আহারে, বয়স হয়ে গেলে মানুষের কত রকম রোগ যে হয় মাথায়!

১৬৫৫ পঠিত ... ১৭:৩৬, জুন ০৩, ২০১৭

বাবা খুব হিসেবি মানুষ ছিলেন। অভাবের সংসারে হিসেবী হওয়াটা খুব জরুরি। বাবার প্রথম চাকরি ছিল শিক্ষকতার, প্রায় আট বছর করেছিলেন ওটা। তারপর একটা স্পিনিং মিলে জয়েন করেছিলেন উচ্চপদস্থ হিসেবে। বাবা যে বেতন পেতেন তার এক ভাগ জমাতেন, বাকী টাকা খরচ করতেন সংসারে। বাবা আরো একটা কাজ করতেন।

কোনো খাট ছিল না আমাদের বাড়িতে, চৌকি ছিল। কাঠের। তার যেদিকে মাথা রেখে ঘুমাতেন, সেখানে ড্রয়ারের মাপের একটা ফাঁকা জায়গা ছিল, তার উপর ঢাকা ছিল, তালা লাগানো যেত সেটাতে। কাঠের সিন্দুকের মতো সেই জায়গাটাতে বাবা নিয়ম করে খুচরো পয়সা জমাতেন। সোয়ান ব্রান্ডের গেঞ্জি তখন খুব ফেমাস, তার পলিথিনটাও বেশ মোটা ছিল, বাবা খন্ড খন্ড করে সেই পলিথিনে বিভিন্ন অংকের মুদ্রা রাখতেন। তবে বেশির ভাগ রাখতেন-চার আনা, আট আনা আর এক টাকার কয়েন। প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর সেই মুদ্রাগুলো বের করা হতো, গোনা হতো, তারপর স্বচ্ছ একটা কাপড় দিয়ে মুছে আবার রেখে দেওয়া হতো আগের জায়গায়। এই কাজটা আমরা ছোট-ভাইবোন মিলে করতাম। চোখে মুখে আনন্দ নিয়ে কাজটা করতে করতে সেই ছোট্টকালে ভাবতাম আর পুলকিত বোধ করতাম-আহ, আমাদের কত টাকা! 

বাবা এই কয়েনগুলো কেন জমাতেন?

হাসতে হাসতে বাবা বলেছিলেন, ‘যদি সারা দেশে আগুন লেগে সব পুড়ে যায়, তাহলে টাকাও পুড়ে যাবে, কিন্তু এই কয়েনগুলো পুড়বে না। তখন আমরা এই পয়সা দিয়ে চাল কিনে ভাত খাব, মাছ খাব।’

না, সারা দেশে তখন আগুন লাগেনি। আগুন অবশেষে লাগল প্রায় পয়ত্রিশ বছর পর!

দু টাকা দিয়ে একটা মাটির ব্যাংক কিনেছিলাম, ক্লাস ফোরে পড়ি তখন। স্পষ্ট মনে আছে-গম্বুজ আকৃতির ছিল ওটা, গোলাপি এবং সোনালী চিকচিক রংয়ের আধিক্য ছিল মাত্রারিক্ত। পড়ার টেবিল ছিল না আমাদের, খাটও ছিল না। চিতানো জমির মতো কাঠের চৌকি ছিল, যে চৌকির কাঠে বাস করা অদৃশ্য কতগুলো পোকা ঝিঝি করে গান গাইত এক নাগারে, তার উপর বসে আমরা সব ভাই-বোন প্রতিদিনের স্কুলের পড়া পড়তাম, তার কোনায় রেখে দিতাম ব্যাংকটা। অনেক সময় পড়ার মনোযোগের চেয়ে মনোযোগটা ওদিকে থাকত বেশি। এবং সুযোগ পেলেই কাপড় দিয়ে মুছে দিতাম ওটাকে।

স্পষ্ট করে এটাও মনে আছে-পেছনে সবজি আর মাছের ছবি আঁকা চার আনা, কখনো কখনো পেছনে লাঙ্গল আঁকা আট আনা রাখার সৌভাগ্য হতো ওই ব্যাংকে। তার বেশি না। অভাবের সংসারে এর চেয়ে বেশি পাবোইবা কোথায়!

সামনে ঈদ। জামা-কাপড় কিনেছে প্রতিবেশীর সবাই। আমার সমবয়সী একজন  পেছনে বেল্টওয়ালা একটা জুতো কিনেছে। পছন্দ হলো, আমারও একটা চাই। ষাট টাকা দাম। কিন্তু ওই টাকা পাব কোথায়? বাবাও ওটা কিনে দিতে অপারগ। শেষে শিল-পাটার শক্ত পাথর দিয়ে ওাই মাটির ব্যাংকের বুকে আঘাত। বায়ান্ন টাকা জমাতে পেরেছিলাম। বাকী টাকা দিয়ে জুতোটা কিনে দিয়েছিলেন বাবা।

‘আমরা সবাই যে এতটা পাপে ডুবে আছি, তা  স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। বছর কয়েক আগে চালু করা “পাপ কর” (Sin Tax)-এর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু এবারের বাজেটে “পাপ কর”-এর বোঝা বাড়িয়ে দিয়ে তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে আমরা যেহেতু “পাপ করে”ই চলেছি, সেহেতু আমাদের  “পাপ কর”-এর হার বাড়বে। ব্যাংক লুটের নতুন নতুন রেকর্ডের পরও যেহেতু আমরা ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিইনি, সেহেতু পাপ লাঘবের জন্য আমানতকারীদের ওপর করের বোঝা বাড়ানোর মতো একটি কল্য্যাণকর ব্যবস্থা না নিয়ে অর্থমন্ত্রী থাকেন কী করে? সুতরাং তিনি আমানতের ওপর নতুন বর্ধিত হারে আবগারি শুল্কের প্রস্তাব করেছেন।’

কামাল আহমেদ, প্রথম আলো, ১ম পৃষ্ঠা ১ম কলাম, শনিবার, ৩ জুন ২০১৭

অর্থমন্ত্রী আরো একটা কারণে ধন্যবাদ-ঐতিহ্যকে ধারন করার কাজে আমাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য। মাটির ব্যাংকের কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। মানুষ এখন আবার মাটির ব্যাংক ব্যবহার করা শুরম্ন করেছেন, কেউ কেউ করার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।

দেশে কতরকমের পদক দেওয়া হয়। ঐতিহ্যেরে কাছে আমাদের ফিরিয়ে আনার জন্য মাননীয় অর্থমন্ত্রী আমরা একটা বড়সড় পদক দিতে পারি।

একটি ব্যাক্তিগত কথন। আমার নানা ৭৬ বছর বয়সে মারা যান। মুত্যর তিন বছর আগ থেকে মাথাটা কেমন যেন বিগড়ে যায় তার। হাতে একটা লাঠি রাখতেন তিনি-মোটা বেতের, মাথায় পেতলের কভার লাগোনা। কাছে কাউকে পেলেই ঠাস করে সেই লাঠি তাকে আঘাত করে নানা বলতেন, ‘হারামজাদা, বিয়ে কইরছস?’

আহারে, বয়স হয়ে গেলে মানুষের কত রকম রোগ যে হয় মাথায়!

১৬৫৫ পঠিত ... ১৭:৩৬, জুন ০৩, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top