আমাদের বাসার ফ্রিজটি যেভাবে আলমারি হয়ে গেল

৪৬৮৩ পঠিত ... ১১:১৯, মার্চ ২২, ২০১৭


আমাদের বাড়িতে খুব সম্ভবত ১৯৭৯-৮০ সালের দিকে একটি ঢাউস সাইজের সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্রিজ কেনা হল। এই নিয়ে বাসায় উত্তেজনার শেষ নেই। আমাদের মতো মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের জন্য সে সময় একটি ফ্রিজ কেনা ছিল বাড়াবাড়ি, হোক তা পুরানো। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে, আব্বার পরিচিত কেউ তাকে কথা দিয়ে ভজিয়ে এটা গছিয়ে দিয়েছে। কারণ আব্বা মানুষটাই এরকম। ঠিকমত পটাতে পারলে এবং পকেটে টাকা থাকলে, তাকে দিয়ে আস্ত একটা প্লেনও কেনানো সম্ভব ছিল। তা যে-ই কাজটা করুক না কেন, আমরা দারুণ খুশি হয়েছিলাম, বাসায় একটি বড়সড় ফ্রিজ পেয়ে।


শুধু আম্মা হইচই করে উঠেছিল, 'এই লোকটার (মানে আব্বার, আম্মা রাগ হলে আব্বাকে এই লোকটা বলতো) খেয়ে দেয়ে কাজ নাই। কোথা থেকে একটা ফ্রিজ কিনে আনলো। ঘরে কত কী দরকার, সেদিকে লক্ষ্য নাই আর উনি কিনে আনলো ফ্রিজ। উহ এই লোকটাকে নিয়ে আর পারি না। আমি যে কীভাবে এই সংসার চালাই' ইত্যাদি ইত্যাদি।

আম্মা যাই বলুক, আমরা তো ফ্রিজ চালু হওয়ার আগেই চারিদিকে ফোন করতে শুরু করলাম। সে সময় আব্বার চাকরির সুবাদে আমাদের বাসায় একটা ফোনও ছিল । এখনকার সময় হলে হয়তো সেলফি তুলতাম। ফোন পেয়ে কিছু কিছু উত্সাহী মানুষ চলেও এল ফ্রিজটি দেখার জন্য। এখনও মনে আছে শুধু ফ্রিজে রাখার জন্যই সাত তাড়াতাড়ি কিছু মিষ্টি আর আইসক্রিম কিনে আনা হয়েছিল।

শুধু কি তাই? খালার পাশের বাড়িতে ফোন করে ডেকে আনা হলো আমার খালাতো ভাই পিটুকে, তার নতুন ক্যামেরাটা নিয়ে। কারণ ছবিতো তুলতে হবে। পিটু ভাইরা বাসার সবাই প্রায় ৮/১০ জন মানুষ ফকিরাপুল থেকে আসাদগেট আমাদের বাসায় চলে এল সন্ধ্যার মধ্যেই। যথারীতি এল চাচার পরিবারের লোকেরাও। উদ্দেশ্য--ফ্রিজ দর্শন। আব্বার হইচইয়ে চুলায় চাপলো হাঁড়ি, রান্না হচ্ছে খিচুরি-মাংস।

তখন আমাদের বাসায় প্রতিদিন বাজার হতো। কিন্তু ফ্রিজটা কেনার পর এখানে রাখার জন্য বাজার একটু বেশিই করা শুরু হল, তা না হলে রাখব কী। বাজারপ্রিয় মানুষ আব্বার পোয়াবারো। খাবার দাবার কেনার পরিমাণ বেড়ে গেল। আম্মা রাগ করলেই আব্বার জবাব ছিল 'আরে ফ্রিজটা কী খালি পড়ে থাকবে?'


আজ বলতে লজ্জা নেই যে, আমরা বাসার সবাই ফ্রিজটার সামনে একবার করে ছবি তুলেছি। এমন কি যে আম্মা সবচেয়ে বেশি চেঁচামেচি করেছিল, সেও। এবং এটাও ঠিক, কী এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের ফ্রিজটা ছিল বসবার ঘরে। সরাইখানা টাইপ বাসাটাতে সারাক্ষণ এন্তার লোকজন আসা-যাওয়া করতো। এর মধ্যে গ্রামের মুন্সিজী থেকে অ্যাম্বাসেডর হুমায়ুন কবির চাচাসহ নানা ধরণের মানুষ। তাদের সামনে দিয়েই আমরা লজ্জা টজ্জা না পেয়েই তরিতরকারি, খাবার দাবার, পানি, দুধ, ডিম সবকিছু বের করতাম। এখন বুঝি কী কান্ডই না করেছিলাম সেই ফ্রিজটাকে নিয়ে।

এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেল । ফ্রিজটি এক সময় নষ্ট হতে শুরু করল। মিস্ত্রী ডেকে মেরামত করানো হয়, আবার নষ্ট হয়। এই ভাবেই চলছিল। আমাদের তখন এই অবস্থা ছিল না যে একটা কিছু নষ্ট হলে, তার জায়গায় আরেকটা কিনে আনবো। এইভাবে চলতে চলতে একদিন ফ্রিজটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল।

কিন্তু ফ্রিজটার প্রতি আমাদের ইতিমধ্যেই মায়া পড়ে গিয়েছিল, আর তাই এটি স্থায়ীভাবে নষ্ট হওয়ার পর অনেকে এটি বিক্রির কথা তুললেও আব্বার তাতে কোন সায় ছিল না। আছে, থাকুক। আহারে এতদিন আমাদের সাথে ছিল।

তারপর যা হওয়ার তাই হল, ফ্রিজটি দেখতে একই রকম থাকলেও, পরিণত হল এক ধরণের মিটসেফ টাইপ আলমারিতে। ওখানে আমরা বেশ অনায়াসেই বিস্কুটের কৌটা থেকে কাপ, গ্লাস, পান-সুপারি এমনকী দু একটা বাসন-কোসন, জুতা কাপড়ও রাখতে শুরু করলাম। বাসায় এমনও শোনা যেত, ছোট ভাই বাবেল হয়তো জিজ্ঞাসা করছে, 'আম্মা আমার মোজা কোথায়?' আম্মার উত্তর, 'ফ্রিজের মধ্যে খুঁজে দ্যাখ।' বাবেলও ওর মোজাটা ফ্রিজের মধ্যেই খুঁজে পেল। ক্রমেই আমরা ভুলে গেলাম এটা একটি ফ্রিজ। মনে হতো এটা ফ্রিজরূপী একটি আলমারি। 

৪৬৮৩ পঠিত ... ১১:১৯, মার্চ ২২, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top