বন্ধুবর
গুলাম কুদ্দুসকে–
লোকসঙ্গীত ও বিদগ্ধ সঙ্গীতে যে পার্থক্য সেটা সহজেই আমাদের কানো ধরা পড়ে, তেমনি লোকসাহিত্য ও বিদগ্ধ সাহিত্যের পার্থক্য সম্বন্ধেও আমরা বিলক্ষণ সচেতন। আর্টের যে-কোনো বিভাগেই-নাট্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য-ত সে যাই হোক না কেন, এই বিদগ্ধ এবং লোকায়ত রসসৃষ্টির মধ্যে পার্থক্যটা আমরা বহুকাল ধরে করে আসছি।
তাই বলে লোকসঙ্গীত কিম্বা গণ-সাহিত্য নিন্দনীয় এ-কথা কোনো আলঙ্কারিকই কখনো বলেন নি। বাউল ভাটিয়াল বর্বরতার লক্ষণ কিম্বা বারমাসী যাত্রাগান রসসৃষ্টির পর্যায়ে পড়ে না, এ-কথা বললে আপন রসবোধের অভাব ঢাক পিটিয়ে বলা হয় মাত্র।
কিন্তু যখন এই লোকসঙ্গীত বা লোকনৃত্য শহরের মাঝখানে স্টেজের উপর সাজিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাড়ম্বরে শোনানো এবং দেখানো হয় তখনই আমাদের আপত্তি। যখনই বলা হয় এই সাঁওতাল নাচের সামনে ভরতনৃত্যম হার মানে কিম্বা বলা হয় এই ‘রাবণবধ’ পালা ‘ডাকঘরে’র উপর ছক্কা-পাঞ্জা মেরেছে–তোমরা অতিশয় বেরসিক বর্বর বুৰ্জ্জুয়া বলে এ তত্ত্বটা বুঝতে পারছে না, তখন নিরীহ বুজুয়া হওয়া সত্ত্বেও আপত্তি না করে থাকতে পারিনে।
কথাটা খুলে বলি। লোকসঙ্গীত (এবং বিশেষত গণ-নৃত্য) ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে পার্থক্য অনেক জায়গায় আছে, কিন্তু একটা পার্থক্য এস্থলে বলে নিলে আমার প্রতিবাদের মূল তত্ত্বটা পাঠক সহজেই ধরে নিতে পারবেন। এই ধরুন, সাঁওতাল কিংবা গুজরাতের গরবা নাচ। এগুলো গণ-নৃত্য এবং এর সবচেয়ে বড় জিনিস এই যে, এ নাচে সমাজ বা শ্রেণীর সকলেই হিস্যাদার। চাঁদের আলোতে, না-ঠাণ্ডা না-গরম আবহাওয়াতে জনপদবাসী যখন দুদণ্ড ফুর্তিফার্তি করতে চায়, তখন তারা সকলেই নাচতে শুরু করে। যাদের হাড় বড় বেশি বুড়িয়ে গিয়েছে তারা ঘরে শুয়ে থাকে, কিন্তু যারা আসে তাদের কেউই নাচ থেকে বাদ যায় না। হয় নাচে, না হলে ঢোল বাজায়—বাচ্চা কোলে নিয়ে আধ্যবয়সী মাদেরও নাচের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না। তাই বলা যোতে পারে সাঁওতাল কিম্বা গরবা নাচ-অর্থাৎ তাবৎ গণ-নৃত্যুই-নাচা হয় আপন আনন্দের জন্য, লোককে দেখানোর জন্য কিম্বা ‘লোক দেখানোর জন্য নয়। অর্থাৎ লোকনৃত্যে দর্শক থাকে না।
কিন্তু যখন উদয়শঙ্কর নাচেন তখন আমরা সবাই ধেই ধেই করে নেচে উঠি নে, কিম্বা যখন খানসায়েব চোখ বন্ধ করে জয়জয়ন্তী ধরেন তখন আমরা আর সবাই চেল্লাচেল্লি করে উঠি নে। ইচ্ছে যে একদম হয় না সে-কথা বলতে পারি নে, তবু যে করি নে। তার একমাত্র কারণ উদয়শঙ্করের সঙ্গে পা মিলিয়ে কিম্বা খানসাহেবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে রসসৃষ্টি আমরা এক মুহূর্তের তরেও করতে পারি নে। (যদি পারতুম। তবে উদয়শঙ্করের নাচ দেখবার জন্য, খানসাহেবের গান শোনবার জন্য গাঁটের পয়সা খরচ করতুম না-কিম্বা বলতে পারেন, সিংগীর গলায় আপন মাথা ঢোকাতে পারলে সার্কাসে যেতুম না)।
তাই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত কিম্বা নৃত্যের জন্য শ্রোতা এবং দর্শকের প্রয়োজন।
লোকনৃত্যে যখন সবাই হিস্যা নিতে পারে আপনি পা চালিয়েই, তখন এ কথা আশা করি সকলেই মেনে নেবেন যে, সে নৃত্য খুব সরল হওয়াই স্বাভাবিক। তাতে সূক্ষ্ম পায়ের কাজ থাকার কথা নয়, ভাবভঙ্গী প্রকাশের জন্য দুর্বোধ্য মুদ্রা সেখানে থাকতেই পারে না। এবং তাই বলা যেতে পারে, সে নৃত্যে আর যা থাকে থাকুক, বৈচিত্র্য থাকতে পারে না।
তাই গণ-নৃত্য মাত্রই একঘেঁয়ে।
কমুনিস্ট ভায়ারা (কমরেডরা) মনস্থির করেছেন গণ-কলা বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ কলা এবং সেই গণ-নৃত্য শহরে বুৰ্জ্জুয়াদের দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে হবে। তাই মেহন্নত, ততোধিক তাকলিফা বরদাস্ত করে তারা শহরে স্টেজ খাটান, পর্দা ঝোলান, রঙ-বেরঙের আলোর ব্যবস্থা করেন। আর তারপর চালান হৈদ্রাবাদী কিম্বা কুয়াম্বতুরেরও হতে পারে,— জানি নে, ধোপার নাচ। কিম্বা গুজরাতী গরীবা! বলেন, ‘পশ্য, পশ্য’—থুড়ি, দ্যাখ, দ্যাখ, এরেই কয় লাচ।’
পূর্বেই নিবেদন করেছি। গণ-নৃত্য নিন্দনীয় নয়, কিন্তু যে গণ-নৃত্য একঘেয়ে এবং বৈচিত্র্যহীন হতে বাধ্য, সেই নাচ দেখতে হবে ঝাড়া আধঘণ্টা ধরে? ঘন ঘন হাততালি দিয়ে বলতে হবে ‘মরি, মরি’? দু-চার মিনিটের তরে যে এ নাচ দেখা যায় না, সে কথা বলছি নে।
আলো-অন্ধকারে ভিন গাঁয়ে যাচ্ছেন, দেহ ক্লান্ত, মন অবসন্ন, চাঁদ উঠি উঠি করেও উঠছেন না–এমন সময় দেখতে পেলেন গায়ের মন্দিরের আঙিনায় একপাল মেয়ে মাথায় ছ্যাদা-ওলা কলসীতে পিদিম রেখে চক্কর বানিয়ে ধীরে ধীরে মন্দমধুর পা ফেলে নাচছে। জানটা তার হয়ে গেল। দুমিনিট দাঁড়িয়ে আলোর নাচ আর মেয়েদের গান, ‘সোনার দেওর, আমার হাত রাঙাবার জন্য মেহেদী এনেছ কি?’ দেখে নিলেন। কিন্তু তারপর? যে নাচ আস্তে আস্তে বিকাশের দিকে এগিয়ে যায় না, বিচিত্র অঙ্গভঙ্গ, পদবিন্যাসের ভিতর দিয়ে যে নাচ পরিসমাপ্তিতে পৌঁছয় না, সে নাচ দেখবেন কতক্ষণ ধরে? এ-নাচের পরিসমাপ্তি কোনো রসসৃষ্টির আভ্যন্তরীণ কারণে হয় না, এর পরিসমাপ্তি হয় নর্তকীরা যখন ক্লাস্ত হয়ে পড়েন তখনই।
আলো-অন্ধকার, চাদ উঠি-উঠি, শ্যাওলামাখা ভাঙা দেউলের পরিবেশ থেকে হাঁচিকা টানে ছিড়ে-নিয়ে-আসা নৃত্য শহরের স্টেজে মূৰ্ছা তো যায় বটেই, তার উপর মাইক্রোফোনযোগে চিৎকার করে তারস্বরে আপনাকে বলা হয়, ‘এ নাচ বড় উমদা নাচ-’। এ নাচ আপনাকে দেখতে হয় আধঘণ্টা ধরে! আধঘণ্টা ধরে দেখতে হয় সেই নাচ, যার সর্ব পদবিন্যাস মুখস্থ হয়ে যায় আড়াই মিনিটেই।
পনরো টাকার সীটে বসে (টাকাটা দিয়েছিলেন আমার এক গোলাপী অর্থাৎ নিমকমুনিস্টি কমরেড) আমি আর থাকতে না পেরে মুখে আঙুল পুরে শিটি দিয়েছিলুম প্ৰাণপণ। হৈ হৈ রৈ রৈ। মার মার কাট কাট। এ কী বর্বরতা?
আমি বললুম, ‘কেন বাওয়া, আপত্তি জানাবার এই তো প্রলেটারিয়েটস অব দি প্রলেটারিয়েট কায়দা।’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন