‘বাবা তোর জন্ম হয়েছে মানুষের মাথা বাঁচানোর জন্য’- সৃষ্টির পর আমার বাবা আমাকে এই কথাটি বলেছেন। আমার জন্ম জার্মানীর একটা শহরে, ভেবেছিলাম জার্মানীর মানুষের মাথা বাঁচানোর মহান দায়িত্ব পালন করতে করতে নিজের জীবনটা বিলিয়ে দেবো। কিন্তু সবাই যা ভাবে তা কী হয়? একদিন দেখলাম কারা যেন এসে আমাকে প্যাক করে জাহাজে তুলে ফেললো।
আমি চলে এলাম বাংলাদেশে। এসেই টেনশনে পড়ে গেলাম, কী এক শহর! এখানে সবাই বাইক চালায় কিন্তু কারো মাথায় হেলমেট নাই। তাহলে এখানে এসে আমার লাভ কী? যেহেতু আমি আপনাদের পাঠাও-উবারের ইউজ করা কম দামি হেলমেট না, বাজারে আমার একটা দাম আছে তাই। তবুও আমাকে কেউ কিনতো না। আমার মালিক বলতো, ‘বাংলাদেশটা এমনই। আসল মাল কেউ কিনে না।‘ কেউ না কিনলেও এই ভেবে আমার ভালো লাগতো যে আমি একটা আসল মাল। আর আসল মাল একদিন কেউ না কেউ কিনবে। যে কিনবে সেও একটা মাল। এরকম এক সকালে এক মাল আমাকে কিনে নিয়ে গেলো তার বাসায়। আমি তো খুব খুশি, অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষণ এলো। আমি এখন সত্যিই মানুষের মাথা বাঁচাতে পারবো। ভাবতেই ভালো লাগছে যে, এই মানুষটা আমাকে মাথায় দিয়ে বাইকে করে পুরো দেশ ঘুরবে, আমিও তার সাথে দেশটা একটু দেখবো। শুনেছি দেশটা অনেক সুন্দর।
কিন্তু একদিন যায়, তিনি আমাকে নিয়ে বের হন না। দু’দিন যায়, তাও বের হন না। তৃতীয় দিনে গিয়ে আমি যে সত্যিটা জানতে পারি সেইটা জানার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। এক সকালে উঠে জানতে পারি যিনি আমাকে কিনেছে তার কোনো বাইক নাই! বিশাল টেনশনে পড়ে গেলাম। সারা রাত ঘুম হতো না। শুধু ভাবতাম কী করবে আমাকে নিয়ে। আমাকে কী তবে ঘরে বসিয়ে রাখবে?
আরেক সকালের কথা। আমার মালিকের এক বন্ধু এসে ধুপ করে আমার মাথায় লাঠি দিয়ে একটা বাড়ি বসিয়ে দিয়ে বললো, ‘না মাল ঠিক আছে।‘ শুনেই খুশি হয়ে গেলাম, যে না এবার বোধহয় কাজের সুযোগ আসবে। সেদিন তারা আমাকে নিয়ে বের হলো, কিন্তু সাথে কোনো বাইক নাই। নিয়ে একটা জায়গায় রাখা হলো, সেখানে আগে থেকে আরো অনেক হেলমেট রাখা। অনেকদিন পর স্বজাতিদের দেখে ভালো লাগলো। সব হেলমেটদের সাথে পরিচয় হলো, তারা কেউ ইতালির, কেউ জার্মানীর, কেউ ইংল্যান্ডের কেউ বা নবাবপুর থেকে এসেছে। গরীব হলেও নবাবপুরের হেলমেটের সাথে একসাথে বসে গল্প করলাম। আর সবাই অপেক্ষা করতে থাকলাম। নিশ্চয়ই অনেকগুলা বাইক আসবে, আমাদের মাথায় নিয়ে রেস দেবে। কিন্তু ওমা সেকি! দ্রুত এসে সবাই মাথায় হেলমট পরলো ঠিক আছে কিন্ত কারো কাছে বাইক নেই। আছে হকিস্টিক লাঠি ইত্যাদি। যাই হোক, বাইক নাই এইটা তাদের ব্যাপার কিন্তু মাথা বাঁচানো আমাদের দায়িত্ব।
সেদিন আমি যার মাথায় ছিলাম তার মাথায় দুইজন লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়েছে। আমি সেভ করেছি। সেই থেকে বাইক না থাকলেও আমার মনিব আমাকে যত্ন নেয়া শুরু করেছেন। প্রতিদিন মুছে রাখতেন। এভাবেই দিন কাটছিলো। এরমধ্যে একদিন আমাকে নিয়ে গেলো টিএসসি। কোনো কাজ ছিলো না। কী জানি মিটিং মিছিল চলছিলো। শীতটা বেশি বলে আমারো একটু শীত শীত লাগছিলো। কিন্তু হুট করে দেখলাম অনেক দৌড়াদৌড়ি। কী হচ্ছে বুঝতে পারলাম না, শুধু শুনলাম, ‘এই লেখকের মাথা ফাইটে গেছে।’
কেউ একজন দ্রুত আমাকে নিয়ে সেই লেখকের মাথায় ভরে দিলো। কিন্তু আমি বুঝলাম না, লেখকের মাথা ফাটলে ব্যান্ডেজ না লাগিয়ে হেলমেট লাগাবে কেনো? যাকগে এই বাংলার অবস্থা বুঝি না। এখানে বাইক ছাড়া মানুষ হেলমেট ব্যবহার করে, আবার মাথা ফাটলে ব্যান্ডেজ না লাগিয়ে হেলমেট লাগায়।
অদ্ভুত লেখকের মাথায় বসে আছি... হ্যাঁ, আমিই সেই হেলমেট।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন