চায়। শেরিফের ১৯৩৬ সালের এক্সপেরিমেন্ট পরর্বতীতে আরও সুক্ষ্ম নানারকম প্রযুক্তি ও আইডিয়ার সাহায্যে করা হয়েছে। যা এখন সোশ্যাল প্রুফ থিয়োরি নামে পরিচিত। 

ফেসবুক বা টুইটারে খেয়াল করে থাকবেন যে পোস্ট/টুইট অনেক লোক লাইক বা শেয়ার করে সেগুলোকে আরও অনেকে লাইক/শেয়ার করে। আপনার একটা মিউজিক ভিডিও ১ কোটি বার ভিউ হওয়া মানে আরও কোটিখানেক ভিউ ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা। এককথায়, মার্ফিস ল'র মতো লাগে অনেকটা: আপনাকে অনেকে পছন্দ/অপছন্দ করে কারণ আপনাকে অনেকে পছন্দ/অপছন্দ করে, যদি রেটিং দেয়ার আগে ব্যক্তি জানে যে আগেই এত লোক পছন্দ/অপছন্দ করেছে। 

একই নিয়ম প্রযোজ্য বিভিন্ন প্রকার রেটিং, স্টার, ভোট বা অন্যান্য সিস্টেমে। সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরালিটির পেছনে মূল কন্সেপ্ট এটাই।  

এই ভাইরাল কালচার আবার প্রচুর বাজে জিনিসকেও পপুলার করে তুলতে পারে। ভালো জিনিস বা সেবাও রিভিউ বা রেটিং সিস্টেমের গ্যাড়াকলে পড়ে ব্যবসায় ধরা খেয়ে যেতে পারে।   

 

তাহলে ইউজারদের কাছ থেকে যথার্থ রিভিউ পেতে কী করা যেতে পারে?

ব্যাখ্যা।

কানাডার মার্কেটিং প্রফেসর সারাহ মুরের একটা গবেষণায় দেখা গেছে, কাউকে তার পজিটিভ অভিজ্ঞতার কারণ ব্যাখ্যা করলে এক্সপেরিয়েন্সটা কম পজিটিভ লাগে। আবার কারও নেগেটিভ এক্সপেরিয়েন্স কেন নেগেটিভ লেগেছে তা ব্যাখ্যা করলে সেই একই এক্সপেরিয়েন্স কম নেগেটিভ লাগে।

উদাহরণ দিয়ে বোঝালে সহজ হবে। 

কোনো দোকানের কাচ্চি আপনার কাছে কেন পুরাই বেহেশতি খানার মতো সুস্বাদু লাগে- তা ব্যাখ্যা করে বুঝালে আপনার কাছে ওই কাচ্চি কিছুটা কম সুস্বাদু লাগে। একইভাবে কোনো একটা মুভি কী কারণে এত ফালতু বা নিম্নমানের তা ব্যাখ্যা করার পর মুভিটা আপনার মেজাজ  আগে যতটা খারাপ করতো তা  কিছুটা কম করে। 

অর্থাৎ পজিটিভ বা নেগেটিভ ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা বা বোঝার চেষ্টা করলে তা উক্ত বিষয়ে আবেগের তীব্রতা কমায়। ফলে সেক্ষেত্রে বিচার-বিবেচনার ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক যথার্থ রিভিউ পাওয়া যায়।  অর্থাৎ অনেক বেশি ক্রিটিক্যাল ও বিস্তারিত অংশগ্রহণ ছাড়া যথার্থ রিভিউ বা রেটিং পাওয়া যাবে না। 

রেটিং সিস্টেমের অজস্র সমস্যা আছে, কারণ অভিজ্ঞতাসমূহকে সংখ্যায়  রূপান্তর করায় আমাদের অপারগতা ও উপযুক্ত সিস্টেমের অভাব। সিস্টেমে সমস্যা থাকলেয়াও অস্বীকার করা যাবে না  রেটিং বা রিভিউয়ের প্রভাব অনেক। ফোর্বসের মতে, রেটিং বা রিভিউ দেখেই অনেক  ভোক্তাদের বড় অংশ পণ্য বা সেবা কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। গুরুত্ব বিবেচনায় থেকে রিভিউ/রেটিং পারসোনাল রিকমেন্ডেশনের অনেকটা কাছাকাছি। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষনায় দেখা গেছে, রেটিং-এ গড়ে ১-স্টার বৃদ্ধি পাওয়া মানে পন্য/সেবার বিক্রি শতকরা ৫-৯  ভাগ বৃদ্ধি পাওয়া। তাছাড়া অনলাইন রিভিউ গুগলের এ্যালগরিদমের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ সূচক। যে পন্যের রেটিং/রিভিউ যত বেশি ও  পজিটিভ সার্চ রেজাল্টে গুগল সেটিকে আগে দেখায়। 

মিডিয়ায়, অফলাইনে-অনলাইনে, মোটিভেশনাল বা সেল্ফহেল্প গুরুরা প্রতিনিয়ত আপনাকে বলে জাজমেন্টাল না হতে। 'নো জাজমেন্ট' তাদের স্লোগান। জাজমেন্টাল না হওয়ার জন্যে পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো সময় এতো আহ্বান জানানো হয়েছে বলে মনে হয় না।  জাজমেন্ট মানেই খারাপ এমন একটা ইম্প্রেশন অলরেডি দাড়িয়ে গেছে। 

অথচ মজার ব্যাপার হলো বর্তমান মার্কেটপ্লেস নির্ভর পৃথিবী ২৪/৭ আপনাকে জাজমেন্টাল হতে চাপ দিচ্ছে। আপনি ফেসবুকে টুইটারে লাভ/লাইক দেন অথবা না দেন। লাইক শেয়ার কমেন্ট দেয়া বা না দেয়ার মাধ্যমে আপনার জাজমেন্টের প্রতিফলন ঘটে। আমাজনে, গুডরিডস, আইএমডিবি/রটেন টমেটোতে, রেস্তোরার খাবারের রিভিউ/রেটিং দেন। 

আমরা অলরেডি একটা ক্রিটিকের জেনারেশনে পরিণত হয়ে গেছি। অবশ্য সেই ক্রিটিসিজম আমরা অধিকাংশ লোক করি বিনে পয়সায়। আমরা মুভি/মিউজিক/বইয়ের লিস্ট বানাই, লিস্টে ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড মনোনয়ন দিই।  

আমরা রেস্তোরায় গেলে ওয়েটারের প্রত্যেকটা মুভ খেয়াল করি। সে যথেষ্ট সম্মান বা আন্তরিকতা দেখাচ্ছে কিনা, হেসে কথা বলছে কিনা। তার প্রতিটা আচরণ আমরা বিচার করি। মনে মনে অঙ্ক করি। বিচারের ফলাফল অনুযায়ী ভার্চুয়াল রেটিং দিই।  

এখানেই থামাথামি নাই। আপনার রেটিং-এর রেটিং দেয়ার জন্যেও রেডি আছে অনেক লোক। আপনি আমাজনে রিভিউ দিলেন। সেই রিভিউতেও রেটিং বা লাইক/আনলাইক বা মন্তব্য পড়বে। সেই মন্তব্যেও  মন্তব্য পড়া কমন ঘটনা। এই 'মেটা' ব্যাপারটার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ রেডিটের পোস্ট আর কমেন্ট।  

যেহেতু ডিজিটাল প্রডাক্টের  দ্রুত বৃদ্ধি আর ভার্চুয়াল পৃথিবীর  ইউজার এক্সপেরিয়েন্স ও গেইমিফিকেশন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি, ভবিষ্যতে আরও বেশি হবে রেটিং সিস্টেম আর রিভিউতেও স্কোর  অকল্পনীয় মাত্রায় চলে যাবে। 

অদূর ভবিষ্যতে আপনার জীবনের প্রতিটি মূহূর্ত, প্রতিটি অভিজ্ঞতা এই রেটিং সিস্টেমের মনস্তত্ত্ব  দিয়ে প্রভাবিত হবে। প্যারাডক্সিক্যাল ব্যাপার হলো পৃথিবী নামক বিশাল মার্কেটপ্লেস  পরোক্ষভাবে আপনাকে প্রতিনিয়ত জাজমেন্টাল হতে বাধ্য করবে আবার আপনাকেই শুনতে হবে 'ডোন্ট বি জাজমেন্টাল'।

ওয়েলকাম টু দিস রেটিং সিস্টেম ওয়ার্ল্ড!

৬০৮ পঠিত ... ১৭:২৬, জুন ১১, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top