দেড়টার দিকে ঘুম ভাঙলে কিছু করার থাকে না বলেই ফেসবুকে ঢোকা, নাকি ফেসবুকে ঢোকার জন্যই এই ভররাত্রে ঘুম ভাঙা বুঝতে পারি না। কিন্তু সিগারেট খাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শীতের মধ্যে। আর তার সঙ্গে একবার ঠিকই ফেসবুকে ঢুকে যাই।
তবে, এখন তো তেমন কেউ নাই।
মানুষ চলে গেছে। ঘুমিয়ে গেছে। তাদের ফেলে যাওয়া কায়া আছে। সুখ আছে। খাবার আছে। ঘোরাঘুরি আছে। কাঁচা কবিতা ও আরো কাঁচা দর্শণ আছে। হাসিমুখ আছে।
আমি লাইক দিয়ে বেড়াই কিছুক্ষণ। কয়েকটা গম্ভীর দর্শণে, দুয়েকটা কবিতায়। আর শোয়ার আগে মনোহর ছবিতে।
তখনই, ঘুম ঘুম লাগা বালিশে, ফোনটা আবার জ্বলে উঠলে দেখি ম্যাসেঞ্জারে মজনু লিখেছে, 'নাবিলাকে লাইক দিলেন ক্যান ভাই?'
নাবিলাকে লাইক দিয়েছি কিনা আমি অবশ্য মনে করতে পারি না।
মজনু লেখে--পাঁচটা মিনিট আগেই দিছেন বাল। জানেন ওই ছবিটা নাবিলার সুইসাইড নোট?
তাড়াতাড়ি ফেসবুকে ঢুকি আবার। নাবিলা লিখে সার্চ দিলে অনেক নাবিলা আসে। অগণিত। এর মধ্যে কে সুইসাইড নোট লিখেছে? কে মরে যেতে চাইছে?
নাবিলার সুইসাইড নোট পাওয়া যায় অবশ্য। হাস্যমুখী ছবি দেখে বিভ্রান্ত হয়েছিলাম তখন। স্ট্যাটাসের এই নোটে সে পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছে। কারো কাছে ক্ষমা চায় নি অবশ্য, আর দায়ী করে নি কাউকেই!
৫৮ মিনিট আগে আপ করা ছবি। নাবিলা কি তাহলে এতক্ষণে মরে গেছে?
আমি দ্রুত ইমোকটিন পাল্টাই--লাইক থেকে চলে যাই স্যাডে। গিয়ে ফিরে আসি। বেরিয়ে আসি। ঘুমাতে যাই।
কিন্তু আমার ঘুম আসে না। বারবার মনে হতে থাকে কারো মরে যাওয়ার এমন আকুতিতে আমার লাইক দেয়া ঠিক হয় নাই। একেবারে ঠিক হয় নাই।
আমাকে আবার সিগারেট খেতে হয়।
আমাকে আবার ঘুমের প্রস্তুতি নিতে হয়। কিন্তু তারপরও আমার ঘুম আসে না। নাবিলা কি মরেই গেছে?
আমি মজনুর কাছে জানতে চাই, নাবিলা কি মরে গেছে?
মজনু কিছু জানাতে পারে না।
কিছুক্ষণ পর মজনুকে আমি আবারও প্রশ্ন করি--কিছু জানতে পারলেন?
মজনু ম্যাসেজ সিন করে উত্তর দেয় না। মানুষের চাইতে হারামি কিছু নাই!
নাবিলার সাথে আমার অবশ্য কখনো দেখা হয় নাই। তিন ঈদে ঈদ মোবারক লিখে পাঠিয়েছিলাম শুধু। প্রথমবার একটা লাইক দিছিল সে। পরে সিনও আর করে নাই। দেমাগ ছিল মনে হয়। কিন্তু তারপরও নাবিলা মরে যাচ্ছে/মরে যাবে/মরে গেছে এইসব ভাবতে কেমন লাগে। মনে হতে থাকে তার এমন নোটে আমার লাইক দেয়া ঠিক হয় নাই।
মজনুকে লিখি--পাইলেন কোনো খবর?
মজনু লেখে--ভাই ঘুমাইতে দেন।
আমি নাবিলার ছবিটায় আবার যাই। মজনু স্যাড ইমো দিয়ে রেখেছে। আমারও তো স্যাডই আছে। তবু আমি ঘুমাতে পারি না।
নাবিলাকে নিয়ে আমি লিখি।
নাবিলা হাস্যজ্জ্বল মেয়ে। ভালো মেয়ে। নাবিলা ফেসবুক ভরিয়ে রাখত। নাবিলা জীবন ভালোবেসেছিল। আহা, জীবন সে ভালো বেসেছিল!
আমরা মৃত্যুর আগে কী দেখিতে চাই আর...
জীবনানন্দের লাইন ঠুকে দিই লেখাটায়। মৃত্যুর সাথে জীবনানন্দ ছাড়া আর কে আছে? নাবিলার এলিজিতে জীবনানন্দ থাক।
এলিজি জমিয়ে রাখি ফোনের নোটবুকে। জমাতে জমাতেই আমার ঘুম আসে। ঘুমাতে ঘুমাতে মনে হয় মজনুও হয়তো এলিজি লিখেছে। মজনুর এলিজি কি আমারটার চেয়ে ভালো হয়ে গেছে? সকালে পড়তে হবে আগে। ও নিশ্চয়ই জীবনানন্দ ব্যবহার করবে না। মজনু তো মূর্খ একটা!
কিন্তু সকালে দেখি মজনু কোনো এলিজি লেখে নাই। অফিস যেতে যেতে আমি মজনুকে আবার লিখি--নাবিলার খবর কী?
মজনু সাথে সাথে উত্তর দেয়--বুঝতে পারতেছি না ভাই। কিছু জানতে পারি নাই।
কিন্তু কিছু না জানতে পারলে কীভাবে হবে?
অফিসে মিটিং হয়। মিটিংয়ে নানান সিদ্ধান্তের মধ্যেই মজনুকে লিখি--খবর পাইলেন কিছু?
না ভাই।
তাইলে কি বেঁচে আছে নাকি?
বুঝতাছি না ভাই।
মুশকিল!
হ ভাই। সবাই খোঁজ নিতাছে। কিন্তু কেউ বলতে পারতাছে না নাবিলা গেছে না আছে!
খুবই মুশকিল!
লাঞ্চ করতে আমার ভালো লাগে না। নাবিলা বেঁচে আছে না মরে গেছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।
তবে মরে গেলে নিশ্চয়ই জানা যেত। ফেসবুকে কেউ না কেউ লিখতো। অনলাইন পত্রিকারা রগরগে নিউজ করত। অনলাইনগুলো তো আছেই এই জন্য!
কিন্তু নাবিলা যদি একা থাকে? যদি দরজা বন্ধ করে মরে? নাবিলা যদি মরে! যদি মরে!
বিকালে মজনু চলে আসে অফিসে। ব্যাপারটার বিহিত সে করতে চায়। নাবিলার ফ্ল্যাট সে চেনে। আগে নাকি গেছেও একবার। একা একা। এবার সে আমাকে নিতে চায়।
সন্ধ্যায় আমরা নাবিলার ফ্ল্যাটে যাই। লোবানের গন্ধ পাই রাস্তা থেকেই। আমাদের মন খারাপ হয়ে যেতে থাকে। অন্তত মনে হতে থাকে যে আমাদের মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারি এলিজিটায় এই মন খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা, এই আসার কথা এইগুলো লেখার দরকার আছে। দরকার আছে এটা বলার যে আমরা সবার মতো না। আমরা মৃত্যু দেখতে আসছি।
কিন্তু নাবিলার ফ্ল্যাটে কোনো ক্রন্দন নাই। ক্রন্দন তো নাইই, আসলে কেউই নাই। নাবিলা আছে শুধু। নাবিলার হাসি আর কৃতজ্ঞতা আছে।
আপনারা সত্যিই আমাকে দেখতে আসবেন ভাবি নাই। অবশ্য আজ অনেকেই খোঁজ নিছে। আজকে ভালো আছি। মাঝে মাঝে তাও মরে যেতে ইচ্ছা করে।
নাবিলা হাসে।
নাবিলার হাসি আমাদের ভালো লাগে বোধহয়। মজনুও হাসে নাবিলার সাথে। নাবিলা ফ্রোজেন সমুচা খাওয়ায়। সমুচা খেতে খেতে আমাদের মধ্যে মানুষ নিয়ে কথা হয়। মানুষ যে হারামি এটা আমরা তিনজনই স্বীকার করে নিই।
নাবিলা বলে, তাও মানুষকে নিয়াই তো চলতে হয়।
মজনু বলে, এইটার কোনো গাছপাথর তো নাই।
আমি বলি, মানুষের মধ্যে থাকাটাই এখন মুশকিল!
মজনু বলে, খুবই মুশকিল!
নাবিলা হাসে।
মজনু বলে, আপনি যে সুইসাইডের কথা ভাবছেন এইটা ঠিকই আছে। আমরা সবাই এখন সুইসাইডের কথা ভাবি...
আমি বলি, শুধু সাহসীরা এইটা করতে পারে!
মজনু বলে, এইটা সাইন্টিফিকও...
আমি বলি, আধুনিকতার লক্ষণও আসলে...
নাবিলা হাসে। মজনু বিরক্ত হয়। কিন্তু কিছু বলে না। আমরা বিদায় নিয়ে চলে আসি। রিকশায় ফিরতে ফিরতে মজনু বলে, বেয়াদব মেয়ে। খুবই বেয়াদব। চিন্তা করেন ভাই, আমরা দেখতে গেছি, তাও সে মরে নাই!
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন