কান্না বৃত্তান্ত: বাঙালি সংস্কৃতিতে কান্না যেভাবে জড়িয়ে আছে

১৪০৪ পঠিত ... ০৭:৫৮, জুলাই ১৪, ২০২০

টার্মিনেটর: তোমরা কাঁদো কেন?
জন কনর: আমরা, মানে মানবজাতি?
টার্মিনেটর: হ্যাঁ।
জন কনর: আমি ঠিক জানি না। আমরা কাঁদি। ধরো, যখন কষ্ট পাই।
টার্মিনেটর: যন্ত্রণা বা বেদনায় কান্না পায়?
জন কনর: উম, না, এটা আলাদা… যখন তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে.. যেভাবে হোক, তুমি কষ্ট পেয়েছো। বুঝছো?
টার্মিনেটর: না।

টার্মিনেটর ২: জাজমেন্ট ডে [১৯৯১]   

 

বাংলার সমাজে কান্না 

‘না পারা’ জনিত আফসোস আমার হাজারো আছে। এর মধ্যে সিলি অনেক বিষয়ও আছে। যেমন, অনেক চেষ্টা করেও শিস দেয়াটা শিখতে পারি নাই, তুড়িতে টাশ টাশ শব্দের বদলে থ্যাস থ্যাস আওয়াজ হয়। 

কিন্তু যত বয়স বাড়ছে একটা বিষয়ে আফসোসও বহুগুণে বাড়ছে। 

আমি অনেক কিছু ফেইক করতে পারি, কিন্তু খুব কষ্ট পাইলেও চোখে পানি আসে না, আবেগ দিয়ে কাঁদতে পারি না। মানে কষ্ট ঠিকই পাই, মনে মনে কাঁদি, কিন্তু চেহারায় কান্নাটা ঠিক ফোটে না। 

অথচ এই দেশে কান্নার বাজার সবচাইতে বড়। অলটাইম হিট। 

আমি পারি নাই, কিন্তু, মজলিশে হাজেরান, ভালো মানুষ হিসাবে আপনাদেরকে একটা পরামর্শ দিই: প্লিজ  কান্নাটা ভালো করে প্র্যাকটিস করেন। 

বাঙলায় সবচে পপুলার শিল্পসাহিত্যগুলির দিকে তাকালে একটা জিনিসের উপস্থিতি খুব চোখে পড়ে: কান্দন।  

এই অঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে আকুলি-বিকুলি করে কান্নার বিশাল ক্যাপিটাল আছে।  

আপনি কাউকে কাঁদাতে পারলেন মানে আপনি সফল। ওয়াজ মাহফিল থেকে শুরু করে, নাটক সিনেমা বই পুস্তক সবক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য।

কান্নায় দক্ষদের আলাদা ডিম্যান্ড আছে সমাজে। শুনেছি আগে যাত্রাপালায় স্পেশাল লোক থাকতো যাদের বিশেষ দক্ষতা- তারা কান্না করতে পারে দারুণ। এই জাতিকে 'ওয়েইলিং নেশন'ও বলা যায়।    

শরৎচন্দ্রের সাহিত্য ('দেখিলাম সেই চিঠিতে দুই ফোটা অশ্রুর দাগ রহিয়া গেলো কিনা') থেকে শুরু করে হুমায়ূনের সাহিত্য বা ঈদের নাটক 'বড় ছেলে'র কাল্ট সাকসেস তার প্রমাণ। এতদঞ্চলে অনলি কাঁদুনি ইজ রিয়েল। 

আপনার চরিত্রের সহজে চোখে পানি এসে যেতে হবে। নইলে ফিকশন কিসের? 

আর আইডল বা পাবলিক ফিগারদের জন্যে এটা আরও বেশি খাটে। পাবলিক সেন্টিমেন্ট নামক উড়াধুড়া হাওয়া বুঝে কথা বলা লাগে তাদের। রিস্কি বিজনেস।  

তবে এইক্ষেত্রে দেশে সুবিধাও আছে। 

বাঙালির স্মৃতিশক্তি গোল্ডফিশের স্মৃতিশক্তির চাইতে খুব একটা উন্নত না। একটু সরাসরি বললে বলতে হয়, তুমুল বোকা*দা, সেন্টি খাওয়া একটি প্রজাতি। যুক্তি দিতে গেলে খেপে যায়, বেশি অজুহাত দিলে ক্ষেপে যায়। কিন্তু ভুল স্বীকার করে বা না করে বলা সেন্টিমেন্টাল কথাবার্তা খায় সে দেদারসে।   

যেকোনো পাবলিক ফিগারের জন্যে 'কাঁদো বাঙালি কাঁদো'র এই দেশে তাই এখন সাফল্যের মূলসূত্র একটাই: বিপদে পড়েছেন? লাইভে এসে আবেগ দিয়ে কান্না করেন। সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে।

তবে প্রশ্ন তোলা যায়, এই অঞ্চলের মানুষ কেন এতোটা কান্নাপ্রবণ কেন? 

এই প্রশ্নের ডেফিনিট উত্তর আমার কাছে নাই। যেহেতু আমি নৃবিজ্ঞানী না, আমার কাছে খুব ভালো ব্যাখ্যা না থাকারই কথা। 

[এই প্রশ্নটাই আদৌ ঠিক আছে কিনা সে ব্যাপারেও সন্দেহ আছে। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে বাঙালি যে বেশি কাঁদে, তার পক্ষে কি যথেষ্ট গবেষণা, রেফারেন্স বা তথ্যু উপাত্ত আমি হাজির করতে পারবো? না।] 

যা আছে, তার নাম স্পেকিউলেশন। সেই স্পেকিউলেশনের মাত্রা কেমন বোঝাতে আমার একটা হাস্যকর হাইপোথিসিস আপনাদেরকে বলি।

এই অঞ্চলের এক সময় শিয়াদের আধিপত্য ছিলো। শিয়াদের মধ্যে কারবালার স্মৃতিকে জাগরূক রাখতে শোকসংগীত, ছুরি-চাকুর গোছা দিতে পিঠে আঘাতসহ কান্নার ঐতিহ্য আছে। এই ঐতিহ্যে কান্না একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ।  

ভৌগোলিক কারণ কি হতে পারে, যা এই অঞ্চলের মানুষরে কান্নাপ্রবণ করে তুলেছে? এইটার পক্ষে কোনো ডেটা আমার হাতে নাই। 

একটা সময় পর্যন্ত দেশে ভাড়াটে কাঁদুনি পাওয়া যেতো, কান্না করাই ছিলো যাদের জীবিকা। 

এখানে ভালো বইয়ের কথা বলতে গিয়া বলা হয়, 'চোখে পানি চলে এলো।' বা 'চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই।' 

ইসলামে আল্লাহর কাছে বান্দার কান্নাকাটি করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এইসব মিলে বাঙালির মনস্তত্ত্ব গড়ে উঠেছে, যা তাকে কান্নাপ্রবণ করে তুলতে পারে। অবশ্য সহজেই বোঝা যায়, এগুলো গোজামিল দেয়া ব্যাখ্যা।  

ব্যাখ্যা গোজামিল হলেও বাঙালি অন্যের কান্নাকে কিভাবে দেখে সেটি কিন্তু বেশ মজার। যেমন: 

 

কান্নারও এস্থেটিক্স! সুন্দর-অসুন্দর খুজে পায় বাঙালি! 

কিছু লোকের কান্না নাকি সুন্দর। বিশেষত অল্প বয়সী সুন্দরীদের কান্না। অল্প কাঁদলে তাদের চেহারায় একটা ঘুম ঘুম সৌন্দর্য আসে। আবার সবচেয়ে অসুন্দর নাকি বুড়া মানুষের কান্না।

সুন্দর-অসুন্দরের ধারণা সাবজেক্টিভ, এবং একটা সাবজেক্টিভ আইডিয়াকে সত্যি ধরে সবার উপরে চাপিয়ে দেওয়ার মতো খারাপ কিছু হতে পারে না।   

পারসোনালি, আমার যেকোনো কান্নাই দেখতে অস্বস্তি লাগে, অসুন্দর লাগে। আমি কম এস্থেটিক লোক বলে কান্নায় কোনো প্রকার সৌন্দর্য খুঁজে পাই না।   

তবু একটা বিষয়ে অধিকাংশ মানুষের ঐক্যমত থাকলে, সমাজে তার কঠিন প্রভাব থাকে। একটা যেমন- বয়স্ক লোকের কান্না অসুন্দর লাগা। আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ মনে করে, বুড়াদের কান্না অসুন্দর। 

বয়স্ক লোকের জন্য খুব কঠিন এই পৃথিবী। তারা দুঃখে কান্না করলেও অনেকের কুৎসিত লাগে। তাদেরও চাওয়া-পাওয়া আছে, আছে কামনা-বাসনা। অথচ তাদের কামনা-বাসনারে আমাদের সমাজ নাম দেয় 'ভীমরতি'। যতি চিহ্নের মতো পঙক্তিশেষে, লোকচক্ষুর অন্তরালে বুড়াদের কান্দা লাগে। বুড়াদের ব্যাপারে সমাজ খুব নিষ্ঠুর, করুণ।  

বুড়া লোকের কান্না খুব বেদনারও বটে। ফেসবুকে কিছু লাইক কম পেলেও কাঁদতে পারে অল্পবয়সীরা। বয়স্কদের কান্না নিশ্চিতভাবেই কঠিন, তীব্র বেদনাজাত।      

আমাদের সমাজে পুরুষদের ক্ষেত্রেও কান্না এইরকম।  

পুরুষত্ব বিষয়ে গভীরে প্রোথিত ধারণাগুলা একটা যে পুরুষেরা কাঁদে না। যদিও কোনো ফিউনেরালে, দুই-এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলতে পারে, কিন্তু একজন 'প্রকৃত পুরুষ' এর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত (বিশেষত কান্নার ব্যাপারে)। প্রকাশ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করা মেয়েদের কাজ। 

অথচ কান্নায় এই জেন্ডার গ্যাপ আসলে খুব পুরোনো ঘটনা না। ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক সাক্ষীসাবুদ দেখায় যে, অতীতে, পুরুষেরা প্রকাশ্যে কান্না তো করতোই, সেই কান্নাকে ‘মেয়েলি’ বা লজ্জাজনকও ভাবতো না কেউ। ইন ফ্যাক্ট, ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, দুইশ বছর আগেও পুরুষের কান্না পৃথিবীর সকল প্রান্তেই স্বাভাবিক হিসেবে দেখা হতো। প্রাচীন গ্রিস বলেন আর প্রাচীন ভারত বলেন, কান্নারস ছিলো প্রাচীন পৃথিবীর থিয়েটারের গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ।  

অথচ এখন পুরুষের কান্না যেন খুবই লজ্জাজনক একটা ব্যাপার। 

'সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভালো হতো/ পুরুষ কিভাবে কাঁদে সেই শুধু জানে।' পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছেন৷  

কাঁদতে হলেও পুরুষকে সরোদ বাজায়ে কাঁদা লাগে। কান্নাকে একটা মেয়েলি ব্যাপার হিসাবে দেখা হয়। যেন কাঁদলে পৌরুষ কিছুটা কমে যায়!

এই জেন্ডার স্টেরিওটাইপ আর দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রথায় পাত্তা না দিয়া কান্না পেলে কাঁদবেন। দরদ মাখায়ে কাঁদবেন। পুরুষেরও কাঁদা উচিত, কান্না পেলে। কান্নার দায়িত্ব সরোদরেই কেন নিতে হবে?        

 

অতঃপর কান্না বিষয়ক সিরিয়াস আলোচনা 

উপরে যা পড়লেন তা আমার অল্প-পক্ব মস্তিষ্কের হাফবেইকড থিওরিসমূহ। এগুলোকে সিরিয়াসলি না নিলেই ভালো। তবে আপনি সিরিয়াসলি যদি একান্তই নিতে চান, এই লেখার নিচেরটুকু আপনার জন্যে। নিচের কথাগুলো আমার না, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের বহুযুগের বহুদিনের পরিশ্রমের ফসল। এবং কথাগুলো মোটামুটি 'বিজ্ঞানসম্মত'।

তো, প্রিয় পাঠক, কান্না বিষয়ক সিরিয়াস আলোচনায় আপনাকে স্বাগতম! 

 

কান্না আসে না 

মাইকেল ট্রিম্বল একজন বিহেভিয়েরাল নিউরোলজিস্ট। ব্রিটিশ এই ভদ্রলোকের এক্সপার্টিজ আবার বেশ অনন্য। ট্রিম্বল কান্না বিষয়ে  বিশ্বের একজন টপ এক্সপার্ট৷ কান্না বিষয়ে Why Humans Like to Cry: Tragedy, Evolution, and the Brain নামে তার একটা বিখ্যাত বইই আছে। একবার বিবিসি রেডিওর এক ইন্টারভিউয়ে যাওয়ার আগে তার সহকারী একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলো: কিছু লোক আছে যারা কাঁদে না। কেন? 

সহকারী তাকে বিস্তারিত বললো যে তার বন্ধুর স্বামীকে বন্ধু অনেক দুঃখের মুভি দেখিয়েছে অথচ,  ব্যক্তিজীবনেও অনেক দু:খজনক ঘটনা তার ক্ষেত্রে ঘটেছে। অথচ সে কখনও কাঁদে না, বা কাঁদতে পারে না৷ তার চোখে কখনও অশ্রু দেখা যায় নাই। 

ট্রিম্বল অবাক হলো। সে এবং আরও যেসব বিজ্ঞানী মানুষের কান্না নিয়ে গবেষণা করেছে তাদের মনোযোগ মূলত ভেজা চোখেই। শুষ্ক চোখে নয়। বিবিসির ইন্টারভিউয়ে যাওয়ার আগে ট্রিম্বল একটা [email protected] নামে একাউন্ট  খুলে, বিবিসির সেই লাইভ অনুষ্ঠানের শ্রোতাদের মধ্যে যারা কখনও কাঁদেন না তাদেরকে যোগাযোগ করতে বললেন। ট্রিম্বল শত শত মেসেজ পেলেন।   

তিনি স্বীকার করেছেন, 'কেন কিছু মানুষ কাদে না আমরা সেই ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না। শুধু তাই নয়, কেন মানুষ কাঁদে, বিশেষ করে প্রাপ্ত বয়স্ক লোকেরা কেন কাঁদে- সে ব্যাপারেও বিজ্ঞানীরা একমত নন।' 

ময়ূরের পেখমের রহস্যের ব্যাখ্যায় চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদী তত্ত্ব মোটামুটি অপ্রতিদ্বন্দ্ব। পেখমের প্রদর্শন যত জমকালো হবে, ময়ূরীকে আকর্ষিত করার সম্ভাবনা তত বাড়বে। কিন্তু ডারউইন যখন মানুষের কান্নার ব্যাখ্যা করতে গেলেন, খেই হারায়ে ফেললেন। 'আবেগের কান্না আসলে উদ্দেশ্যহীন' ১৮৭২ সালে লিখলেন ডারউইন। অথচ প্রায় দেড়শ বছর পরেও, আবেগের কান্না মানবশরীরের গভীরতম রহস্যগুলোর একটি হিসেবে রয়ে গেছে।

কিছু প্রজাতির প্রাণীর শারীরিক যন্ত্রণার জন্যে অটোমেটিক অশ্রু ঝরে। মানুষই একমাত্র প্রজাতি আবেগ অনুভুতির কারণে যাদের অশ্রু নির্গত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে না হয় বলা যায় যে, তারা বড়দের কাছ থেকে এটেনশন আর কেয়ারের পাওয়ার জন্যে কাঁদে। কিন্তু বয়স্কদের ক্ষেত্রে? কারণ পরিষ্কার না। বোঝাই যায় খুব তীব্র আবেগের কারণে প্রাপ্তবয়স্করা কাঁদে। কিন্তু কেন?

 

কান্না বিষয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণাও যৎসামান্য  

অবাক করা ব্যাপার হলো এমন একটা মৌলিক মানবিক অভিজ্ঞতার ব্যাপারে হার্ড ফ্যাক্ট নাই বললেই চলে। শরীরবৃত্তিক কাজের ( অশ্রু চোখকে লুব্রিকেট করে) বাইরে কান্নার আসলেই কোনো কাজ আছে কিনা বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই নিয়ে সংশয় আছে৷ 

তবে সব কান্নাও এক রকম নয়। মানবশরীর তিন ধরনের কান্না উৎপাদন করে। 

এক
মৌলিক কান্না যা শুষ্কতা থেকে রক্ষার জন্য চোখের বলের উপরে তৈলাক্ত স্তর তৈরি করে। 

দুই
প্রতিবিম্ব, যা চোখে ধূলিকণা বা কিছু পড়লে সেটা থেকে চোখকে রক্ষার জন্য হাজির হয়। পেঁয়াজ কাটার সময় বা তীব্র আলোর মুখোমুখি হলেও এটা হয়ে থাকে। অর্থাৎ চোখ কোনোভাবে বিরক্ত হলে প্রতিবিম্বের মাধ্যমে চোখ দিয়ে পানি বের হয়। 

তিন
আবেগীয়, যা সংবেদনশীল কোনো কারণে ঘটে থাকে। আবেগীয় বা সংবেদনশীল অশ্রুতে মৌলিক ও প্রতিবিম্বের চেয়ে প্রোটিনের মাত্রা বেশি থাকে। প্রোটিনের কারণে অশ্রু অনেক ঘন হওয়ায় ধীরে ধীরে সেগুলো চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে।

গবেষকেরা শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকর্মের বাইরে, মূলত কান্নার আবেগীয় দিকেই ফোকাস করেন। 'বিজ্ঞানীরা পেটের ভেতরের প্রজাপতি নিয়ে আগ্রহী না, তারা আগ্রহী প্রেমে।' বলেন, Why Only Humans Weep বইয়ের রচয়িতা এ্যাড ভিঙ্গারহেটস, যিনি নেদারল্যান্ডসের টিলবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কান্না বিষয়ক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন বিশেষজ্ঞ।

প্রচলিত ধারণা যে মূলত দু:খ পেলেই মানুষ কাঁদে। অথচ ভিঙ্গারহেটস ও অন্যান্যরা দেখিয়েছেন, কান্না শুধু দু:খবোধের লক্ষণ না। অনেক রকম আবেগ থেকে কান্নার সূত্রপাত হতে পারে। এর মধ্যে সহানুভুতি, সারপ্রাইজ, রাগ ও শোক অনেক কিছু কান্না নিয়ে আসতে পারে মানুষের চোখে৷ অশ্রু একটা সিগনাল যা অন্যেরা দেখতে পারে।  বর্তমানে কান্না গবেষকদের কাছে সিগনাল হিসেবে কান্নাকে দেখা গুরুত্ব পাচ্ছে।  

 

পুরোনো দিনের মানুষ কান্নাকে যেভাবে দেখতো 

কান্নার ব্যাপারে কঠিন মত শুধু ডারউইনেরই ছিল এমন না। কিছু হিসাব অনুযায়ী, মানবজাতি কান্না বিষয়ক বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনা শুরু করেছে অন্তত ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে। শত শত বছর ধরে মানুষ বিশ্বাস করেছে অশ্রুর উৎপত্তি হৃদয়ে। ওল্ড টেস্টামেন্টের মতে, হৃদয়ের 'বস্তুসমূহ' দূর্বল হয়ে পড়লে সেগুলো পানিতে রূপান্তরিত হয়। 

পরবর্তীতে হিপোক্রেটিসের সময়ে, মনে করা হতো যে অশ্রুর জন্যে মনই দায়ী৷ ষোড়শ শতকে সবচেয়ে প্রভাবশালী তত্ত্ব বিশ্বাস করতো, আবেগ- বিশেষ করে প্রেম- হৃদপিন্ডের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দেয়, ফলে শরীর নামক মেশিন নিজেকে ঠান্ডা করতে গরম বাষ্প তৈরি করে, যা একসময় মাথা পর্যন্ত উঠে যায় আর ঘনীভূত হয়ে এক পর্যায়ে অশ্রু আকারে বের হয়ে আসে৷ 

এই সমস্ত তত্ত্বের ধারা প্রথমবারের মতো ধাক্কা খায় ১৬৬২ সালে। নিলস স্টেনসেন নামের এক ডাচ বিজ্ঞানী ল্যাক্রিমাল গ্ল্যান্ড বা অশ্রুগ্রন্থি আবিষ্কার করেন। এবং কান্নার মূল উৎস হিসেবে ঘোষণা করে। তখন থেকেই বিজ্ঞানীরা চোখ থেকে বের হওয়া তরল পদার্থের বিবর্তনগত সুবিধা নিয়ে ভাবতে শুরু করে। স্টেনসেনের তত্ত্ব অবশ্য খুব সোজাসাপ্টা ছিলো : অশ্রু চোখকে আর্দ্র রাখার একটি উপায় মাত্র। 

এরপর অনেক বিজ্ঞানী 'মানুষ কেন কাঁদে?'- এই প্রশ্নটি সামনে রেখে তাদের গবেষণার বিষয় করেছেন অশ্রুকে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেননি। ভিঙ্গারহেটস তার বইয়ে আটটা প্রতিযোগী তত্ত্বের কথা বলেছেন।  এর মধ্যে কিছু আছে একদম হাস্যকর। যেমন, ১৯৬০ সালের দিকে কিছু বিজ্ঞানীর দাবি করেছিলেন যে, মানুষের উৎপত্তি ভল্লুকজাতীয় জলজ প্রাণী থেকে, এবং অশ্রু লবনাক্ত পানিতে বাস করতে সাহায্য করেছে। কিছু তত্ত্ব আবার যথেষ্ট প্রমাণ না হাজির করতে পারলেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে৷ যেমন, বায়োকেমিস্ট উইলিয়াম ফ্রে'র ১৯৮৫ সালে দাবি যে, মানসিক চাপের সময় রক্তে সৃষ্টি  হওয়া বিষাক্ত পদার্থ দূর করে কান্না।

আপাত দৃষ্টিতে চলনসই বেশ কিছু নতুন তত্ত্বের পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। একটা হলো, অশ্রু সামাজিক বন্ধন ও সম্প্রতির জন্যে ভূমিকা রাখে। 

অধিকাংশ প্রাণী যদিও জন্মের সময়ই মোটামুটি সাবলম্বী হয়ে জন্মায়, মানুষ পৃথিবীতে আসে সবচেয়ে দূর্বল হয়ে, শারীরিকভাবে নিজেরা কোনো কিছু না করতে পারার অক্ষকতা নিয়ে। তারপর  শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হলেও, প্রায়ই ঘিরে ধরা অসহায়ত্ব থেকে কখনই মুক্ত হয় না। 'কিছু জরুরি সমস্যা আছে যা অন্তত সাময়িকভাবে হলেও মানিয়ে নেয়া ও সামলানো অসম্ভব।

কান্না নিজেকে ও অপরকে এমন সিগনাল দেয়।'-বলেন  ইমোশন রিসার্চার ও সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির অধ্যাপক জোনাথন রটেনবার্গ৷  

বিজ্ঞানীরা এমন কিছু আলামত পেয়েছেন যা থেকে তাদের সিদ্ধান্ত: ইমোশনাল কান্নার অশ্রু পেয়াজ কাটার ফলে বা গ্লিসারিন ব্যবহার করার অশ্রুর চেয়ে রাসায়নিকভাবে আলাদা। কেন আবেগের কান্না অপরকে এতো স্পর্শ করে তার ব্যাখ্যা এটি করতে পারে। যেকোনো কান্নায় এনজাইম, লিপিডস, মেটাবোলাইটেস, ও ইলেকট্রোলাইটস থাকে। আবেগের কান্নায় এগুলোর পাশাপাশি প্রোটিনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। একটা হাইপোথিসিস হলো, প্রোটিন উপাদান বেশি থাকায়, এই অশ্রু অনেক বেশি চটচটে বা আঠালো হয়, ফলে ত্বকে বেশি লেগে থাকে, কান্না থেমে গেলেও অশ্রুর দাগ বেশিক্ষণ থাকে। এছাড়া  মুখমন্ডলে গড়িয়ে পড়তেও তুলনামূলক বেশি সময় লাগে। ফলে অন্যদের দৃষ্টিগোচর হতে পারে বেশি।  

প্রিয় পাঠক, এরপর থেকে কাউকে কাঁদতে দেখতে এইসব লক্ষণ দেখে কান্নাটা আসলেই আবেগ থেকে এসেছে না ফেইক তা বুঝে নিতে পারেন। 

 

কাঁদুনে হওয়াটা চরিত্রের কোনো সমস্যা না, বরং প্রায়শ গুণের পরিচায়ক? 

অশ্রু অন্যদেরকে দেখিয়ে দেয় যে আমরা ভালনাতেবল আর ভালনারেবিলিটি মানুষকে পরস্পরের কাছে আসতে বড় ভূমিকা রাখে। 'অন্যকে ইমোশনাল ভালনারেবল অবস্থায় দেখলে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের যে অংশটি সক্রিয় হয়, ব্যক্তির নিজের ভালনারেবল অবস্থাতেও সেই অংশটাই সক্রিয় হয়ে ওঠে।' লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের প্রফেসর ট্রিম্বল বলেন।  

ট্রিম্বলের মতে, 'বিবর্তনের এক পর্যায়ে নিশ্চয়ই এমন একটা সময় ছিলো যখন, অশ্রু অটোমেটিক অন্যদের মধ্যে সহানুভুতি তৈরি করতো। সত্যি বলতে, আবেগে কাদতে পারা, এবং সেই কান্নায় সাড়া দিতে পারা, মানবিক হওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।'

এগুলো তো গেল। কান্নাকে ইতিবাচকভাবে দেখার উদাহরণ। একটা থিওরি কান্নাকে দেখছে অন্যকে নিজের বশে আনার কৌশল হিসেবে। রটেনবার্গ বলছেন, 'জন্মের পর থেকেই আমরা শিখি অন্যের উপর কান্নার প্রভাব আছে৷ শিশুরা সেটি ভালো করেই বুঝতে পারে। তবে বড়রাও সেটা জানে। কান্না তাৎক্ষণিকভাবে রাগ অনেকখানি কমিয়ে আনতে পারে।'- এই কারণেই, রটেনবার্গের ধারণা, প্রেমিক-প্রেমিকার ঝগড়াখাটিতে কান্না একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষত যখন কারও মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে  এবং অপরজনের কাছে ক্ষমা প্রত্যাশা করে।'

এই বিষয়ে 'সায়েন্স' জার্নালের বহুউদ্ধৃত এক গবেষণার কথা বলা যায়। মিডিয়ায় যেটি নিয়া প্রচুর শোরগোল হয়েছে। এই গবেষণা অনুযায়ী, নারীদের অশ্রুতে এমন কিছু উপাদান থাকে যা পুরুষের যৌনউত্তেজনায় বাধা দেয় বা কমিয়ে আনে।

সেই গবেষণার একজন গবেষক নোম সোবেল জানান, 'এটি যে মিডিয়ায় প্রচুর ভুল শিরোনামের জন্ম দিয়েছে আমি তাতে মোটেই অবাক হই নি।' তার মতে, অশ্রু হয়তো সেক্সুয়াল এরাউজাল কমিয়ে আনতে পারে কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, অশ্রু এগ্রেসনও কমায়। 

পাঠক, আপনি কি এখনও আছেন আমাদের সাথে? 

শুরুতে আমরা কোথায় ছিলাম? 

ও হ্যাঁ! কিছু লোকের না কান্না করার মানে বা কেন কাঁদে না সেই প্রশ্নে ছিলাম। 

প্রশ্ন হলো অশ্রু যদি সামাজিক বন্ধন ও সহানুভুতির জন্যে এতোই জরুরি হয়, যারা কাঁদে না তারা কি সামাজিকভাবে খানিকটা বিচ্ছিন্ন? 

গবেষকেরা এই দিকে নজর দিচ্ছেন, এবং এখন পর্যন্ত কিছু গবেষকের দাবি উত্তরটা 'হ্যাঁ'।  ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট কর্ড বেনেকে জার্মানির কাসেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। বেনেকে ১২০ জন লোকের একান্ত, থেরাপি-স্টাইল ইন্টারভিউ নিয়েছেন। দেখতে চেয়েছেন যে যারা কাঁদে না বা কাঁদতে পারে না, তারা কাঁদতে পারাদের চেয়ে আলাদা নাকি। 

তার ধারণা, না কাঁদা লোকেদের নিজেদের সম্পর্ক থেকে উইথড্র করে নেয়ার প্রবণতা থাকে, তারা সমাজে তুলনামূলক বেশি বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে। বেনেকের ধারণা, কাদুনিদের চাইতে ননকাদুনিদের নেগেটিভ এগ্রেসিভ ফিলিংস বেশি।

বেনেকে অবশ্য বলেন, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে আরও গবেষণার প্রয়োজন। 

গবেষণায় এমন কোনো এভিডেন্স নিশ্চিতভাবে পাওয়া যায়নি, যে স্বাস্থ্যের জন্য কান্না ইতিবাচক। অথচ শত শত বছর ধরে এই মিথ চালু আছে যে, কান্না স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। একদল গবেষক, গত ১৪০ বছরে প্রকাশিত আর্টিকেল বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে ৯৪% লেখায় কান্নাকে শরীর ও মনের জন্যে উপকারী এবং কান্না চেপে রাখাকে ক্ষতিকর মনে করা হয়েছে। রটেনবার্গের মতে, এটা জাস্ট রূপকথা। এই দাবিকে সমর্থন করার মতো কোনো নির্ভরযোগ্য গবেষণাই এখন পর্যন্ত নাই।  

পাশাপাশি আরও একটা ধারণা প্রচলিত যে, কান্না স্বস্তি এনে দেয়। ভাসার কলেজের সাইকোলজির অধ্যাপক র‍্যান্ডি কর্নেলিয়াস বলেন, 'এরকম প্রত্যাশা আছে যে আমরা কান্নার পরে ভালো অনুভব করি। অথচ এ যাবৎকালের গবেষণা নির্দেশ করে উল্টোটা। আমরা কান্নার পরে ভালো বোধ করি না।' 

গবেষকেরা ল্যাবে লোকদেরকে দুঃখের মুভি দেখিয়ে তার পরপরই তাদের মুড পরীক্ষা করে দেখেছেন। যারা কেঁদেছেন তাদের মুড যারা কাঁদে নাই তাদের চেয়ে খারাপ ছিলো। 

তবে এই বক্তব্যের সাথেও অনেক যদি-কিন্তু-তবুও আছে। বিশেষত কান্নাকে রিলিফ হিসেবে দেখার ব্যাপারটা। কান্নার পজিটিভ ইফেক্ট পেতে একটা ফ্যাক্টর হলো সময় দেয়া।

ভিঙ্গারহেটস আর তার সহকর্মীরাও কিছু লোককে খুব কান্নাঘন ও আবেগঘন দুঃখের মুভি দেখালেন। তবে দেখার পরপরই নয়, বরং ৯০ মিনিট পরে তাদের মুড পরিমাপ করলেন৷ যারা মুভি দেখার সময় কেঁদেছে, মুভি দেখার আগের চেয়ে তাদের মুড ভালো ছিলো! 

কান্না বিষয়ক আধুনিক গবেষণা এখনও শৈশবে। তবে অশ্রুর রহস্য আর সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত যে কান্না আগে যতটা ভাবা হতো তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যা ভিঙ্গারহেটস, ট্রিম্বল, রটেনবার্গ বা নোম সাবেলের মতো গবেষকদের গবেষণা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়। 'মানবপ্রকৃতি বুঝতে অশ্রুর প্রাসঙ্গিকতা ব্যাপক। আমরা কাঁদি, কারণ আমাদের অন্য লোকদের দরকার।' 'তাই, ডারউইন' ভিঙ্গারহেটস হাসতে হাসতে এক ইন্টারভিউতে বলেন, ‘ওয়াজ টোটালি রং’।

১৪০৪ পঠিত ... ০৭:৫৮, জুলাই ১৪, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top