কার্টুন আঁকায় ক্ষমতা-পুরুষদের সম্মানহানি ও দেশের কমনসেন্স-দুর্ভিক্ষ

২০৩০ পঠিত ... ১৬:৪১, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১

free kishore

প্রায় বছরখানেক হলো কার্টুনিস্ট কিশোরকে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে।

এই এক বছর সময়ে গোটা বিশ্বের কার্টুনিস্টরা জেনে গেছে; পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামে একটি দেশ আছে; যেখানে কার্টুন-ক্যারিকেচারের মতো হাস্যরসাত্মক অপরাধে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়; তাদের ভিআইপি অনুভূতিতে আঘাত লাগে। ইগো ব্যাপারটা এতো মারাত্মক এই দেশে যে; যে রকম কার্টুন দেখে জার্মানির চ্যাঞ্চেলর আঙ্গেলা ম্যারকেল বা যে কোন কমনসেন্সসম্পন্ন রাষ্ট্রনেতা হেসে উড়িয়ে দেন; একই রকম কার্টুন দেখে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনেতার প্রতিক্রিয়া কী হয় তা জানা যায় না; তবে 'তার মেন' এইরকম কার্টুন দেখে রেগে টং হয়ে যায়। পুলিশ পাঠিয়ে পাকড়াও করে নিয়ে আসে কার্টুনিস্টকে; ছুঁড়ে দেয় অন্ধকার কারাগারে। কী রাগরে বাবা! পৃথিবীর আর কোন দেশে এইরকম পাশবিক ক্ষমতা রাগ কী চোখে পড়ে!

গ্রামের রাগ বাবা; একেবারে গোয়ার গোবিন্দ যারে বলে; বুনো মোষের মতো রাগ। 'ফইন্নির ঘরের ফইন্নির' টাকা পয়সা হলে ভয়ংকর সম্মান বা স্টেটাস সচেতনতা হয়। সম্মানহানি হলে; তারা মানুষ খুন করতে পারে। শৈশব থেকে একটু সম্মানের কাঙ্গাল এরা। এ সমাজ শিখিয়েছে; ভালো কাজে সম্মান নেই; চুরিদারি করতে সরকারের দালাল হতে হয়। যারা একসময় আল-বদর হয়েছিলো তারা রাষ্ট্রের অর্থ লুন্ঠন করে ধনী হয়েছিলো। অমনি সম্মানের দাবিদার হয়েছিলো তারা। সুতরাং নতুন 'সাইবদর' হয়ে রাষ্ট্রের অর্থ লুন্ঠন করে সম্মানের দাবিদার হওয়াটাই এই অন্ধকার চিন্তার জনপদের একমাত্র স্বপ্নের নাম।

এইখানে সম্মানের কাঙ্গাল 'ক্ষমতার পুরুষ'দের সম্মানহানি হলেই সাইবদরেরা সাইবার আইনে মামলা করে; আর 'সমালোচকদের' জেলে ছুঁড়ে দেয় ক্ষমতা-পুলিশ বা এলিট ফোর্স। এই পুলিশ জনগণের সেবক হলেও ঐতিহ্যগতভাবেই তারা ক্ষমতাসীনদের ইগো সেবা করেই জীবন কাটায়। একেকটি ক্ষমতা আমলে একেকটি কোহিনূর আনুগত্যের অধিক পরিচয় দিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। ক্ষমতা আমল হারিয়ে গেলে পুরোনো কোহিনূর হারিয়ে গিয়ে নতুন কোহিনূর উঠে আসে ক্ষমতা পুরুষদের মুকুটে।

এইভাবেই পুলিশের আর কিছুতেই যেন; জনগণের বন্ধু হওয়া হলো না। আর এই ক্ষমতা পুরুষেরা ভুরুঙ্গামারি থেকে উঠে এসে যারা ক্ষমতার প্রাসাদ আলো করেছে; তাদের সমকালীন বিশ্ব সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। তাদের জগত ফইন্নি চিন্তার কাল্পনিক জগত; যেইখানে সবাইকে ভয় দেখিয়ে রাখতে পারাই ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।

ক্ষমতা-পুরুষেরা দুর্নীতি করলে; দুর্নীতির অর্থে বুলবুলি আখড়াই করলে, দুর্নীতির অর্থ পাচার করলে; আবার এসব ডাকাতের মায়ের বড় গলা হলে; তাদের নিয়ে সমালোচনা হবেই। বিশ্বের এমন কোন দেশ কী আছে; যেখানে 'পাবলিক অফিস হোল্ড করেন' বা ক্ষমতা কাঠামোর সাইবদর হয়ে 'লুন্ঠন-ব্যাংক-শেয়ারবাজার খেকো-ভূমি খেকো'-এমন ক্ষমতা পুরুষদের নিয়ে জনসমালোচনা হয় না!

ক্ষমতার পুরুষেরা এই গ্রামদেশে কিছু ব্যারিস্টার পুষে; যারা বিলেত থেকে নিজের ছাগলনাইয়া সত্তা অক্ষুণ্ণ রেখে আইন পাশ দিয়ে এসে; মানহানি বা টর্ট আইন বোঝায়। কিন্তু এটুকু দেখেও শেখেনি বিলেতের বিচার বিভাগের সার্বভৌমত্ব; ক্ষমতার ভারসাম্য; প্রাইম মিনিস্টার'স মেনদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর মেরুদন্ড কী মজবুত।
তার মানে চোখের সামনে দুর্নীতি হবে-লুন্ঠন হবে-ক্ষমতার অপব্যবহার হবে; কিন্তু এর সমালোচনা করা যাবে না। সমালোচনা করলেই ব্লাসফেমি আইনের অনুকরণে সাইবার আইনে দেখানো হবে; সমালোচক ক্ষমতার ঈশ্বর বা তার লোকেদের মানহানি করেছে; সুতরাং তাদের আমৃত্যু জেলে রাখা হোক।

যেসব সমালোচনা বা মন্তব্যের জন্য পুলিশ সক্রিয় হয়ে রাষ্ট্রপক্ষে সাইবার আইনে মামলা করে; গ্রেফতার করে; চার্জশিট দেয়; তার একটি তালিকা পড়ে মনে হলো; কতটা পরাবাস্তব আর অযৌক্তিক এই বাংলাদেশের ক্ষমতা-জগত। এসব কথা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য গ্রাম্য-সংস্কৃতির দেশ ভারত-পাকিস্তানে অহরহ বলে সাধারণ মানুষ। কিন্তু ভারতের সাইবদর ও পাকিস্তানের সাইবদর বা ক্ষমতার লোকেদের এতো দাপট নেই এখনো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান; কার্টুন-ক্যারিকেচার সহ্য করে নেন। বিশ্বের চলতি হাওয়াটা তারা বোঝেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেন্স অফ হিউমারের যে পরিচয় পাওয়া যায়; তাতে স্যাটায়ার, কার্টুন, ক্যারিকেচার বোঝার যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে তার; এমনটা মনে হয়।

কিন্তু তার ক্ষমতা কাঠামোর যারা 'অনুভূতি ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ' হবার ব্যাপারগুলো মাপজোঁক করে; এরা সাংঘাতিক গাঁইয়া; চিন্তার জগতে পিছিয়ে থাকা লোক। কার্টুনিস্ট কিশোরকে কার্টুন আঁকার জন্য প্রায় একবছর যারা কারাগারে রেখেছে; এদের বলদ-ইগোর কারণে গোটা বিশ্ব জানলো; বাংলাদেশে কার্টুন আঁকা ভয়ংকর এক অপরাধ।

ক্ষমতার আদু ভাই পুরুষেরা যাদের পাশবিক রাগ হয় বিন্দুমাত্র সম্মানহানি দেখলে; এদের ভেতরটা আল-কায়েদা জঙ্গিদের মতো; ফলে নিজেদের ঠুনকো ভাবমূর্তি রক্ষায় বল প্রয়োগ করতে গিয়ে; বিশ্বে নিজের দেশের ভাবমূর্তি ভেঙ্গে ফেলার কাজটিই তারা করে থাকেন। আর তাদের তুষ্ট করতে যে পুলিশেরা 'অনুভূতি' পাহারা দেন; তারাও বুঝতে পারেন না; বিশ্ববাসী জানলো; কোন সে নির্বোধ পুলিশ যে কার্টুন আঁকাকে অপরাধ মনে করে; উত্তর একটাই; এবং তা জানা। ৯ মাস ১৫ দিন ক্ষমতা ষাঁড়ের ক্ষোভে কারাগারে আটকে থেকে কার্যত দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছে কার্টুনিস্ট কিশোর। মানবতার এই মন্বন্তরে শাসকের নিষ্ঠুরতার মিথই যেন আমাদের নিয়তি।

এখন এটা সত্য যে আমাদের দরিদ্র সমাজে পুষ্টির অভাবে কমনসেন্স বাড়ে না বেশিরভাগ লোকের। কমনসেন্স নাই; কিন্তু টাকা আছে; এর চেয়ে ভয়ংকর পাশবিক ম্যান আর হয় না। আর ঐ জিনিস থৈ থৈ করছে চারিদিকে। জানি না কবে এই নির্বোধ সাইবদরদের চিন্তার ভ্রান্তি থেকে মুক্তি পাবে সমাজ; বিকশিত হবে মানুষের মুক্তি; যে অমল কিশোরের মুক্তির অন্বেষণ শত বছরের ঔপনিবেশিক কারাগার থেকে আজকের বাংলাদেশ কারাগারে গুমরে কাঁদছে।

২০৩০ পঠিত ... ১৬:৪১, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top