পঞ্চরত্নের নৌবিহার

১০২০ পঠিত ... ২২:২০, জুন ১০, ২০১৯

কার্টুন: জুনায়েদ

মা-বাবার ধারণা, তাঁদের জন্য আমি শুধু দুর্নামের সুনামি বয়ে এনেছি, কোনো সুনাম বয়ে আনতে পারিনি। ঘটনা সত্য। এ জন্যই কিছু সুনামের আশায় ঈদের রাতে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দিলাম। প্রধান মিশন টাঙ্গুয়ার হাওর দেখা। আমাদের মনে হয়েছে, ঈদের অনুষ্ঠান দেখার চেয়ে হাওর দেখা উত্তম! আমাদের মানে আমি, রাকিব, কিশোর, জুনায়েদ আজীম, পাভেল, মহিতুল আলম আর রেদওয়ান রিদন। টাঙ্গুয়া নামটা শুনলেই কেন যেন বাংলা ছবির ভিলেন গাংগুয়ার কথা মনে পড়ে। আমি তার মতো ভিলেন টাইপ হাসি দিয়ে বাসে উঠে গেলাম। রাস্তা ফাঁকা। রীতিমতো উড়াল দিল বাস। ড্রাইভারের জন্য মায়াই লাগছিল। বেচারা ওভারটেক করার মতো একটা গাড়িও পাচ্ছিলেন না। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে প্রবেশ করার আগেই আমরা ঘুমের জগতে প্রবেশ করলাম। ভোরের আগেই পৌঁছে গেলাম সুনামগঞ্জে। সাত-আট ঘণ্টার যাত্রা পাঁচ ঘণ্টায় শেষ করে ড্রাইভার প্রমাণ করলেন যে তিনি ফর্মুলা ওয়ান রেসিংয়ে অংশ নেওয়ার দাবিদার!

টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে হয় নৌকায়। আমরা তিন দিনের জন্য একটা নৌকা ভাড়া করলাম। নৌকার মাঝিও তিনজন। একজনের নাম আবার আবুল! এই আবুল খুবই লাজুক প্রকৃতির। কথাও বলেন কম। তিন দিন নৌকায় থাকতে হবে বলে আমরা বাজার-সদাই করে ফেললাম। ৩ সংখ্যাটার আধিক্য থাকায় মুরগিও কিনলাম তিনটা। মুরগিগুলো নৌকার পাটাতনের ডিজাইন পছন্দ করল না। তাই নিজেরাই প্রাকৃতিক কর্ম করে ডিজাইন বদলে দিল।

ইঞ্জিনের ঘট্ঘট্ আর মুরগির কক্কক্ আওয়াজের মাধ্যমে নৌকা ছাড়ল। কিছুক্ষণ নদীর শোভা দেখার পর রিদনের মনে হলো, অনেক দেখেছি, মেমোরি ফুল। সে ইঞ্জিনের সামনে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ইঞ্জিনের বিকট শব্দেও যে কেউ ঘুমাতে পারে, সেটা আমি কেন, ওকে না দেখলে স্বয়ং ইঞ্জিনও তা বিশ্বাস করত না। চারদিকে পানি, মাঝখানে আমাদের নৌকা। হঠাত্ নৌকা থামল। কো-পাইলট আবুল জানালেন, প্রপেলারে লতা আটকে গেছে। কাটতে হবে! ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী কাটবেন? প্রপেলার?’ ‘না, লতা কাটুম।’ বলেই তিনি বঁটি নিয়ে পানিতে নেমে গেলেন। দুপুরের খাওয়া সারলাম নৌকাতেই। মাঝির রান্নার স্বাদ কোনোদিন ভোলা যাবে না। এত জঘন্য রান্না কি ভোলা যায়?

সন্ধ্যা হলো, সূর্য নামে পাটে, নৌকা এল তাহিরপুরের ঘাটে। সেখানকার এক রেস্টহাউসে থাকার ব্যবস্থা। এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে নাকি খুব ডাকাতি হয়? লোকটি আমাদের কথা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, এখানে কোনো ডাকাতি হয় না, শুধু মার্ডার হয়!

রাতের খাওয়া শেষে এলাকা পরিদর্শনে বের হলাম। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেন লম্বা চুলের অধিকারী জুনায়েদ ভাই। নীলক্ষেত মোড়ে একটা এলিয়েনকে বাদাম খেতে দেখলে আমরা যেভাবে তাকাব, জুনায়েদ ভাইকে দেখে তারা সেভাবেই তাকাচ্ছিল। এক পিচ্চি তো বলেই ফেলল, ‘আইসে এক চুইল্লা। হে লম্বা, হের চুল লম্বা, হের টুপিও লম্বা!’

পরদিন আবার রওনা দিলাম। সারা রাত ঘুমানোর পরও ইনিংস অব্যাহত রাখল রিদন। ইঞ্জিন চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে ঘুমিয়ে পড়ল। মৃদু শব্দ না থাকলে সে নাকি ঘুমাতে পারে না। শুনে আমি নৌকার ছাদ থেকে পড়লাম। ইঞ্জিনের এই শব্দ যদি মৃদু হয়, তাহলে তো নেতাদের ভাষণের শব্দ ওর কানেই ঢুকবে না। ওদিকে পাভেল মোবাইলে ফেসবুক খুলে বসেছে। ওর ফেসবুক ব্যবহার দেখে নিশ্চত হলাম, নৌকায় বসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ফেসবুকিং করার বিশ্বরেকর্ডটা পাভেলের দখলে। জুনায়েদ ভাই একের পর এক ছবি তুলছেন। ক্যামেরার চার্জ শেষ হয়ে গেলে তাঁর চার্জও শেষ হয়ে যায়। রিদনের পাশে শুয়ে তিনিও নাক ডাকতে থাকেন। তবে ইঞ্জিনের আওয়াজের কারণে তা ভালোভাবে শোনা যায় না।

অবশেষে আমরা টাঙ্গুয়ার হাওর দেখলাম। সে এক অপূর্ব জায়গা। স্বচ্ছ পানির নিচে জলজ উদ্ভিদের বন। পানির নিচ থেকে বিরাট বিরাট গাছ উঠে গেছে। হঠাত্ দেখি, গাছের ডালে একটা ইঁদুর। সারা জীবন পড়ে এসেছি, গাছে পাখি, খোলো আঁখি; আর এখন দেখি গাছে ইঁদুর! চারপাশে পানি, কোনো ডাঙা নেই। ইঁদুরটা এখানে এল কী করে, তা নিয়ে গবেষণা চলল। ততক্ষণে নৌকা ছেড়ে দিয়েছে। আমরা যাচ্ছি ট্যাকেরঘাট নামক জায়গায়। সেখানে বাংলাদেশ-ভারত বর্ডার। গিয়ে দেখি কিসের কি! বর্ডারের পিলারে লেখা ভারত-পাকিস্তান! আমাদের মাথা গরম হয়ে গেল। সেটা রোদে, নাকি অন্য কিছুতে, তা বোঝা কঠিন। ঝরনার পানিতে মাথা ঠান্ডা করে বারিকাটিলা আর জাদুকাটা নদী দেখতে বাইকে উঠলাম। বাইকচালক আস্তে চালাতে পারেন না। আমাদের বললেন, টানতে পারছেন না, তাঁর হাতে ব্যথা। কদিন আগে অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন তো। আমরা ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘তা তো দু-একবার হতেই পারে।’ উনি প্রতিবাদ করলেন, ‘কী কন? কত করলাম! প্রায়ই তো করি। এই সেদিন এক লোকের গায়ে বাইক উঠায় দিলাম। যাত্রী ভয়ে লাফ দিয়ে পড়ে হাত-পা ভাঙল। বাইকের কিছু হয় নাই। শুধু ভিউ মিরর দুইটা ভাইঙ্গা গেসে!’ তখন খেয়াল হলো, বাইকের রিয়ার ভিউ মিরর নেই! চালক বললেন, ‘শক্ত হইয়া বসছেন ক্যান? রিল্যাক্স! হাত ছাইড়া বসেন। হাত ছাইড়া না বসলে বাইকে চইড়া মজা নাই।’ আমি হাত ছেড়ে দিলাম। কতটা রিল্যাক্সে ছেড়েছি, তা আর বললাম না। 

টিলা আর নদী দেখে আমরা আবার তাহিরপুর ফিরে এলাম। রাতটা সেখানে থেকে পরদিন ফিরে    এলাম ঢাকায়। বাসায় ঢুকে আয়নায় চোখ পড়তেই দেখি, ইয়াল্লাহ!  আমার মুখের কেসিং বদলে গেছে। কালো কেসিং! এই চেহারা দেখে যে কেউ বলবে, আমার জন্ম লোডশেডিংয়ের সময়। খোঁজ নিয়ে জানলাম, অন্যদেরও একই অবস্থা। জুনায়েদ ভাইয়ের ব্ল্যাক ভার্সন দেখার জন্য প্রতিবেশীরা ভিড় করছে। কী আর করা! আমরা পাঁচজন এখন আগের চেহারায় ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। রং ফরসাকারী ক্রিম যে কোনো কাজের না, তা আবারও প্রমাণিত হচ্ছে। বাসার সবাই নানাভাবে খোঁচা দিচ্ছে, ‘ব্ল্যাক হতে চাও? হাওরে যাও!’ কী বিপদ! এ জন্যই হাসন রাজা বলেছেন, ‘লোকে বলে, বলে রে ঘরবাড়ি ভালা না আমার’!

১০২০ পঠিত ... ২২:২০, জুন ১০, ২০১৯

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top