বর্তমান সারভেইলেন্স সোসাইটির ব্যাপারে অরওয়েলের যে 'ভবিষ্যৎবাণী'গুলো নির্ভুল প্রমাণিত হচ্ছে

৪৭৫ পঠিত ... ১৬:২৫, জুন ১২, ২০১৯

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার কয়েক বছর পর, ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ব্রিটিশ সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস ‘নাইন্টিন এইটি ফোর’। তখনো বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত সারেনি, অথচ তার মাঝেই গোটা দুনিয়া বিভক্ত হতে থাকে দুই মেরুতে। বিশ্বযুদ্ধে জয়ী মিত্রবাহিনীর দুই পরাশক্তি আমেরিকা আর রাশিয়া বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে নিজ নিজ ছাতার তলায় নিয়ে ‘টাগ অফ ওয়ার’ শুরু করে দেয়। এমন অস্থির এক পৃথিবীতে বসে অরওয়েল লিখেছিলেন এই ‘ডিস্টোপিয়ান’ উপন্যাস নাইন্টিন এইটি ফোর।  

৩৫ বছর পরের অর্থাৎ ১৯৮৪ সালের এক অদ্ভুত কাল্পনিক পৃথিবীকে তিনি তুলে ধরেন তার উপন্যাসে। যে পৃথিবীর সর্বময় ক্ষমতা গুটিকয়েক মানুষের হাতে। অগণিত কঠোর নিয়মের বেড়াজালে বন্দি সাধারণ মানুষের জীবন। আর রাষ্ট্রের প্রচণ্ড নজরদারিতে আবৃত নাগরিকদের জীবন যাপন, এমনকি চিন্তাও। সামান্যতম বিরুদ্ধ চিন্তার কোন স্থান নেই সেই পৃথিবীতে।

তবে বাস্তবে ১৯৮৪ সালের পৃথিবী প্রযুক্তিগতভাবে অতটা অগ্রসর হতে পারেনি যে কোন রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অতটা নজরদারির মাঝে রাখতে পারবে। তারপরেও কোন রাষ্ট্রই থেমে থাকেনি। ধীরে ধীরে যেন এগিয়ে গিয়েছে সেই অরওয়েলিয় পৃথিবীর দিকেই। তবে একবিংশ শতাব্দী আসতে আসতে এই নজরদারি এবং প্রভাব বিস্তার শুধুমাত্র রাষ্ট্র বা সরকারের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি এই পলিসি গ্রহণ করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও। বর্তমান সময়ে আমরা সবাই নিজেদের স্মার্টফোন, কম্পিউটার এমনকি স্মার্ট টিভি দিয়েও থাকছি এসব প্রতিষ্ঠানের নজরদারিতে।

২০১৯ সালের জুন মাসে ৭০ বছরে পড়েছে যাচ্ছে নাইন্টিন এইটি ফোর। বইটি লেখা হয়েছিল ৩৫ বছর পরের এক পৃথিবীকে কল্পনা করে। ১৯৮৪ সালের পৃথিবী জর্জ অরওয়েলের অনুমানের সাথে না মিললেও, ১৯৮৪-র ঠিক ৩৫ বছর পর এই ২০১৯ সালে এসে পৃথিবী ঠিক কতটা অরওয়েলীয় হয়েছে সেটা দেখে যে কেউই বিস্মিত হয়ে যেতে পারেন। অরওয়েলের অনুমান কতটা মিলে গেছে এই আজকের পৃথিবীর সাথে দেখে নিন।

১# 'নাইন্টিন এইটি ফোর' বইটিতে দেখা যায়, সমাজে শৃঙখলা ধরে রাখতে রাষ্ট্র ঠিক করে দেয় কোনটা গ্রহণযোগ্য কথা আর কোনটা নয়। 

২০১৯ সালে আপনি অনলাইনে কী দেখতে এবং বলতে পারবেন তা ঠিক করে দেওয়ার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রাইভেট কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন ক্যাডার আর নির্বাহীর হাতে।

২# 'নাইন্টিন এইটি ফোর'-এ অল্প কয়েকটামাত্র দেশ ছিলো যেখানে বিশ্বের সিটিজেনরা থাকতো। 

২০১৯ সালে, হাতে গোনা কয়েকটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাম্রাজ্যে পৃথিবীর বেশিরভাগ নেটিজেনরা থাকে।

৩# 'নাইন্টিন এইটি ফোর' বইয়ের পৃথিবীতে রাষ্ট্র পুরো মাত্রায় নজরদারি করত। একইসাথে জনগণের কথাকে সেন্সর করতো।

২০১৯ সালে এসে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘন্টা মানুষ আর এ্যালগরিদম নির্ভর মডারেটরদের বিশাল বাহিনীকে নজরদারির কাজে লাগায়। এই বাহিনী যারা 'চিন্তাপরাধ (থটক্রাইম)' করে তাদের চিহ্নিত করে তাদের সব কাজকর্মকে ডিলিট করে দেয়া। যারা অনেক বেশি চিন্তাপরাধ ঘটায় তাদেরকে কোনো প্রকার ইন্টারভেনশন বা রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা ছাড়া  এবং আপিল করার অধিকার ছাড়াই শাস্তিস্বরূপ ‘না-মানুষ’ অবস্থায় নিয়ে যায় এই প্রাইভেট কোম্পানিগুলো।  

৪# 'নাইন্টিন এইটি ফোর'-এর দুনিয়ায় যারা গুরুতর চিন্তাপরাধ করে বা করার ইতিহাস যাদের আছে তাদেরকে ‘অনস্তিত্ব’ অবস্থায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। মুছে ফেলা হয় তাদের সমস্ত চিহ্ন।

২০১৯ সালে, সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো যে কোনো কারণে যে কোনো ব্যক্তিকে যে কোন সময় ব্যান করে দিতে পারে। এর ফলে নিষিদ্ধদের লেখা সমস্ত পোস্ট মুছে দিয়ে তাদের অস্তিত্বের সমস্ত ছাপ মুছে ফেলার প্রায় ঐশ্বরিক ক্ষমতা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আছে। যারা ডিজিটালি মৃতদের নাম উল্লেখ করে বা তাদের ব্যান করাকে সমালোচনা করে তাদের সমালোচনাকেও মুছে ফেলে ‘না-মানুষ’-দের অনস্তিত্ব নিশ্চিত করে এই প্রতিষ্ঠানগুলো।

৫# 'নাইন্টিন এইটি ফোর'-এ সরকার প্রতিনিয়ত অসুবিধাজনক ইতিহাসকে নতুন করে লিখে। নিজেদের বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন অস্বস্তিকর ইতিহাসকে ক্ষমতাসীনরা মুছে ফেলে।

২০১৯ সালে সরকার বা ক্ষমতাসীনরা অতীতে ভুল প্রমাণিত হওয়া নিজেদের বিবৃতি মুছে ফেলতে বা তাদের বর্তমান দাবির স্বপক্ষের কিছু যোগ করতে আরামসে প্রেস রিলিজ লিখে দেয়। অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সাধারণ নাগরিকদের অতীতের ভুলত্রুটি সমাজের স্মৃতি থেকে মুছে ফেলে ‘নবজন্ম’র সুযোগ দিয়ে তাদের ‘বিস্মৃতির অধিকার’ মঞ্জুর করে।     

৬# 'নাইন্টিন এইটি ফোর'-এর পৃথিবীতে সার্বক্ষণিক সক্রিয় ‘টেলিস্ক্রিন’ একইসাথে তথ্য সরবরাহকারী  এবং নজরদারীর যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। এছাড়া ব্যক্তিগত ও জনপরিসরগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন দ্বারা পূর্ণ। 

২০১৯ সালে স্মার্টফোন এই একই কাজ করে। একইসাথে ডিজিটাল দুনিয়ার জানালা এবং ডেটা দালাল থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া পর্যন্ত প্রাইভেট কোম্পানিগুলো আমাদের প্রতিটি কাজে নজরদারি করে। অথচ আমাদের পৃথিবী অরওয়েলের কল্পিত বিশ্বের চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ যেখানে প্রতিটি ঘড়ি থেকে ফ্রিজ, থার্মোস্ট্যাট , টোস্টার সমস্ত ব্যবহার্য জিনিসই দিনে দিনে ইন্টারনেটে সংযুক্ত হচ্ছে। আর এগুলো আমাদের যাপনের তাৎক্ষণিক 'ডকুমেন্টারি' সম্প্রচার করছে এই প্রাইভেট নজরদারিত্বের সাম্রাজ্যে।

৭# 'নাইন্টিন এইটি ফোর' বইতে রাষ্ট্রই তার নজরদারির সাম্রাজ্যকে কাজে লাগাতো শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে।

২০১৯ সালে এসে রাষ্ট্রের পাশাপাশি এই ভূমিকায় এসেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর (গুগল, ফেসবুক, অ্যাপল ইত্যাদি) পরিসর এতো বড় যে, তারা মোটামুটি জবাবদিহীতার উর্ধ্বে থেকে আমাদের নজরদারি করে, মনিটাইজ করে ও নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগায়।

৮# 'নাইন্টিন এইটি ফোর'-এর দুনিয়ায়, সরকার প্রত্যেক নাগরিকের মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত করতে চায়। 

২০১৯ সালে এসে প্রাইভেট কোম্পানিগুলো একই কাজ করে। তারা প্রত্যেক ব্যবহারকারীর আচরণ ও চাহিদার  প্রোফাইল তৈরি করে। সেগুলো যাচাই বাছাই করে সাধারণ মানুষদের প্ররোচিত করে এমন আচরণের দিকে নিয়ে যায়, যেসব কার্যকলাপ সহজেই নজরদারির ভিতর রাখা যায়।  

৯# 'নাইন্টিন এইটি ফোর'-এর পৃথিবীতে, সরকার নাগরিকদের প্রতিনিয়ত নজরদারি করতে মেশিন ও মানুষের এক বিশাল দলকে তহবিল যোগাতো।

২০১৯ সালে এসে, নাগরিক সমাজ নিজেরাই নিজেদের উপর নজরদারির এই সাম্রাজ্যের দরকারী যন্ত্রপাতি বা লোকবলের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেয়। নাগরিকেরা সর্বশেষ ডিজিটাল যন্ত্রপাতি, হালনাগাদ বা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিগত ও অন্তরঙ্গ তথ্যের অধিকার অবাধে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে দিয়ে দেয়, যা রাষ্ট্রও চাইলে পেতে পারে। বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট সেবার জন্যে অর্থ খরচ নাগরিকদের পকেট থেকেই যায়।

১০# 'নাইন্টিন এইটি ফোর'-এ, দানবীয় এই নজরদারির চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে টেকসই আর সংহত রাখা।

২০১৯ সালের পৃথিবীতে, অনলাইন দুনিয়ার দানবীয় নজরদারির এই সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে এই সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর ক্ষমতাকে টেকসই আর সংহত করা।

 

সব মিলিয়ে, 'নাইন্টিন এইটি ফোর' প্রকাশের ৭০ বছর পরে, নজরদারিভিত্তিক রাষ্ট্রের ব্যাপারে অরওয়েলের প্রায় সমস্ত ভাষ্য সত্য প্রমাণিত হয়েছে। একমাত্র পার্থক্য হলো অরওয়েল নজরদারি আর নিয়ন্ত্রণকে শুধু রাষ্ট্রের ব্যাপার হিসেবে দেখিয়েছিলেন, আর বর্তমান বাস্তবতায় প্রতিটি বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে আমাদের উপর নজর রাখছে, নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের জীবনকে। আর নানান ভালো কাজের মোড়কে আবৃত এই নিয়ন্ত্রণ করছে শুধুমাত্র নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে।

সর্বোপরি, আমরা এখন দিনে দিনে এগিয়ে চলেছি আরও বেশি সেন্সরশিপ আর নজরদারির অরওয়েলীয় পৃথিবীর দিকে। ১৯৮৪ সালে না হলেও এর ৩৫ বছর পরে এসে এই ২০১৯ সালে আমরা অরওয়েলীয় পৃথিবীতেই বসবাস করছি। তাই, যে পৃথিবীতে আমরা আছি কিংবা সামনের দিনে যেদিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তাকে আরও ভালো করে বুঝতে সম্ভবত আমরা সবাই সময় করে 'নাইন্টিন এইটি ফোর'-এর পুনর্পাঠ নিতে পারি।    

 

[ ফোর্বস ম্যাগাজিনে ৬ মে, ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত কালেভ লিটারুর লেখা আর্টিকেলের অনুবাদ।]

৪৭৫ পঠিত ... ১৬:২৫, জুন ১২, ২০১৯

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top