নাটক ও সংস্কৃতি বিষয়ে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের কিছু মূল্যবান উক্তি

১৭৯৪ পঠিত ... ১৩:৫২, আগস্ট ১৯, ২০২০

সেলিম আল দীন বাংলাদেশের নাটক তো বটেই বাংলা ভাষার একজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার, লেখক, কবি ও দার্শনিক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে নাট্যকার পরিচয়টিই বড় ছিলো। ১৮ আগস্ট ছিল তার জন্মদিন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে তার চুম্বক উক্তি eআরকির পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়া হলো। 

 

 

প্রচলিত কাঠামোর বাইরে যাওয়া 

'আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে, বাংলা কবিতার চেয়ে নাটকের যে দীনতা, উপন্যাসের চেয়ে নাটকের যে সীমাবদ্ধতা, সেটাকে ঘোচাতে হবে। সেটা ঘোচাতে যদি যাই, তাহলে আমাকে নতুন ভূমি, নতুন মানুষ, নতুন শিল্প দর্শন আবিষ্কার করতে হবে। এই ভূমি আবিষ্কার করতে গিয়ে আমার কাছে প্রচলিত কাঠামোগুলোকে কঠোরভাবে বর্জন করতে হয়েছে। ফলে আমার লেখা পড়ে হুট করে নাটক মনে হয় না। কিন্তু এটাও তো সত্য যে, মূলত আমি নাটকই লিখতে চেয়েছি।'

 

নিজের নাটকের ভাষা বিষয়ে  

সেলিম আল-দীন: আমার নাটকে নাটকই প্রাধান্য পেয়েছে, গীতলতা বা কাব্যালুতা নয়। মূলত দৈনন্দিনের গদ্যকে আমি জীবনের নিগূঢ় প্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চাই। আমার সংলাপরীতিকে আমি চরিত্রের উল্লাস ও বেদেনাপ্রবাহের সঙ্গে একীভূত করতে চাই।

আমি সরাসরি ইউরোপীয় রীতিতে লেখার অপপ্রয়াস কখনও করিনি। কাজেই ট্র্যাজেডি নাটকের সংলাপের স্থিতিস্থাপকতা আমার নাটকে অপ্রয়োজনীয়। ট্র্যাজেডি-পড়া কান দিয়ে বাংলাদেশি মনকে বোঝা যাবে না কখনও। বাংলা নাটকে ইউরোপীয় রীতির ট্র্যাজেডি করার প্রয়াস সর্বাংশে ব্যর্থ হয়েছে।

আমার নাটক যদি এই বাংলাদশি জনপদের জীবনযুদ্ধ, বেদনা ও পতনকে গভীরভাবে ধারণ না করে থাকে, তবে তা অবশ্যই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। অন্য কোনো কারণে নয়।

আমি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ছেলে। একটি প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ও যুক্তিবাদী সমাজে গদ্যের যে রীতি- তা থেকে বাংলাদেশি গদ্যরীতি ভিন্ন হতে বাধ্য। আমাদের গদ্যে থাকবে হত্যার আর্তনাদ, তাজা রক্তের স্পন্দন।

বাবুগদ্য নয়- পদ্মাপারের মানুষ যে ভাষায় আর্তনাদ করে সে ভাষা চাই নাটকে। উপরন্তু আমার জন্ম বঙ্গোপসাগরের তীরে। সমুদ্রের ঢেউ ও প্রলয়ের সঙ্গে পরিচয় জন্মাবধি। সুতরাং মোজাইক ড্রাই মনোটোনাস ইত্যাদি গদ্যরীতির অনুকৃতি আমার দ্বারা সম্ভব নয়।'

 

শিল্পীর অভিনবত্ব ও পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য মনে হওয়া

তুমি এনসিয়েন্ট গ্রীস বা এনসিয়েন্ট পাহলভি, যে দিকেই তাকাবে দেখবে, সবসময় মানুষের মধ্যে শিল্পরস পিপাসা বা জীবনের গভীর বক্তব্যগুলো সামাজিক ভাবনা থেকে উঠে এসেছে। সেকারণে, তারপর যে যাই করেছে, মূলত প্রচলিত বিষয়েরই নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছে। নিজের প্রতিভা দিয়ে নতুন দর্শন তৈরি করেছে, ভাবনা তৈরি করেছে। কিন্তু মূল ব্যাপারটা কিন্তু প্রাচীন, যেটাকে আমরা পুরাণ বলি। ধরো ভাস যখন ঊরুভঙ্গম লেখে, তখন সেটা দেখতে এসে দর্শক কিন্তু জানে ভীম আর দুর্যোধনের যুদ্ধের কথা। ফলাফলও জানে। জেনেই বসেছে। তারপরও ভাস যে নতুন মাত্রা যোগ করে, তাতে আস্তে আস্তে দর্শক দুর্যোধনের প্রতি দুর্বল হতে থাকে। কৃষ্ণের মতো ব্যক্তির ইশারায় ভীম এমন একটা কাজ করতে পারে, সেটা কিন্তু মহাভারত পড়ে কেউ দুর্যোধনের প্রতি দুর্বল হয় না। আবার ইডিপাস-র কথা ধরো। এটা কিন্তু মূলত মিশরীয় মিথ। যাই হোক, তো যখন দর্শক দেখতে যাবে, তখন কিন্তু সবাই এই নাটকের ঘটনা জানে। তাহলে তাদের ভেতরে ক্যাথারসিস তৈরি করার ঝুঁকিটা বোঝ! অথচ নাটকের শেষে যখন ইডিপাস বলে- কবর অবধি যে সুখি নয়- তবে সে যে সুখি এই নামে অভিধানিত হতে পারে না।  ঠিক তখনই দর্শক একটা নতুন দর্শন নিয়ে বাড়ি ফেরে। এভাবে ট্রাডিশনের ভেতর থেকে রিচ্যুয়ালের ছদ্মাবরণে একটা জায়গায় নিয়ে যেত নাট্যকাররা। নাট্যকার কেন, গল্পকার, উপন্যাসিক, কবি সবাই একাজটা করেছে। আধুনিক লেখকের সমস্যা হলো সে মাঝে মাঝে মিথের ব্যবহার করে, কিন্তু সে মূলত নিজস্ব ব্যক্তিসত্তার ভাবনার উপর দিয়ে গড়াতে চায়। একারণে আধুনিক লেখক, যারাই নতুন কিছু সৃষ্টি করেছে, তাদের লেখা দুর্বোধ্য ঠেকে। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ চিন্তাই উপনিবেশ ভেঙে, দৃশ্যমান বিশ্ব ভেঙে, জীবনের অস্থিরতা ভেঙে আলাদা একটা জায়গায় পৌঁছতে  চেয়েছে। সেকারণে বুঝতে খুবই অসুবিধা হয়। সেকালে তো আরও অসুবিধা হতো। আর এই যে অসুবিধা হতো, এটার জন্য কিন্তু দায়ী করা হতো রবীন্দ্রনাথকেই। অজস্র ব্যঙ্গ বিদ্রুপের শিকার-তীরে বিদ্ধও হয়েছিলেন তিনি। পাঠক বোঝে না বলে মনে করতো আসলে রবীন্দ্রনাথের লেখা লেখাই হচ্ছে না। এ-ব্যাপারে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, দীলিপ রায়, ডি.এল. রায়ের ছেলে, তখন লন্ডনে ছিল, সেখানে বড় লেখকদের অভিমত পেয়ে ডি.এল. রায়কে চিঠি লিখেছিল যে- বাবা, রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে তুমি কিছু বলো না। তিনি যে কত বড় লেখক সেটা বোঝার ক্ষমতা তোমাদের নাই। ... তো আধুনিক কবির সমস্যা হলো, সে বর্তমান বিশ্বের যে সমস্ত সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, সেগুলো এই পৃথিবীতে কখনোই ছিল না। আধুনিকতার চরম সংকট হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদ। প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে আলাদা। বিজ্ঞান, টেকনোলজি তোমাকে একা করে দিচ্ছে। শ্রম বিভাজনের ফলে, নিজের তৈরি পণ্যের তৈয়ার প্রক্রিয়াই সে পুরোপুরি জানে না। শিক্ষা ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন হওয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা। যে সাহিত্য পড়ে, সে বিজ্ঞান জানে না। যে দর্শন পড়ে, সে ভাবে গণিত কোনো সাবজেক্টই না। যে মেডিকেল পড়ে, পরবর্তী সময়ে সে মানুষের কোনো একটা নির্দিষ্ট অংশের হয়তো চিকিৎসা করতে পারে। একজন রুগীকে সে পুরোপুরি সুস্থ করতে পারে না। এটা কিন্তু খারাপ বলছি না, আমি বলছি আধুনিকতার অনিবার্যতা। এই যে বিচ্ছিন্নকরণ, সেই বিচ্ছিন্নকরণের সময়ে একজন লেখক যখন তার কাব্য তৈরি করে, তখন তার পাঠক কীভাবে সংযোগ স্থাপন করবে? আমার এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমি যে মহাজাগতিক জায়গা ধরতে চাই তার সাথে পাঠকের সংযোগ স্থাপনে সময় তো লাগবেই। তুমি ইডিপাস বোঝ, কিন্তু আমার নিমজ্জন বোঝ না। কেন বোঝ না? কারণ, ইডিপাস তুমি বারবার পড়েছো বা বাধ্য হয়েছো পড়তে। কিন্তু আমার নিমজ্জন একেবারেই আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে। আমার নিমজ্জন-এ যে গণহত্যার কথা আছে, তাতে আমি একে একে দেখিয়েছি যে, এভাবে যে গণহত্যা হচ্ছে, হতে হতে শেষ মানুষটি যখন বেঁচে থাকবে এবং আর মানবের অস্তিত্বের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না, তখন তার মৃত্যুর পর এই গ্রহ থেকে মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কত বড় ভয়াবহ! এই ভয়াবহতা সৃষ্টি যারা করছে, তারা নিজেরাই কিন্তু নিশ্চিহ্ন হবে। তারপর দেখ, আধুনিককালে বাড়ি, গাড়ি, জৌলুস এসবের বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে তুমি তোমার বিশ্বের বাতাসের যে ওজন স্তর আছে, সেই ওজন স্তর ফুটো করে দিচ্ছ। তারপর কী হবে? পৃথিবী ধ্বংস হবে। পৃথিবীটা কী? আমাদের মা। সেই মাকে আমরা ধর্ষণ করছি। হয়তো না জেনেই করছি। সেটার সাথে ইডিপাসের ট্র্যাজিডি কি একই না? কিন্তু আমি যখন আধুনিক লেখক হিসেবে লিখবো, তখন এই বক্তব্য আনার পরও তোমার কাছে বিচ্ছিন্ন মনে হবে, দুর্বোধ্য মনে হবে। কারণ, আধুনিক বিজ্ঞান, সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা কিছুই তোমাদেরকে এসব বিষয়কে এভাবে শিখতে শেখাচ্ছে না, ভাবতে শেখাচ্ছে না। তো তোমার শেষ কথাটার জবাব দিই, সেটা হলো আমার নাটকের যে নাগরিক দর্শক, তাদের বেড়ে ওঠাটা হলো গতানুগতিক, শাদা চোখ দিয়ে দেখে দেখে বেড়ে ওঠা। তাদের মধ্যে ক্যাথারসিস তৈরি করাটা প্রায় অসম্ভবই বলা চলে।



শেকড়চ্যুত তারুণ্য ও পশ্চিমের অভিঘাত 

তরুণরা ইদানীং প্রভাবিত হতে পছন্দ করে। আমরা যেখানে ঔপনিবেশিক শিল্পধারার প্রভাব মুক্ত হবার জন্য লড়াই করছি- কী স্বাধীনতা যুদ্ধে, কী লেখার মধ্য দিয়ে। সেখানে দেখা যায় তরুণ লেখকদের একটা বিশাল অংশ আমাদের হাজার বছরের সাহিত্যের সাথে নিবিড়ভাবে পরিচিত নন এবং পাশ্চাত্য ধাঁচটাই অনুসরণ পছন্দ করছে। তারা এটা নিয়ে চিন্তিতও নয়। ফরাসি দেশে কী হলো, সিন নদীতে কত কিউসেক পানি গড়িয়ে পড়লো- সেটা নিয়েই তাদের যত মাতামাতি। আর পপুলার বিষয়ের দিকেই যেন তাদের মনোযোগ। নাটক, কবিতা এবং উপন্যাসে একটা নতুন চিন্তা ও আঙ্গিকের ভূমি আবিষ্কার করাটা খুব জরুরি। আমাদের সাহিত্য আমরা বলি আধুনিক অথচ উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে কোনো নাটক বাংলা সাহিত্যে নাই। আমার কাছে মনে হলো, বাংলা সাহিত্য এত বড় এত বিশাল অথচ এ সাহিত্যে সত্যিকার অর্থে একটা মাছ শিকারের গল্প নেই। অথচ মাছে-ভাতে বাঙালি বলছি। এই যে প্রতারণা, এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, আমি দাঁড়ানোর কিছুটা চেষ্টা করেছি, অন্যদেরও দাঁড়াতে হবে। রবীন্দ্রনাথই প্রথম ধান নিয়ে এলেন। ধান তো কৃষকের ব্যাপার ছিলো। এখনকার তরুণ লেখকরা বিশটি ধানের নাম জানে না। শিকড় থেকে বিচ্যুত হওয়াতেই আত্মপ্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না তারা। এটা আমার অভিযোগ নয়; দাবি যে, তারা এমন কিছু লিখবে যা আমাদের জাতিসত্তাকে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরবে।

আমাদের নাগরিক জীবনের অনুষঙ্গ তো পাশ্চাত্যের অপঘাতের আলো। এটাকে অবলম্বন করে যদি শিল্পচর্চা করি তাহলে সেটা নিশ্চিতভাবেই ভুল দিকে ধাবিত হবে। কারণ, ইউরোপে রিয়েলিজম-কিউবিজম ছাড়া আর কোনো আন্দোলন পজিটিভ কিছুর জন্ম দেয় নি। এক্সপ্রেশানিজম, ইম্প্রেশানিজম, দাদাইজম- ক্ষয়িষ্ণু সমাজ থেকে উঠে আসা এইসব শিল্পতত্ত্ব আমাদেরকে যেন গ্রাস না করে। ক্ষয়রোগীর কাশি-তো আর গান হয় না। ওদের গলিত সমাজ থেকে যে তত্ত্বটা উঠে এসেছে, আমরা সেটাতে বেড়াল-নখে আঁচড় দিচ্ছি- সম্ভবত নিমজ্জন-এ এরকম একটি কথা আছে। তার মানে আমি বলছি না যে, ওয়েস্টকে বন্ধ করে দাও। ডোন্ট শাট দা ওয়েস্ট। আমি বলছি, ওয়েস্টের যে জায়গায় মানব-মহিমার সমুজ্জ্বল দিকগুলো, শিল্প-কৌশলের অভিনব দিকগুলো আছে- সেগুলো গ্রহণ করে তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া।

 

সেন্সরশিপ বিষয়ে 

: টিভি নাটকের ক্ষেত্রে স্ক্রিপ্টের দারিদ্র্যের পাশাপাশি যে ব্যাপারটি প্রায়ই উচ্চারিত হয় তা হল কট্টর সেন্সরশিপ। এ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?

সেলিম আল-দীন: টিভিতে কেন যে এত সরকারি নিয়ন্ত্রণ তা বুঝি না, লেখকদের সত্য কথা বলতে দিলে জনগণের ক্ষোভ দূর হয়ে যায়। ফলে, সরকার ও জনগণের দূরত্ব কমে আসে, সরকারের প্রতি বিশ্বাস গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে অবশ্য সরকারি নিয়ন্ত্রণের চেয়েও মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল দর্শকদের রুচি আমাকে বেশি পীড়িত করে। সমাজের সঠিক চিত্র দেখলে অনেকেই ‘এ মা! ছি!’- ভাব করে''।

১৭৯৪ পঠিত ... ১৩:৫২, আগস্ট ১৯, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top