আজকের লেখাটি 'বয়কট' সংক্রান্ত। মূলত পাওয়ার অব বয়কট বা বয়কটের ক্ষমতাই আমাদের আলোচনার উপজীব্য বিষয়। বয়কট কালচারের শুরু দেখার জন্য যেতে হবে অনেকটুকু পেছনে, ১৮৮০ সালের দিকে। চার্লস কানিংহাম বয়কট নামের খাজনা আদায়কারী এক ইংরেজ ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে প্রথম বয়কট। সে ইতিহাসে যাব না, তবে এটাই সোশ্যাল মিডিয়ার হ্যাশট্যাগ ছাড়া প্রথম আনফিশিয়াল বয়কট। বয়কট বেচারার কীর্তিকলাপের জন্য তাকে একঘরেও করে রাখা হয়েছিলো অনেকদিন।
এদিকে উপমহাদেশে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বা স্বদেশি আন্দোলন নামে খ্যাতি লাভ করলেও এর আনঅফিশিয়াল নামও কিন্তু বয়কট আন্দোলন। মূলত বিদেশী পণ্য বয়কট করার মাধ্যমেই প্রসার পায় স্বদেশী আন্দোলন। একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ আর কি।
আমাদের ভূমিকা অংশটি শেষ। লেলপা ছেড়ে এখন আমরা কুসুমের দিকে যাবো।
যা বলছিলাম। বাঙালিরা স্বভাবে চেতনাকামী। তারাও রাতারাতি বয়কট করে মানুষ, পন্য কিংবা প্রতিষ্ঠানকে বয়কট করে পথে বসিয়ে দিতে পারে। এর উদাহরণ আমরা আগেই পেয়েছি। ক্রমাগত পাচ্ছি, পেয়েই চলছি। ২০০৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো চারহাত একসাথে হয়েছিলো ৫৬ বছর বয়সী বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এবং মাত্র ২৩ বছর বয়সী অভিনয়শিল্পী মেহের আফরোজ শাওনের। মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করার জন্য (অপরাধে!) সমাজের কাছে রীতিমতো ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন জাদুকর হুমায়ূন। ব্যাকল্যাশের জোয়ারে এসেছিলো বয়কটের ডাকও।
এরপর থেকেই রাতারাতি বদলে যায় হুমায়ুনের জীবন। খেয়াল করলে দেখবেন— নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, মেঘ বলেছে যাব যাব ইত্যাদির মতো মানসম্পন্ন বইগুলো তিনি লিখেছিলেন ক্যারিয়ারের শুরুতেই, বয়কট হবার আগে যখন পাঠকের হৃদয় যখন পূর্ণ ছিলো তার জয়গানে। বয়কট হবার পর থেকে হুমায়ূনের জীবন বদলে যায় রাতারাতি, তুমুল জনপ্রিয়তা হারিয়ে নেমে আসে ধ্বস। তখন হুমায়ূনের বই দেখামাত্রই লোকজন তা ছিঁড়ে নর্দমায় ফেলে দেয়, মুড়ির ঠোঙা বানায়। এমনকি স্বয়ং বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লিখে ফেললেন একটি গান, ‘সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা’
বয়কট হবার পর থেকে হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটি দিন ছিলো একেকটি কুরুক্ষেত্র। প্রথম এক বছরের মাথায়ই তাকে গাড়ি বাড়ি বিক্রি করে বসতে হয়েছে পথে। যে লেখক কালজয়ী হবার জন্য জন্মেছিলেন, ভাগ্যের নিয়তিতে ২০০৪ সালের পর থেকে তার বইয়ে আগ্রহ পায় নি প্রকাশক, পাঠক কিংবা কেজি দরে বই কেনা কটকটিওয়ালাও। বইয়ের জগত থেকে ধীরে ধীরে মুছে গিয়েছে এক নক্ষত্রের নাম। শখের বাগানবাড়ী নুহাশ পল্লী বিক্রি করে তাকে যোগাতে হয়েছে শেষ বয়সের চিকিৎসার খরচ।
হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠজন অন্যপ্রকাশের কর্ণধার মাযহারুল ইসলাম জানান, ‘স্যারকে বয়কট করার পর থেকেই তিনি মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করেন। চৈত্রের দ্বিতীয় প্রহর কিংবা চাঁদনী পসর রাতে তাঁকে নুহাশ পল্লীর সামনে থালা হাতে নগ্ন শরীরে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা গেছে। বয়কটের কারণে এমন প্রতিভার মৃত্যু সত্যিই দুঃখজনক...' [তথ্যসূত্রঃ ট্রাস্ট মি ব্রো]
শুধু হুমায়ূন আহমেদ নয়, এর জ্বলজ্যান্ত আরেক সাক্ষী ইমানুয়েল মাখোঁসহ গোটা ফ্রান্সবাসী। কিছুদিন আগেই ফ্রান্স বয়কট করার কারণে এখন পথে বসেছে ফ্রান্স। সর্বশেষ তথ্যসূত্র হতে, ফ্রান্সে এখন দুর্ভিক্ষ চলছে। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির লীলাভূমি পারীতে (প্যারিস) এখন পথে পথে হেঁটে চলছে কঙ্কালসার কিছু জীবন্মৃত মানুষ। তাদের দু'বেলা অন্ন যোগান দেবার কেউ নেই, মাথার উপর ছাদ নেই। মাখোঁ অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে আজ শয্যাশায়ী।
এর আগেও বয়কট করা হয়েছিলো বাংলাদেশী ব্র্যান্ড আড়ং-কে। বর্তমানে আড়ং এর টিকির চিহ্নটুকুও নেই। বড়লোকের তীর্থস্থানের মতো ধূ ধূ করছে আড়ং এর ধ্বংসস্তুপ। মানুষ আড়ং ভুলে এখন শপিং করছে গুলিস্তান, মৌচাক আর চাঁদনী চকে। শোনা যায়, আড়ং এর জামাকাপড় ন্যাকড়া হিসেবে বিক্রি হয় গাউছিয়া মার্কেটের সামনে। কেউ কেউ তা দিয়ে এখন কাঁথাও সেলাই করে। আড়ং এর সেসব পুরনো নস্টালজিয়া হাতড়ে বেড়ানো আর স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন