এলেবেলে : প্রধান অতিথি হওয়ার প্রধান বিরক্তিসমূহ

২৩২৪ পঠিত ... ২১:৪১, জানুয়ারি ০২, ২০১৮

আমাদের পাড়ায় 'সাহিত্য বাসর' নামে চেংড়া ছেলেপুলেদের কি যেন একটা আছে। এদের কাজ হচ্ছে দু'দিন পর পর মাইক লাগিয়ে পাড়ার সবাইকে বিরক্ত করা। গল্প পাঠের আসর, কবিতা সন্ধ্যা, ছড়া বিকেল, বৃন্দ আবৃত একটা না একটা লেগেই আছে। এসব ঝামেলা ঘরে বসে সেরে ফেললেই হয় তা করবে না। প্যান্ডেল খাটাবে, মাইক ফিট করবে- বিরাট জলসা। পয়সা কোত্থেকে পায় কে জানে। দেশ যখন বন্যার পানিতে ডুবে গেল তখন 'সাহিত্য বাসরে' অনুষ্ঠানের ধুম পড়ে গেল। বন্যার্তদের সাহায্যার্থে কমিক অনুষ্ঠান, বিচিত্রা অনুষ্ঠান, আনন্দ মেলা। এই পর্যায়ের শেষ অনুষ্ঠানটি হল 'আপনার কি আছে?' আগে ব্যাপারটি সম্পর্কে আপনাদের একটু বলে নেই, তারপর মূল ঘটনায় যাব।

ছুটির দিন সকাল বেলায় আরাম করে দ্বিতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছি সাহিত্য বাসরের দল বল উপস্থিত। সবার মুখেই হাসি। হাসি দেখেই আঁতকে উঠতে হয়। কারণ এরা সহজে হাসে না। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম কি ব্যাপার?

: আমরা মারাত্মক একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি স্যার। নাম হচ্ছে 'আপনার কি আছে?' বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য।
: বাহ খুব ভাল।
: একটা ইউনিক আইডিয়া। গান-বাজনা কিচ্ছু না। ফাকা স্টেজ। স্টেজের মাঝখানে একজন ভিখারী বসে থাকবে গায়ে কোন কাপড় নেই। শুধু কলাপাতা দিয়ে লজ্জাটা ঢাকা। তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে মাইকে বলা হবে- 'আপনার অনেক আছে। এর কিছুই নেই। একে কিছু দিন।' তখন দর্শকদের মাঝখান থেকে একজন উঠে আসবে। সে তার মানিব্যাগ শার্ট-গেঞ্জি এসব দিয়ে দিবে। প্রচন্ড হাততালি। ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক- 'ঐ মহামানব আসে।' কেমন আইডিয়া স্যার?
: খুব ভাল। তোমাদের ধারণা লোকজন সব স্টেজে এসে সব খুলে দিয়ে চলে যাবে?
: শুরুতে যাবে না তবে প্রথম কয়েকজন যখন সাহস করে যাবে তখন ফ্লো এসে যাবে। আপনিতো জানেন স্যার বাঙ্গালী হচ্ছে হুজুগে জাতি। ফ্লোর উপর চলে।
: তা ঠিক।
: এখন আপনি হচ্ছেন আমাদের ভরসা।
আমি মনের উদ্বেগ বহুকষ্টে চাপা দিয়ে বললাম- আমি ভরসা মানে?
: প্রথম যে মানুষটি যাবে সে হচ্ছে আপনি। এ পাড়ায় আপনার একটা ইজ্জত আছে। প্রফেসর মানুষ, প্রথম আপনি গেলে অন্য রকম এফেক্ট হবে। একটু হাইড্রামা, স্যার করতেই হবে উপায় নেই।
: কি রকম হাইড্রোমা?
: সব কাপড় চোপড় আপনাকে খুলে ফেলতে হবে। তারপর আমরা আপনাকে ঠিক ভিখিরীর মত একটা কলাপাতা দিয়ে জড়িয়ে দিব। আপনি কিন্তু না বলতে পারবেন না। রিকোয়েস্ট। আমি কি করে সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম সেই দীর্ঘ কাহিনী বলতে চাই না তবে অনুষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত কি রকম হল সেটা বলছি।

অনুষ্ঠান শুরু হল সন্ধ্যায়। প্রধান অতিথি চলে এলেন। তার নাম বলছি না। কারণ ইনি একজন পেশাদার প্রধান অতিথি। সবাই একে চেনেন। ঢাকা শহরের শতকরা আশি ভাগ অনুষ্ঠানে তিনি হয় প্রধান অতিথি কিংবা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন। চমৎকার একটি বক্তৃতা দেন। যে ফুলের মালা দেয়া হয় সেটি তিনি একটি শিশুর গলায় পরিয়ে অত্যন্ত নাটকীয় কায়দায় শিশুটির কপালে চুমু খান। তখন বিক্ষিপ্তভাবে হাততালি পড়ে। যাই হোক এই প্রধান অতিথি ভদ্রলোক সম্ভবতঃ অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আগে কিছু জানতেন না। যখন দেখলেন স্টেজে কলাপাতা গায়ে এক নেংটো ভিখারী বসে আছে তখন স্বভাবতঃই ঘাবড়ে গেলেন।

তারপর যখন মাইকে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য বলা হল তখন প্রধান অতিথি শুকনো গলায় বললেন, এসব এরা কি বলছে? হোয়াট ডু দে মিন?

আমি তাঁকে সাহস দেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু ততক্ষণে মাইকে উদাত্ত গলায় বলা হচ্ছে- 'এবার আমাদের অনুষ্ঠানে প্রথম যিনি তার সর্বস্ব দিয়ে এক অনুপম আদর্শের সূচনা করবেন তিনি হচ্ছেন আমাদের অতি আদরের প্রধান অতিথি বিশিষ্ট সাহিত্য বোদ্ধা, অনলবর্ষী বক্তা, সমাজের বন্ধু, অভাজনের চোখের মনি-'

প্রধান অতিথি কাঁপা গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'দৌঁড়ে পালিয়ে যাবার কোন উপায় বোধহয় নেই?' আমি কোন উত্তর দিলাম না। সাহিত্য বাসরের কর্মীরা কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ঠেলাঠেলি করে স্টেজে পাঠিয়ে দিল।

ব্যাকগ্রাউন্ডে গান হতে লাগল 'ঐ মহামানব...ও...আসে।' যে রকম আশা করা হয়েছিল সে রকম হ'ল না। বাঙালি হুজুগে জাতি হলেও এই হুজুগে তারা মাতালো না, দ্রুত মাঠ খালি হয়ে গেল। শুধু প্রধান অতিথি একটি কলাপাতায় লজ্জা নিবারণ করে ত্রিভঙ্গ মুরারী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

পাঠক পাঠিকারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন গলায় ফুলের মালা, সামনে পিরিচে ঢাকা পানির গ্লাস নিয়ে যিনি শান্ত সমাহিত ভঙ্গিতে বসে থাকেন তাঁকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অন্য শ্রোতাদের মতো ঘুমিয়ে পড়তে পারেন না। অসুবিধা জায়গায় চুলকানি শুরু হলে চুলকাতে পারেন না। হাসি মুখে বসে থাকতে হয় এবং ভান করতে হয় বিমলানন্দ উপভোগ করছেন। প্রফেশনালরা এই কাজটি ভালই করেন। অসুবিধা হয় যাঁরা প্রফেশনাল না তাঁদের। আমার নিজের দেখা একটা দৃশ্য বলছি। 'বাংলাদেশ পুষ্পপ্রেমী'দের একটি অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি হচ্ছেন হাজী আসমত আলি ব্যাপারী। ইনি কিছুদিন হল শুকনা মরিচের ব্যবসা করে প্রচুর পয়সা করেছেন। তাঁকে প্রধান অতিথি করার একটিই উদ্দেশ্য কিছু পয়সা-কড়ি পাওয়া।

হাজী আসমত আলি ব্যাপারী চোখ বড় বড় করে দু'ঘন্টার মত সময় মূর্তির মত কাটালেন। তারপরই সম্ভব অসম্ভব জায়গায় চুলকাতে শুরু করলেন এবং বিকট মুখভঙ্গি করতে লাগলেন। উদ্যোক্তারা বিপদ দেখে চট করে সভা সমাপ্ত করলেন। প্রধান অতিথিকে বক্তৃতা দেবার জন্য নিয়ে যাওয়া হলে এবং কানে কানে বলা হল ফুলের উপর দু'একটি কথা বলবেন। বেশী কিছু বলার দরকার নেই।
হাজী সাহেব শুরু করলেন গোলাপ দিয়ে। গোলাপের বর্ণ গন্ধ এইসব নিয়ে প্রচুর উচ্ছ্বাস করে বললেন- গোলাপ হচ্ছে আমাদের জাতীয় ফুল।

তাঁকে কানে কানে বলা হল গোলাপ নয়, শাপলা হচ্ছে আমাদের জাতীয় ফুল। তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, কোন শালায় বলে শাপলা জাতীয় ফুল? কোথায় গোলাপ আর কোথায় শাপলা। কোথায় আইয়ুব খান আর কোথায় খিলি পান। ভাইসাব আপনারা বলেন- শাপলা কি একটা ফুল? শাপলা হচ্ছে একটা তরকারি।

বুঝতেই পারছেন প্রফেশনাল নন এসব লোকদের প্রধান অতিথি করা খুব রিস্কি ব্যাপার। আবার প্রফেশনালদের নিয়েও কিছু সমস্যা আছে। এরা এই কাজ করতে করতে একটু বেশী রকম আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েন। যা নাকি মাঝে মাঝে জটিলতার সৃষ্টি করে। আমি এরকম একজনকে চিনি। তিনি সভাতে এসেই খোঁজ নেন সভা কতক্ষণ চলবে। সময়টা জেনে নিয়ে চট করে ঘুমিয়ে পড়েন। দর্শকরা কেউ তা বুঝতে পারে না। সবাই ভাবে চোখ বন্ধ করে মনোযোগে তিনি শুনছেন! সভা শেষ হবার আধঘন্টা আগে জেগে উঠেন এবং যথাসময়ে একটি চমৎকার বক্তৃতা দেন। একবার গণ্ডগোল হয়ে গেল।

উদ্যোক্তারা বলছে অনুষ্ঠান তিনঘন্টার মত চলবে। সেই হিসাবে তিনি গভীর নিদ্রায় অভিভূত হলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান দু'ঘন্টার মধ্যে শেষ হয়ে গেল। তাঁকে জাগান হল। তাঁর ভাবভঙ্গি দিশাহারার মত। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। ধরাধরি করে মাইকের সামনে নেয়া হল। তিনি কিছুই বলছেন না। একজন কানে কানে বলল, স্যার কিছু বলুন। তিনি হুংকার দিলেন, কেন?

: স্যার আপনি প্রধান অতিথি।

তিনি এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। দর্শকদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠল এবং এক সময় সবাইকে হতভম্ব করে তিনি বলে উঠলেন, 'যুথির মা আমাকে আধা কাপ চা দাও।'
প্রধান অতিথি প্রসঙ্গে আমার নিজের একটি ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা আছে। বেশ অনেকদিন আগের কথা। একদল ছেলে এসে আমাকে ধরল প্রধান অতিথি হতে হবে। আমি এক কথায় রাজি। ওদের বলে দিলাম নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে আমি উপস্থিত থাকব। চারটার সময় যাবার কথা। আমি অবশ্যি চারটার সময় গেলাম না। প্রধান অতিথি বিশেষ অতিথি এদের একটু দেরীতে উপস্থিত হতে হয় এটাই নিয়ম। আমি কুড়ি মিনিটের মত দেরী করলাম। অনুষ্ঠান তখন শুরু হয় নি। কিন্তু কি সর্বনাশ! ডায়াসে প্রধান অতিথি বিশেষ অতিথি দু'জনই উপস্থিত। একি কাণ্ড! আমি কি করবো ভাবছি। উদ্যোক্তাদের একজন এগিয়ে এসে নীচু গলায় বলল, আপনি হচ্ছেন স্যার স্ট্যান্ডবাই প্রধান অতিথি। আসল জন না এলে আপনাকে বসিয়ে দিতাম।

: বলো কি তুমি?
: কি করবো স্যার বলেন। কেউ কথা রাখে না। বলে আসবে কিন্তু আসে না। এই জন্য স্ট্যান্ডবাই রাখতে হয়। আসেন স্যার এক কাপ চা খান। চা না খেলে বুঝব আপনি রাগ করেছেন। 

গেলাম চায়ের দোকানে। সেখানে আরেকজন স্ট্যান্ডবাই বিশেষ অতিথি বিমর্ষ মুখে বসে আছেন। আমাকে দেখে মুখ কালো করে বললেন, আমি একা এলে একটা কথা হত। স্ত্রী এবং ছোট শালী নিয়ে এসেছি, এদেরকে কি বলি? আপনি বলুনতো ভাই?

আমি উনাকে কি বলবো আমি নিজেও আমার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছি। জীবনের প্রথম প্রধান অতিথি আর স্ত্রী সেটা দেখবে না, তা কি হয়?

২৩২৪ পঠিত ... ২১:৪১, জানুয়ারি ০২, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top