হিমু এবং আবারও ডুব

৩০০১ পঠিত ... ২২:৩৪, নভেম্বর ১৩, ২০১৭

ঘুম ভাঙল মেসের বোর্ডারদের হইচইয়ে। দোতলার মজিদ সাহেব এসে বললেন, 'আরে হিমু ভাই, শুনছেন? কাল রাতে নাকি ভূমিকম্প হয়েছিল!' আমি একটা লম্বা হাই তুললাম। ভূমিকম্প নিয়ে এত উত্তেজিত হবার কী আছে। ইদানিং প্রায়ই হচ্ছে। মা বসুন্ধরা কেঁপে উঠছেন। জানান দিচ্ছেন তার বিশালতার কাছে আমরা কতটা ক্ষুদ্র।

বিছানা ছাড়লাম। মোড়ের দোকানের ছোট ছেলেটা চা নিয়ে এসেছে। হাতমুখ ধুয়ে-টুয়ে চা খেয়ে বের হলাম। বন্ধু ইয়াদের সাথে দেখা করবার কথা। বলেছে অবশ্যই যেন সকাল দশটার মাঝে উপস্থিত হই। অতএব দুটার আগে যাবার কোনো মানেই হয় না।

হেঁটে হেঁটে মৌচাক মালিবাগ এলাকায় চলে এলাম। বহুদিন এদিকে আসা হয়নি। ফ্লাইওভারের কাজ চলছিল। কন্সট্রাকশন সাইটে খালি পায়ে হাঁটাহাটি বেশ কষ্টকর ব্যাপার। এখন কাজ শেষ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন। নিচতলার জ্যাম উন্নত হয়েছে দোতলা তিনতলা পর্যন্ত। আমরাও জাতি হিসেবে আরও উঁচুতে উঠেছি।

হাঁটতে হাঁটতে মোবাইল ফোনে চোখ বুলাতে লাগলাম। এই সেট মাজেদা খালার দেওয়া। রূপা আইফোন গিফট করতে চেয়েছিল, রাজি হইনি। এখনকার স্মার্টফোনগুলোর যা অবস্থা। কভার দিয়ে বেঁধেছেদে রাখতে হয়। একটু জোরে টোকা লাগলেও বিপদ। এর চেয়ে খালার দেওয়া পুরোনো নোকিয়া সেটই ভাল। ফ্রি ফেসবুক পর্যন্ত চালানো যায়। ফেসবুকে আমার নামে অনেকগুলো একাউন্ট। কোনটা আসল আমি মানুষ তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। পড়ুক। জীবনে দ্বিধারও প্রয়োজন আছে।

বাদল স্ট্যাটাস দিয়েছে, 'কে কে ভূমিকম্প টের পেয়েছ? আমি ঘুমে ছিলাম, আমার হিসাব ছিল না'। নানা জন নানা কমেন্ট করেছে। বাদলের সামনে এডমিশন টেস্ট। তবু সে সারাক্ষণ ফেসবুকে। তার বন্ধু এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ না পেয়ে সুইসাইড করেছে। তাই দেখে ফুপা ফুপু ভড়কে গেছেন। বলে দিয়েছেন বেশি চাপ না নিতে। কোথাও চান্স পেলে পাবে, না পেলে ওকে বাইরে পাঠিয়ে দেবে। কেউ কেউ অবশ্য দাবি করছিল ওই বন্ধুর সুইসাইডের পেছনে রেজাল্ট নয়, ব্লু হোয়েল নামক অনলাইন গেম দায়ী। তবে সেই গুজব বেশিদিন টেকেনি। বাদলের বন্ধুগুলো বেশ অদ্ভূত। গত কোরবানি ঈদের পর তার আরেক বন্ধু প্রেমিকার সাথে ব্রেকাপ করে ফেলেছে। 'বড় ছেলে' নাটক দেখে নাকি তার ভেতর পরিবারের প্রতি তীব্র দায়িত্ববোধ জেগে উঠেছে, এসব প্রেমটেম করে আর সময় নষ্ট করতে চায় না।

কখন ধানমন্ডি এলাকায় এসে পড়েছি খেয়াল নেই। ফোনটা শান্তিনিকেতনি ঝোলায় রেখে আশপাশ দেখায় মন দিলাম। এক কোণায় কিছু ইয়াং ছেলেপেলে বিপিএল নিয়ে তুমুল তর্ক বাঁধিয়ে দিয়েছে। তাদের ফেলে সামনে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ একটা পোস্টারে চোখ আটকে গেলো। 'নাবিলা! একজন মুমূর্ষু রোবটের জন্য জরুরি ভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন। রক্তের গ্রুপ এন পজিটিভ'। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। প্রেমের আহ্বান নাকি প্রাক্তন প্রেমিকার প্রতি আকুতি তা অবশ্য ঠিক বোঝা গেল না। ঢাকাবাসীর সৃজনশীলতা দিন দিন বাড়ছে। এই ক'দিন আগেও সুবোধ নিয়ে কত হইচই হল। সুবোধের আসল পরিচয় আমি জানি। কাউকে বলিনি, বাদলকেও না। কী দরকার জানাজানির। যে পালিয়ে যেতে চায় তাকে পালাতে দেওয়াই উত্তম।

ফোন বেজে উঠল। নিশ্চয়ই ইয়াদ। ধরতেই চেঁচিয়ে উঠল, 'কোথায় তুই?'
'ধানমন্ডির দিকে ছিলাম। এখন ভাবছি ফার্মগেট যাব।'
'ফার্মগেট কেন? তোকে না সেই দশটায় আসতে বললাম?'
'দশটায় আসতে বললেই দশটায় আসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বিকালে আসি।'
'বিকাল টিকাল না। তোর এগজ্যাক্ট লোকেশন বল। এখুনি উবার পাঠাচ্ছি। ড্রাইভার ছুটিতে গেছে।'
'তার দরকার নেই। বাসে চলে আসব।'
ফোন সুইচ অফ করে দিলাম। ইয়াদের মাথায় একবার কিছু ঢুকলে তা বের করা মুশকিল। মাঝে কিছুদিন খুব মন-টন খারাপ করে ছিল, তার প্রিয় গায়ক ব্যান্ড ছেড়ে দিয়েছে বলে। দু'দিন আগে আবার খুব উৎসাহী হয়ে ধরে নিয়ে গেল ফোকফেস্টে। রাত দশটায় গেট বন্ধ হবার কথা, নয়টা পঞ্চান্নতে হাজির হয়ে দেখি আর ঢুকতে দিচ্ছে না। অনেকেই ঢুকতে না পেরে হাহুতাশ করছে। ফেস্ট এখনও শেষ হয়নি বোধহয়। সেখানেই আবার নিয়ে যাবে কিনা কে জানে।

বাসে উঠতেই সিট পেয়ে গেলাম। কী সৌভাগ্য। একটু সামনে এক লোক পকেট হাতড়াচ্ছে। গতিবিধি সন্দেহজনক। পকেটে ব্লেডজাতীয় কিছু আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম। অজ্ঞান পার্টি মলম পার্টির পর এখন বেরিয়েছে ব্লেড পার্টি। বেগম রোকেয়ার সাথে এদের ভীষণ শত্রুতা। মেয়েদের বাইরে বেরোতে দেবে না, বাসে উঠলেই লুকিয়ে তাদের জামার অংশবিশেষ কেটে দেবে। সত্যি, বাঙালির উদ্ভাবনী চিন্তায় শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না।

ইয়াদ শুকনো মুখে বসে ছিল। আমাকে দেখে মুখটা আরও শুকনা করে বলল, 'নিতু ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। তোকে সেই সকালে আসতে বললাম, আর তুই কিনা আসলি এখন!
-সেটা যা হয় হলো, ঝগড়া হলো কী নিয়ে?
- নিতুর সঙ্গে ডুব সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। সেই ডুব নিয়েই ঝগড়া। আমি বলছিলাম, এটা হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক। নিতু বলছিলো এটা বায়োপিক না! কেমন লাগে বল, তুই বল, এইটা বায়োপিক না?
আমি কিছু বললাম না। সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ কাজ না, নো বেড অফ রোজেজ...
ইয়াদ বললো, 'বাদ দে, তুই ভাত খেয়ে যা। বাবুর্চি চিতল মাছ রেঁধেছে'।
আমি চিতল মাছের পেটির আহ্বান অগ্রাহ্য করে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। কিছু ভাল লাগছে না। সিনেমাহলের সামনে গিয়ে দেখি ডুব নিয়ে দর্শক খুব আগ্রহী। কেউ কেউ সিনেমা দেখে বের হয়েই এটা বায়োপিক নাকি বায়োপিক না তা নিয়ে তর্ক করছে। এক পক্ষকে খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে, তাদের দলের একজনকে দেখলাম ঝগড়া করতে করতে দাঁত কেলিয়ে হাসছেও।

আমি অন্য দিকে চোখ বাড়ালাম। ডুব যারই বায়োপিক হোক, আমার তাতে কী! মহাপুরুষদের নিয়ে কখনও বায়োপিক হয় না। আমার বরং আরেকবার ডুব দেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে...

৩০০১ পঠিত ... ২২:৩৪, নভেম্বর ১৩, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top