লেখা: শুভম মুখোপাধ্যায়
ছোটোবেলায় ইস্কুলে একটা জিনিষে সবচেয়ে বেশি চাপ লাগতো সেটা হলো, গার্জেন কল। ইস্কুলে যে কোনো শাস্তির একদম হায়েস্ট এবং অন্তিম পর্যায় ছিলো গার্জেন কল। আমাদের স্কুলে ছিলো একটা ডায়রি সিস্টেম। ক্লাসে কোনো অপরাধ করলে ডায়রিতেই লিখে দেওয়া হতো, যেমন একবার আমি ক্লাস চলাকালীন সিটি বাজিয়েছিলাম বলে স্যার ডায়রিতে লিখে দিলো, 'গার্জেন কল করা হয়েছে, অভিভাবককে দেখা করতে অনুরোধ করা যাইতেছে।'
তখন আমি নিজেই নিজের গার্জেন সেজে নীচে লিখে দিলুম্ 'ঠিক আছে, এখন কদিন ব্যস্ত আছি, পরে দেখা করবো', দিয়ে ক্লাসে স্যারকে বললুম, 'স্যার বাবা আসতে পারবে না বলছে!' ক্লাসের স্যার বিষয়টা ইগোতে নিয়ে নেয়, নীচে আবার লিখে দেয়, 'ব্যস্ত আছি মানে কী, আপনি দেখা না করলে ছেলের রেজাল্ট হাতে দেবো না।‘ তখন আমি আবার আমার বাবা সেজে নীচে লিখে আনি, 'দরকার নেই রেজাল্টের, আই ডোন্ট মাইন্ড!'
এরপর স্যার ডাইরেক্ট বলে বসে, 'এই তোমার বাড়ির ঠিকানা দাও তো, আমি গিয়ে দেখা করবো!' এবার স্যার বাড়ি চলে এলে তো আমার শনি! এটা ধরা পড়ে যাবে যে আমি বাপের সই নকল করে ডায়রিতে বাপ সেজে লিখছি। আমি স্যারকে বলে দিই, 'তার আর দরকার নেই স্যার, বাবা কালই দেখা করবে বলেছে।'
তারপর আমি পাড়ার একটা বড় ভাইকে বাবা সাজিয়ে স্কুলে দেখা করাই। সেই ভাই আমার ফলস্ বাপ সেজে ইস্কুলে আসে, স্যার যা বলে চুপচাপ শুনে নেয়, আর বলে আসে, 'চিন্তা করবেন না, বাড়ি গিয়ে এর চামড়া তুলে নেবো!' স্যারও চামড়া তোলার বিষয়টা শুনে মোটামুটি মেনে নেয় যে হ্যাঁ এটা তো একটা বাপের মতো কথাই হলো বটে।
তারপর বেশ কয়েকবার আমার গার্জেন কল হয়, আর ওই পাড়ার ভাইই বাপ সেজে প্রক্সি দিতো, কিন্তু একদিন চাকরি পেয়ে ওই ভাইটা অন্য কোথায় একটা চলে যায়, কিন্তু আমার আবার গার্জেন কল হয়।
এবার আমি অন্য পাড়ার আরেকটা কাকুকে বাবা সাজিয়ে স্কুলে নিয়ে আসি। তখন স্যার আমাকে বলে, ‘আরে আগেরবারগুলো যখন তোমার বাবা এসেছিলো একটু অন্যরকম দেখেছিলুম মনে হচ্ছে?’
আমি বলি: হ্যাঁ আমার বাবার প্লাস্টিক সার্জারি হয়েছে তো, তাই আলাদা লাগছে।
বাপের ভেকধরা কাকুটাও বলে: হ্যাঁ এই একটু প্লাস্টিক সার্জারি করলুম।
: কিন্তু গলাও তো আলাদা লাগছে!
: হ্যাঁ ভোকাল কর্ডেও একটা সার্জারি হয়েছে আর কি।
এইভাবে আমার গার্জেন কল চলতে থাকে, আর নতুন কাকু বাপ সেজে প্রক্সি দিতে থাকে। কেউ বুঝতে পারে না। তারপর এই কাকুটার একদিন বিয়ে হয়ে অন্য জেলায় চলে গেলো শ্বশুরবাড়ি ঘরজামাই হয়ে। কিন্তু গার্জেন কল আমার আবার হলো!
আবার আমি নতুন একটা ক্লাবের ভাইকে বাবা সাজিয়ে নিয়ে গেলুম। স্যার আবার সন্দেহ করলো যে এই ভদ্রলোক তো অন্যরকম, আমি বললুম, ‘হ্যাঁ আমার মায়ের সাথে বাবার ডিভোর্স হয়ে গেছে, এখন উনিই আমার বাবা।‘
স্যার আমার ফলস্ বাবাকে বললো: ওহ, তাহলে এ আপনার সৎ ছেলে?
বাপবেশী দাদা বললে, ‘সৎ ছেলে তো কী হয়েছে, বাড়ি গিয়ে চামড়া গুটিয়ে দেবো!’
স্যার বললো: তাহলে ঠিক আছে।
এভাবে অনেকদিন চলার পর আবার একদিন গার্জেন কল হলো, কিন্ত আমার বর্তমান প্রক্সি দেওয়া ভাইটার তখন পিলেজ্বর হয়েছে, সে বললে যেতে পারবে না, বদলে ওর একটা বন্ধুকে বাবা সাজিয়ে পাঠাতে পারে। আমি পড়লাম মহা সমস্যায়, বারবার বাবা বদলে গেলে তো খুব চাপ। কিন্তু এবার আমি একটা উপায় বের করলুম, কায়দা করে এবার আমি আমার নিজের বাবাকেই বললাম,
: বাবা মাস্টার মশাই তোমাকে দেখা করতে বলেছে, কিন্তু এই মাস্টারমশাই এর মাথায় একবার চোট লেগেছিলো, তাই মাঝে মাঝে উনি স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন, হট্ টেম্পার হয়ে যান, একেক সময় কী বলেন, কোনো মানে থাকে না, তাই কিছু মনে কোরো না।
বাপ বললো: ঠিক আছে।
আর স্যারকেও বললাম: স্যার আমার বাবার মাথায় একটু চোট লেগেছে, তাই মাঝে মাঝে স্মৃতি হারিয়ে ফেলে, হট্ টেম্পার হয়ে যায়, একেক সময় কী যে বলে, কোনো মানে থাকে না, তাই কিছু মনে করবেন না। কিছু এটাসেটা বললে শুনে নেবেন।
স্যার বললেন: ঠিক আছে, কিন্তু তোমার বাবা ভাগ্য দেখছি তো খুবই খারাপ!
বাবা ইস্কুলে গেলো।
তারপর ইস্কুলে স্যার আর বাবার কথোপকথন:
স্যার: আরেহ আপনি আবার কে!
বাপ: কে আবার? আমি ওর বাবা!
: কিন্তু ওর মায়ের কি আবার ডিভোর্স হয়ে গেছে?
: হেঁ হেঁ কী বলছেন কী, ডিভোর্স কেন হবে?
: ওহ আপনার তো আবার মনে নেই, আরে এর আগেও একজন বাবা ছিলো যার আবার প্লাস্টির সার্জারি হয়েছিলো!
: হেঁ হেঁ কী যে বলেন স্যার, তা আপনার মাথায় চোটটা কোথায় লেগেছিলো? খুব লেগেছিলো?
: আহা, আপনার এমন চোট লেগেছিলো, আপনার বুঝি মনে হয় পৃথিবীতে সবারই মাথায় চোট লেগেছে! তা আপনার বিয়ে কবে হলো?
: হেঁ হেঁ, বুঝতে পারছি আপনার চোটও খুব গুরুতর ছিলো!
তারপর আমার নামে স্যার বাবাকে বেশ কিছু নালিশ করে, বাবা বলে, ‘চিন্তা করবেন না বাড়ি গিয়ে ছাল তুলে নেবো।‘
স্যার বলে, ‘ঠিক আছে বেশী মারবেন না, আসলে এতবার বাবা পালটে যাচ্ছে তো ছেলের ওপর একটা মানসিক ধকল যাচ্ছে!’
বাড়ি আসার সময় বাবা আমাকে বলে, ‘মাস্টারমশাই তো ভারি আজব আজব কথা বলে, মানে যা নয় তাই!’
আমি বললুম, ‘হ্যাঁ বাবা, আসলে চোট খুবই গুরুতর ছিলো।‘
তারপর থেকে আমার যখনই গার্জেন কল হতো আমার নিজের বাপই যেতো, আর স্যার আর আমার বাবার কথোপকথনের কোনো মানে থাকতো না, কেউ কারো কথা বিশ্বাসও করতো না। শুধু আমি মাঝে মাঝে দুজনকেই মনে করিয়ে দিতাম, ‘চোট আসলে খুবই গুরুতর ছিলো কিনা!’
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন