আমার পুত্র নুহাশ

২৩০৫ পঠিত ... ১৬:৫৬, এপ্রিল ২৮, ২০২২

amar putro nuhash thumb (1)

আমার পুত্র নুহাশকে কে যেন জিজ্ঞেস করল, তুমি বড় হয়ে কি বাবার মতো লেখক হতে চাও? নুহাশ বলল, না।

কেন না?

নুহাশ গম্ভীর গলায় বলল, লেখক হলে খুব বেশি হাঁটাহাঁটি করতে হয়। সে সবসময় আমাকে দেখেছে লিখতে শুরু করেছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই লেখা বন্ধ করে বারান্দায় হাঁটছি। আবার লিখছি আবার হাঁটছি। সে ধরেই নিয়েছে হাঁটাহাঁটি লেখালেখিরই একটা অংশ। বাংলা একাডেমীর লেখক প্রকল্পের একজন আমাকে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার লেখালেখির প্রধান অনুপ্রেরণা কী? আমি গম্ভীর গলায় বললাম, হণ্টন।

একবার সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন একজনকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি এত ভালো সাঁতার কোথায় শিখেছেন? চ্যাম্পিয়ন বললেন, টিউবওয়েলে শিখেছি।

টিউবওয়েলে সাঁতার শিখলেন কীভাবে?

আমাকে কল চেপে বালতির পর বালতি পানি তুলতে হতো। সেটা করতে গিয়ে হাতের মাসল শক্ত হলো। সেখান থেকে সাঁতার।

আমার বেলাতেও কি তাই? হাঁটতে হাঁটতে পা শক্ত। যে কারণে দীর্ঘ সময় মাটিতে বসে থাকতে পারি। সমস্যা হয় না।

চেয়ার-টেবিলের যুগে আমি লিখি মেঝেতে বসে। তারাশঙ্করের আত্মজীবনীতে পড়েছি, তিনি মেঝেতে বসে টুলবক্সের মতো ছোট্ট জলচৌকিতে লিখতেন। জলচৌকির ডালা খোলা যেত। ডালার ভেতর থাকত কাগজ এবং কলম। আমার অনুপ্রেরণা তারাশঙ্কর না। চেয়ার-টেবিলে বসে লেখার সময় নিজেকে কেমন যেন অফিসের কর্মচারী মনে হয়। মেঝেতে ছোট্ট একটা জলচৌকি অনেক আপন, অনেক ঢিলেঢালা।

তবে কবি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টার সময় আমি অফিসার অফিসার ভঙ্গিতে সোফায় বসে লিখেছি। সেবছরই আমাদের নতুন সোফা কেনা হয়েছে। তখনো আমার নিজের লেখার জলচৌকি হয় নি। লেখালেখির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেঝেতে বসে করার চিন্তাও মাথায় নেই।

দেড় থেকে দু’ঘণ্টা কঠিন পরিশ্রম করে আমি বারো লাইনের একটা কবিতা (না-কি পদ্য) প্রসব করে ফেললাম। ঘটনার সমাপ্তি এখানে হলেই ভালো হতো, তা হলো না। খাম ডাকটিকিট কিনে আনলাম। দৈনিক পাকিস্তান-এর মহিলা পাতার সম্পাদিকাকে একটা চিঠি লিখলাম—

প্রিয় আপা,

সালাম জানবেন। আমার নাম মমতাজ আহমেদ শিখু।

আমি একটি কবিতা পাঠালাম…

 

মমতাজ আহমেদ আমার ছোটবোনের নাম। সে তখন ক্লাস টেনে পড়ে। আমার ধারণা হয়েছিল, ক্লাস টেনে পড়া একটি কিশোরীর কবিতা হিসাবে আমার কবিতাটা চলতে পারে।

কী সর্বনাশ! পরের সপ্তাহেই কবিতাটা ছাপা হয়ে গেল। আমার যারা পাঠক, তারা কিন্তু জীবনের প্রথম লেখা কবিতাটার দু’টা লাইনের সঙ্গে পরিচিত, কারণ এই দুটা লাইন আমি আমার দ্বিতীয় উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার-এ ব্যবহার করেছি।

দিতে পারো একশ ফানুস এনে

আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।

amar putro nuhash

প্রথম কবিতা ছাপা হয়ে যাওয়া কবির জন্যে বিরাট ব্যাপার। আমি সোফায় বসে কাব্যচর্চা করতেই থাকলাম এবং দৈনিক পাকিস্তান এ বেশ কিছু মমতাজ আহমেদ শিখুর কবিতা ছাপা হয়ে গেল। আল্লাহপাকের অসীম করুণা, কবিতা নামক সেইসব আবর্জনার এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই।

লেখায় সামান্য ভুল করলাম। মমতাজ আহমেদ শিখু নামে প্রকাশিত কবিতা আমার প্রথম কবিতা না। স্বনামে স্কুল-ম্যাগাজিনে প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছে। ঈশ্বর-বিষয়ক অতি উচ্চশ্রেণীর ভাব-বিষয়ক ইংরেজি কবিতা। কবিতার নাম ‘God’। কবিতাটা ছাপা হয়েছে কবির ছবিসহ। ছবির নিচে লেখা Humayun Ahmed Class X Section B. কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন মনে আছে—

Let the earth move

Let the sun shine

Let them to prove

All are in a line

Move এর সঙ্গে prove এর অন্তর্মিল। Shine এর সঙ্গে line,

মাইকেল মধুসূদন হবার চেষ্টা থেকে যে ইংরেজি কবিতা রচিত হলো, তা কিন্তু না। স্কুল-ম্যাগাজিনের দায়িত্বে যে স্যার ছিলেন, তাঁকে আমি বাংলায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী সবই লিখে জমা দিয়েছি। প্রতিটি রচনা পড়েই তিনি বলেছেন, মোটামুটি অখাদ্য। যাই হোক, তোর যখন এত আগ্রহ, তুই বরং ইংরেজিতে যা ইচ্ছা লিখে নিয়ে আয়, ছেপে দেব। ইংরেজি সেকশানে কোনো লেখা জমা পড়ে নি।

স্কুল-ম্যাগাজিন প্রকাশিত হবার কয়েকদিন পরের ঘটনা। আমাদের ক্লাসের ইংরেজির শিক্ষক (স্যারের নাম মনে করতে পারছি না) এক কপি স্কুল-ম্যাগাজিন হাতে ক্লাসে ঢুকলেন, এবং আমাকে মহালজ্জায় ফেলে আমার লেখা কবিতা পড়ে শোনালেন। তিনি তার ছাত্রের ইংরেজি কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ। কবিতা পাঠ শেষ হবার পর তিনি বললেন, হুমায়ূন, তুই ইংরেজি কবিতা লেখার চর্চা ছাড়বি না। আমি দোয়া দিলাম। খাস দিলে দোয়া দিলাম।

আমাদের ইংরেজি স্যার নিশ্চয়ই এখন জান্নাতবাসী। ইংরেজি কাব্য রচনায় স্যারের দোয়া কাজে লাগে নি। কিন্তু পুরোপুরি ব্যর্থ হয় নি। ইংরেজি কবিতা না লিখলেও কিছু গদ্য তো লিখেছি! যদিও একজন গদ্যকার কবির পদধূলিরও নিচে থাকেন। সমারসেট মমের একটি উদ্ধৃতি দেই।

The crown of literature is poetry. It is its end and aim. It is the sublimest activity of the human mind. It is the achivement of beauty and delicacy. The writer of prose step aside when the poet passes.

শেষ লাইনটা ভয়াবহ—’একজন কবি যখন যাবেন তখন একজন গদ্যকার পথ ছেড়ে দিয়ে একপাশে দাঁড়াবেন।’

এত সম্মান কবিদের!

আমার কবিতা (?) রচনা চলতেই থাকল। আমার একজন সহপাঠী বন্ধু (এখনকার বিখ্যাত কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা) চটি একটা কবিতার সংকলন নিজ খরচায় বের করলেন। সেখানেও তিনি আমার একটা কবিতা (নিতান্তই দয়াবশত) ছাপলেন। কয়েকটা লাইন এখনো মনে আছে—

রঙিন সুতার ছিপ ফেলে এক প্রজাপতি ধরতে গিয়ে

উল্টে পড়ে এই উঠোনেই।

মাগো, তোমার খুন হয়েছে বিশ বছরের যুবক ছেলে…

 

আমার কাব্যরোগ পুরোপুরি কীভাবে সারল সেই গল্প বলি। আমার কাব্যরোগের প্রধান এবং একমাত্র চিকিৎসকের নাম হুমায়ূন কবির (কুসুমিত ইস্পাতের কবি, দেশ স্বাধীন হবার পর আততায়ীর হাতে নিহত)। আমি তার কাছে তিনটা টাটকা কবিতা নিয়ে গেছি। টাটকা, কারণ গত রাতেই লেখা। চব্বিশ ঘণ্টা পার হয় নি। বাসি হবার সময় পায় নি। কবিতা বাসি হতে বাহাত্তর ঘণ্টা লাগে।

অধ্যাপক হুমায়ূন কবির বললেন, কী চাই?

আমি অতি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, তিনটা কবিতা নিয়ে এসেছি।

তাঁর কাছে কবিতা নিয়ে যাবার কারণ তখন বাংলা একাডেমী ঠিক করেছে গল্প, প্রবন্ধ এবং কবিতার তিনটি আলাদা সংকলন বের করবে। সংকলনগুলিতে প্রধান লেখকদের লেখা যেমন থাকবে, অপ্রধানদেরও থাকবে। অধ্যাপক হুমায়ূন কবির কবিতা সংকলনটির সঙ্গে যুক্ত। তার কৃপায় যদি বাংলা একাডেমী সংকলনে স্থান পাওয়া যায়। হুমায়ূন কবির বললেন, আপনার কবিতা কি কোথাও ছাপা হয়েছে?

আমি বললাম, জি-না।

ছন্দ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান আছে?

জি-না।

অন্যের কবিতা পড়েন?

জি-না।

তিনবার জি-না শোনার পর তিনি ছোট্ট একটি বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতা শুনে মনে খুব কষ্ট পেলেও তার প্রতিটি কথাই ছিল সত্যি। অবশ্যই কবিতা কোনো সস্তা বাজারি বিষয় নয়। কবিতা লিখতে যে মেধা এবং মনন লাগে, তার জন্ম এই ভুবনে না। কবিতার ছন্দ শিখতেই লাগে দশ বছর।

আমি ভগ্নহৃদয়ে তিনটা টাটকা কবিতা নিয়ে মহসিন হলে ফিরলাম। তিনটা কবিতাই বহুখণ্ডে ছেঁড়া হলো। রোগমুক্তির আনন্দ নিয়ে আমি Chemistry-র বই খুলে বসলাম। পড়াশোনা ঠিকমতো করতে হবে, ভালো রেজাল্ট করতে হবে। একসময় সংসারের হাল ধরতে হবে। আমার মতো দরিদ্র পরিবারের একটি ছেলের মহান কাব্যরোগ মানায় না। আমি কবিতা লেখা পুরোপুরি ছেড়ে দিলাম।

‘বলপয়েন্ট’-এর প্রথম কিস্তি এই পর্যন্ত লিখেছি। এইটুকুই ছাপা হবার কথা। পড়তে দিয়েছি শাওনকে। সে বলল, তুমি তো ভুল কথা লিখেছ। তুমি গদ্যলেখক সেটা ঠিক, কিন্তু সারাজীবনই তো প্রচুর কবিতা লিখেছ, গান লিখেছ।

আমি বললাম, এইসব ফালতু ফরমায়েশি জিনিস।

শাওন বলল, আমার সঙ্গে পরিচয়ের সময় প্রায়ই আমাকে চার লাইন, ছয় লাইনের কবিতা লিখে পাঠাতে। সেগুলি তো ফালতু না।

আমি বললাম, সেগুলি তোমাকে উদ্দেশ করে লেখা বলেই তোমার কাছে ফালতু কখনোই মনে হবে না। আসলে ফালতু।

শাওন স্যুটকেস খুলে একটা চিরকুট বের করে বলল, এখানের আTটা লাইন কি ফালতু?

আমি লাইনগুলি হুবহু তুলে দিলাম। পাঠক বিচার করবেন।

আমাকে নিয়ে নানা গল্প আছে

সেই গল্পে আছে একটা ফাঁকি

বিরাট একটা বৃত্ত এঁকে নিয়ে

ভেতরে নাকি আমি বসে থাকি।

কেউ জানে না শাওন, তোমাকে বলি

বৃত্ত আমার মজার একটা খেলা

বৃত্ত-কেন্দ্রে কেউ নেই, কেউ নেই

আমি বাস করি বৃত্তের বাইরেই।

২৩০৫ পঠিত ... ১৬:৫৬, এপ্রিল ২৮, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top