যেকোনো অফিসের একটি অলিখিত সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, সেখানে কাজের পাশাপাশি আড্ডাও হয়। eআরকির অফিস সেই নিয়ম একেবারেই মানে না। এখানে আড্ডা হয়, ইআরকি হয়, তার মাঝেসাঝে কেউ ফ্রি হলে কিছু (আ)কাজও হয়। এমনই একদিন চলছিল তুমুল আড্ডা। জাবি পড়ুয়া তন্ময় পাল অন্তু বললো, ‘ভাই, আমাকে ক্যাম্পাসের এক ভাই জোর করে ছাত্রলীগে নিয়ে নিচ্ছে, আমাকে ছাড়া নাকি চলবেই না।‘
আমরা আঁতকে উঠলাম! সে কি, এত এত মানুষ ছাত্রলীগে, তোরে ছাড়া চলবে না… মানে কী! অন্তু হেসে বললো, ‘ভাই, কারণ পাল ছাড়া তো নৌকা চলে না।’
বোঝা গেলো, বিষয়টা জাস্ট একটা ‘পান’। আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ওদিকে বুয়েটের সুস্মিত বললো, ‘আপনার স্ত্রী যদি বেটার হাফ হয়, তাহলে ডিভোর্সকে কী বলবেন?’ উত্তরও সে নিজেই দিলো, ‘হাফ ছেড়ে বাঁচা’। পাশ থেকে ইউল্যাবে পড়ুয়া দুর্জয় বললো, ভাই দেশে এই যে সবকিছুর সাথে সহমত হওয়ার সংস্কৃতি, এটাকে আপনি কী বলবেন?’
আশপাশ থেকে কমেডি শোয়ের মতো প্রশ্নসূচক ‘কীইইই’ ধ্বনি ওঠামাত্র দুর্জয়ের উত্তর, ‘এগ্রি-কালচার।‘
শব্দের উচ্চারণ, অর্থ কিংবা বানান পরিবর্তন করে দ্ব্যর্থ কিংবা নতুন অর্থ তৈরি করার এই খেলাকেই হিউমারজগতে বলা হয় ‘পান’। রম্যসাহিত্যের দুনিয়ায় পান বস্তুটা খানিকটা অবহেলিতই হয়ে আসছে এতদিন। তবে পানশিল্পীদের নিয়মিত উপস্থিতি ও আড্ডায় আমাদের পুরো অফিসটাই যেন হয়ে উঠেছে ‘পানের বরজ’! হুট করে তাই একদিন চা-পানের বিরতিতে আমাদের মাথায় এলো দুঃসাহসিক এক আইডিয়া। পান নিয়েই একটা স্ট্যান্ড আপ কমেডি শো করে ফেললে কেমন হয়?
একে তো নাচুনি বুড়ি, তার মধ্যে এই কমেডি শোয়ের আইডিয়া যেন ঢাকের বাড়ির মতো কাজ করলো। পানশিল্পীরা তুমুল উদ্যমে শুরু করলো ‘পানোৎপাদন’! ঢাবি পড়ুয়া মাসরুর সাদীদ ২৩৫ পৃষ্ঠা লম্বা এক স্ক্রিপ্ট নিয়ে হাজির। এত কথা বলা যাবে না জানতে পেরে সে কয়েক ঘন্টা ধরে স্ক্রিপ্ট কাটছাট করে বললো ‘ভাই এইবার দেখেন’। দেখা গেলো, স্ক্রিপ্টের বর্তমান পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৩৩।
তবে সমস্যা বাঁধলো অন্যখানে। পৃথিবীর এতসব কাজ ফেলে যারা eআরকি করে, তারা একটু আলসে হবে তাই তো স্বাভাবিক! মানুষজনের সামনে পান বলতে সবাই রাজি, তবে কেউ তা দাঁড়িয়ে বলতে চায় না। একজনের যুক্তি, ‘কমেডিয়ানরা এমনিতেই সবসময় দৌড়ের উপর থাকে, বসার সুযোগ পায় না। কমেডিও কেন দাঁড়িয়ে করতে হবে? এই নিষ্ঠুর পৃথিবী কি কমেডিয়ানদের বসতেও দেবে না?’
ঠিক হলো, কমেডি হবে। তবে স্ট্যান্ড আপ না, আমরা করতে যাচ্ছি ‘সিট ডাউন কমেডি’!
কমেডি শো নাহয় আমরা করলাম, কিন্তু সেই ছাইপাশ দেখতে আসবে কে? কীভাবেই বা আসবে? ঠিক হলো, অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে দর্শকরা আসতে পারবেন। চালু হলো রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া। ভাবতে যেমন মনে হচ্ছিল, দুদিন বাদে বোঝা গেলো ব্যাপারটা মোটেও ততটা সহজ হচ্ছে না। আমাদের মনে-প্রাণে বিশ্বাস, পারফর্মারদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ সব মিলিয়ে বিশ-ত্রিশজনের বেশি মানুষ আসবে না। শোয়ের সব রকম টেকনিকাল হ্যাপা সামলানো বিশিষ্ট খাদ্যরম্যবিদ সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ শুকনো মুখে জানালেন, অলরেডি ৭০ এর কাছাকাছি মানুষ রেজিস্ট্রেশন করে ফেলেছে!
কী করে যেন এই তথ্য মাসরুর সাদীদের কানে চলে গেলো। সে চুপিচুপি পাশে এসে কানে কানে বললো, ‘ভাই অনেক মানুষ যদি হয়, তাহলে স্ক্রিপ্টে আরও ১২৫টা পান এড করি?’
১৮ তারিখ সন্ধ্যা ৭টা বাজার আগেই দেখা গেলো, পরিস্থিতি আরও খারাপ। ১০০ মানুষ চলে এসেছে এরই মধ্যে, আরও অনেকে জানতে চাইছে অন স্পট টিকিট পাওয়া যাবে কিনা! আমি দ্রুত গেটে বলে দিলাম, পচা ডিমসহ ছুড়ে মারা যায় এমন কোনো জিনিস নিয়ে যেন কেউ না ঢোকে। জুতা ছুড়ে মারার রিস্ক এড়াতে তা বাইরেই খুলে আসার নিয়ম তো করা হয়েছিলই, তবুও কেউ বগলে জুতা নিয়ে ঢুকে গেলো কিনা তা একবার চেক করে দেখলাম। চেক করে এমন কিছু পাওয়া গেলো না, তবে দেখা গেলো আমাদের প্রথম পারফর্মার বুয়েটের সুস্মিত এখনো এসে পৌঁছায়নি! সে কি!
'যা আছে কপালে' মানসিকতা নিয়ে এগোলাম আমরা। শো শুরু হলো। সিমু নাসেরের ‘ভূমিকা’ অংশের পর সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ দর্শকদের জানালেন বাংলা সাহিত্যে ও সাহিত্যিকদের লেখায়-কথায় পানের ব্যবহার। সুস্মিত, আলভী, সাদীদ, দুর্জয় সালমান, অন্তু, আদ্রিতা, মিরাজ, ইরাবতী, একে একে পানের ধার দেখালেন সব তরুণ পানবিদরা। মাঝখানে প্যারোডি গান গেয়ে কবি নজরুলের প্রিয় ‘পান-গান’ কম্বিনেশনকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন ব্যান্ড কৃষ্ণপক্ষ।
শো যখন মধ্যগগনে, তখন হিউমার ও কার্টুন জগতের ‘বস’, আমাদের সবার প্রিয় উন্মাদ সম্পাদক আহসান হাবীব তার রত্নভাণ্ডার থেকে ছড়ালেন কিছু রত্ন। ছড়ায় ছড়ায় পান শোনালেন ফুল টাইম ছড়াকার পার্ট টাইম ডাক্তার রোমেন রায়হান। তবে সকল হাসি-ঠাট্টার আড়ালে প্র্যাকটিস-প্রস্তুতি থেকে শুরু করে পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে ব্যাকস্টেজে চিন্তিত মুখে বসে থাকা রোমেন ভাই যেভাবে পুরোদস্তুর অভিভাবকের মতো আগলে রেখেছেন সবাইকে, সে কথা নাহয় কারো না-ই জানা থাকলো।
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কথা ৯টায়। ঘড়ির কাটা ৯-১০ পেরিয়ে ১১র দিকে সদর্পে রওয়ানা হলো, শেষ হওয়ার নাম-গন্ধ কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ কি আশ্চর্য, পানশিল্পীরা হাসিয়ে ক্লান্ত, তবু হাসতে যেন ক্লান্তি নেই পানভক্তদের। সবশেষে আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুদিনে তাকে স্মরণ করে যখন ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’ গাইছে কৃষ্ণপক্ষ, বাড়ি ফেরার তাড়া না থাকা দর্শকেরা তখনো সেই সুরে মিলিয়ে চলেছেন সুর।
অনেকের মতো আমারও ধারণা ছিল, এই দেশে কমেডি এবং হিউমার বোঝার মতো, উপভোগ করার মতো লোক নেই। সিট ডাউন কমেডি দেখতে ও শুনতে আসা পরিণত রসবোধের দর্শকেরা এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করলেন, এজন্য তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে অনেক ছোট করতে চাই।
তবে কয়েকজন এই আয়োজনটির পেছনে, সামনে এবং চারপাশে এত বড় অবদান রেখেছেন, যতই ধন্যবাদ দেয়া হোক না কেন, তারা ছোট হবেন না। ধন্যবাদ তানভীর আরাফাত ধ্রুব ও ইমতিয়াজ ভাইকে, যারা শুরু থেকে শেষ, সাউন্ড থেকে লাইট, পানির ফিল্টার থেকে পা মোছা পাপোশ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে পাশে ছিলেন। ধন্যবাদ সাইফুল আজিমকে, সার্বিক সহযোগিতার জন্য। সিট ডাউন কমেডির পারফর্মার ও ভলান্টিয়ারদের প্রত্যেকের কর্মোদ্দীপনা ও উৎসাহ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে, কোনো ধন্যবাদই তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। সেই সকাল থেকে একেবারে রাত পর্যন্ত খেটেছে আমাদের অফিস সহকারী হাবিব, এখনো এক্স রে করানো হয়নি বলে আমরা জানি না সেটাকে হাড়ভাঙা খাটুনি বলা যায় কিনা! যার কথা না বললেই নয়, তিনি আমাদের এই ধুকতে থাকা আয়োজনকে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থতার দিকে নিয়ে গেছেন… ধন্যবাদ, প্রিয় রোমেন রায়হান ভাই!
হাহা, হিহি এবং হোহো নিয়ে আমরা আবারো আসবো, হাসি-আনন্দের নানান আয়োজন নিয়ে আমরা আবারও বসবো সিট ডাউন কমেডির পরবর্তী পর্বে। তবে আমরা যদি কাউকে হাসাতে না পারি, সেই দায় কিন্তু আমাদের না। সব দায় ইংরেজি অক্ষর B এর। কারণ Bদায়।
স্থিরচিত্রর পাশাপাশি দেখে নিন সিট ডাউন কমেডির এই অস্থির আসরের একটি অস্থিরচিত্র-
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন