ঢাকার প্রথম প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখার হুলস্থূল অভিজ্ঞতা

৬৯১ পঠিত ... ১৮:৪২, আগস্ট ২৫, ২০১৯

দেশভাগের পর কলকাতার পাট চুকিয়ে যখন এক রত্তি ঢাকায় এলাম, তখন ব্রিটিশ-উত্তর যুগের সেই ____ কালে বিনোদনের জায়গা বলতে ছিল ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা ছটা প্রেক্ষাগৃহ রমনার রম্ভা ‘ব্রিটানিয়া’, সং বংশালের ‘মানসী’, কাচালি পল্লীর ‘মুকুল’, সদরের শোভা ‘রূপমহল’, উর্বশীসম ‘লায়ন’, চর্মে ঘর্ম আর্মেনিটোলার ‘নিউ পিকচার হাউস’, আর চকের চাক্কু ‘তাজমহল’।  

ঢাকার প্রথম পেক্ষাগৃহ ছিল ‘নিউ পিকচার হাউস’। এই হলটি প্রধানত সেকেন্ড রান ইংরেজি ছবি দেখাত। আর্মেনিয়ান গির্জার পাশে আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে অবস্থিত এই হলটির গোড়ায় নাম ছিল ‘পিকচার হাউস’। প্রথম মহাযুদ্ধের কোনো এক সময়ে যাত্রা শুরু। লেজার নামে জনৈক ইংরেজ প্রথমে পাটের গুদাম, পরে একে প্রমোদ হলে রূপান্তর করেন। হাত বদল হয়ে উদ্ধভজী ঠাকুর নামে এক মাড়োয়ারি ‘পিকচার হাউস’ নাম দিয়ে দর্শনীর বিনিময়ে গ্রেটা গার্বো অভিনীত একটি ছবি দিয়ে প্রদর্শনী শুরু করেন। এরপর আরও হাতবদল হয়ে রাজেন্দ্রকুমার গুহ ও মতিলাল বসু হলটি কিনে নিয়ে ‘নিউ পিকচার হাউস’ নামকরণ করে। অনেকের মতে, এটাই বাংলাদেশের প্রাচীনতম প্রেক্ষাগৃহ। এখানেই দেখানো হয় সর্বকালের সাড়া জাগানো ছবি অশোক কুমার ও দেবিকা রানী অভিনীত অচ্ছুৎ কন্যা এবং চার্লি চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমস। 

কিন্তু একবার এই হলে একটা ছবি দেখতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা ভোলার নয়। ছবিটার নাম ছিল কমান্ড ডিসিশান। আজ আর মনে নেই কারা ছিলেন এর অভিনেতা (কোনো অভিনেত্রী যে ছিলেন না, এটা বেশ মনে আছে)। মার্জারি প্রেম দেখে দেখে চোখ পচে যাচ্ছিল, তাই একটা মারদাঙ্গা ছবি দেখার খাতিরেই যাওয়া আরকি। হলের সামনে যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবের পোস্টার দেখে হৃষ্টচিত্তেই ঢুকেছিলুম হলে। কিন্তু বিমানঘাঁটির একটা ঘরে পাঁচ ইয়াংকি বৈমানিকের সংলাপের আর যেন শেষ নেই—শত্রুপক্ষের ঘাঁটি কী করে আক্রমণ করা যাবে, তারই প্ল্যান চলছে মুখে মুখে। কিন্তু বাচালদের কথা আর শেষ হয় না—আধঘন্টা ধরে ওদের প্যাঁচাল শুনে শুনে দর্শকদের প্রাণ অতিষ্ঠ। 

এরপর আমার সম্পাদিত রূপছায়া-র ১৯৫৮ সালের ফাইল থেকে অগ্রজ মঈদ-উর-রহমানের সমালোচনা থেকে বাকিটা: 

“থার্ড ক্লাস ও ইন্টার ক্লাসের দর্শকবৃন্দ সমস্বরে চীৎকার কোরে উঠলো—’অই অই ...লার পো’রা, কত ওয়া ওয়া করবি? গরের থে’ বাইর অ’ জলদি।’ কী আশ্চর্য! মনে হলো পর্দার অভিনেতারা এদের ধমক শুনলে পেল। পাঁচজন সৈনিক ঘর থেকে নিস্ক্রান্ত হলো। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

“যাক, এবার একটা ফাইটিং-টাইটিং একটা কিছু অবশ্যি হবে। পরের দৃশ্যে দেখা গেল সৈনিক পাঁচজন পাঁচটা বোমারু বিমানে আসমানে চক্কর মারছে। ফ্রন্ট ক্লাসের দর্শকেরা উৎসাহের চোটে তালিয়া বাজিয়ে বলে উঠল, ‘অক্ষণে মাইরপিট অইবো রে! ওই যে ওইটা (ষণ্ডাগুণ্ডা মার্কা একজন অভিনেতা দেখিয়ে) অইল বাহাদুর।’ কিন্তু হা হতোস্মি! আধ মিনিট পরেই অপর এক দৃশ্যে দেখা গেল সৈনিক পাঁচজন কোন ফাঁকে বোমারু বিমান থেকে নেমে আবার সেই ঘরে ম্যাপ নিয়ে প্ল্যান কোরতে বসে গেছে! চললো এরকম আরো কুড়ি মিনিট। ফ্রন্ট রো’র দর্শকেরা গেট কিপারদের উত্তেজিতভাবে জিগ্যেস করলো, ‘ফাইটিন অহে না ক্যাল্লা?’ গেটকিপার ঢোক গিলে বললো—‘এট্টু সবুর করেন না। এই অক্ষণেই অইব।’

“তারপরেই ইন্টারভ্যাল।

“ফ্রন্টরোর দর্শকশ্রেণী… গেটকিপার ও ম্যানেজারকে শাসিয়ে বললো, ‘কিবে ফাইটিন অইব কবে? খেলা শ্যাস অইলে?’ ওরা জবাবে বললো, ‘এই হাফটাইমের পরেই অইব।’

“ইন্টারভ্যালের পর ছবি শুরু হলো।

“সেই ঘর। সেই সৈনিক পাঁচজন। সেই ম্যাপ। আর সেই ওয়া ওয়া জাতীয় আলোচনা। আমাদের বারোটা তখন। পয়সা খরচ করে পুটুস পুটুস ছারপোকার কামড় খেয়ে শেষকালে এই ছবি দেখা বরাতে ছিল? ...একটা বিতৃষ্ণার ভাব শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিতে শুরু করেছে, এমন সময় সিনেমা গৃহের চারদিকে থেকে আওয়াজ উঠলো, ‘মার হালারে, ধর ধর!’

“কয়েকটা ঢিল গিয়ে পড়লো পর্দার গায়ে। আসল ফাইটিং শুরু হোয়ে গেলো এতোক্ষণে। আওয়াজ শুরু হলো মড় মড় মড়াৎ। ঠাস ঠুস ঠসাৎ! বুঝলাম, চেয়ারভাঙ্গা পর্ব চোলছে। কতগুলো ছোট ছেলে স্টেজে উঠে “হে ডিং ডিং” কোরে নিজেদের মধ্যে “ফাইটিন” অভিনয় শুরু কোরে দিয়েছে। ফ্রন্টরোর দর্শকদের একদল চেয়ার-দরজা চাঙা ও পর্দা ছেঁড়ার কাজে মত্ত হলো। অপর একদল গেটকিপারদের একজনকে সোয়া পাঁচমণি ঘুঁষাঘুষি মেরে চিৎ পটাং কোরে ম্যানেজার নিধন পর্ব শুরু করার জন্যে ম্যানেজারের কামরার দিকে ধাবিত হলো। তখন ব্যাঁকা-পাওয়ালা এক ম্যানেজার ছিল নিউ পিকচার হাউসে। …বেগতিক দেখে ব্যাঁকা-পাওয়ালা আগে থেকেই টিকিট ঘরে গিয়ে লুকিয়েছে। 

“ম্যানেজারের তকদির ভাল যে ফাইটিং যখন পুরোদমে চলছে, আর নিজের ওপর আক্রমণ শুরু হবে, ঠিক সেই মুহূর্তে দুই লরী বোঝাই পুলিশ এসে হাজির। সঙ্গে সঙ্গে হুটোপুটি ও লৌরালৌরি!” 

এরপর ক্ষতবিক্ষত হলটি পুনরায় মেরামত করে চালু করতে বেশ কয়েক মাস লেগেছিল। পরে হলটি হাতবদল হয়ে চলে যায় মো. মোস্তফা নামের এক চিত্রপরিবেশকের কাছে। তিনি নাম বদলে রাখেন ‘শাবিস্তান’। 

৬৯১ পঠিত ... ১৮:৪২, আগস্ট ২৫, ২০১৯

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top