যে কারণে Dengue শব্দটির উচ্চারণ ডেঙ্গু ও ডেঙ্গি, দুটোই সঠিক

১৮৮৪ পঠিত ... ১৮:৩৪, আগস্ট ০১, ২০১৯

: Dengue উচ্চারণ কী হবে, লিমন ভাই?
— কী হবে মানে? তুই কি আজ শব্দটি নতুন শুনলি, নীলা?
: না মানে নানানজন নানান কথা বলে?
— কী বলে?
: বলে এর উচ্চারণ ডেঙ্গু হবে না; আসল উচ্চারণ হবে ডেঙ্গি।
— দ্যাখ নীলা, প্রথম কথা হল তুই কোন ভাষায় কথা বলতে চাস? বাংলা না ইংরেজিতে?
: এ আবার কেমন কথা! অবশ্যই বাংলা ভাষায়।
— বাংলা ভাষায় হলে ডেঙ্গু বলবি।
: তোমার কথার পেছনে যুক্তি কী?
— যুক্তি ছাড়া গায়ের জোরে আমি কথা বলি না সে তো জানিস তুই।
: না, সেটাই বলো না, শুনি।
— দ্যাখ ডেঙ্গু শব্দটি ইংরেজি থেকে এসেছে আমাদের বাংলা ভাষায়। তবে মূল শব্দটি স্পেনিশ ভাষার। সে যাই হোক ইংরেজি ভাষা বা অন্য ভাষা থেকে শব্দ বাংলা ভাষায় আসার কিছু কায়দা-কানুন আছে। বাঙালির জিহ্বা শব্দটিকে কীভাবে গ্রহণ করে সেটিই হচ্ছে মূল কথা। এখানে জোরাবলির কিছু নেই। শব্দের সঙ্গে জোর খাটানো যায় না।

: হ্যাঁ, ঠিকই তো বলেছ তুমি, ইংরেজি ভাষার প্রচুর শব্দ বাংলা ভাষায় এসে মিশেছে।

— বাংলা ভাষায় ইংরেজির উদার অনুপ্রবেশ আজকের নয়, এবং শুধু ইংরেজি নয়, বাংলা ভাষা ১০ হাজারের মতো আরবি-ফার্সি শব্দও নিয়েছে। এ রকম শব্দ নেওয়ার চর্চা সব ভাষাতেই আছে। ইংরেজি নিয়েছে লাতিন, ফরাসি এমনকি হিন্দি-উর্দু থেকে, ফরাসি নিয়েছে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষা থেকে। ইংরেজি ডিকশনারি খুললে দেখবি সেখানে পণ্ডিত শব্দটি আছে। পণ্ডিত তৎসম শব্দ। ইংরেজি অভিধানে আছে 'Pundit', এই যে গ্রহণ প্রক্রিয়া এটি ভাষার সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার একটি উপাদান। কিন্তু এই গ্রহণ এমন কোনো পর্যায়ে ভাষাকে নিয়ে যায় না, যেখানে ভাষার মৌল চরিত্রই বদলে যায় বা ভাষা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, মিশ্র ভাষায় রূপ নেয়।

: আচ্ছা।

— ইংরেজি শব্দ তিনভাবে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে।
১) অনেকটা ইংরেজি উচ্চারণে: কলেজ, নভেল, নোট, ইউনিভার্সিটি, ইউনিয়ন, পাউডার, পেন্সিল, ব্যাগ, ফুটবল, মাস্টার, লাইব্রেরি, কোচিং, নার্সিং, ড্রয়িং, মিটিং, রিপোর্টিং, বোলিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিং ইত্যাদি।

২) পরিবর্তিত উচ্চারণে: অফিস (Office), আফিম (Opium), ইস্কুল (School), বোতল (Bottle), বাক্স (Box), হাসপাতাল (Hospital) ইত্যাদি।

৩) মিশ্র শব্দ: হেড-মৌলভি (ইংরেজি + ফারসি), হেড-পণ্ডিত (ইংরেজি + তৎসম), খ্রিষ্টাব্দ (ইংরেজি + তৎসম), ডাক্তার-খানা (ইংরেজি + ফারসি), পকেট-মার (ইংরেজি + বাংলা)
একটি প্রশ্ন, এই শব্দগুলো কি এখন শুধুই ইংরেজি শব্দ? এর উত্তর না। এই শব্দগুলো এখন বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত বিদেশি শব্দ।

: আচ্ছা লিমন ভাই, তবে বুঝলাম বিদেশি শব্দ যেভাবে এসে প্রাকৃতিকভাবে আমাদের মুখে আশ্রয় নেয় সেটিই বাংলা ভাষায় সেই শব্দের উচ্চারণ।

— ঠিক। আমরা কি এখন বাংলায় কথা বলার সময় টেবল (Table) বলি? না। আমরা বাংলায় টেবিল বলি। আবার ইংরেজিতে কথা বলার সময় টেবল বলি। কই কোনো দ্বন্দ্ব তো নেই। আছে না কি তুই বল? তারপর ধর হাসপাতাল শব্দটি। ইংরেজিতে এ শব্দটি হসপিটাল (Hospital)। এখন কি হাসপাতাল শব্দটিকে বাদ দিয়ে দিতে হবে?

: না। বাদ দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। হাসপাতাল যখন আমরা বলি তখন এর ভেতর একটি মাধুর্য ফুটে ওঠে।

— তবে? Dengue শব্দটিকেও বাঙালি আপন করে নিয়েছে। এটি এখন বাংলা ভাষার শব্দ। উৎপত্তি অনুসারে বিদেশি শব্দের (স্পেনিশ) অন্তর্ভুক্ত। বাঙ্গালি ডেঙ্গু বলে। অতএব বাংলা ভাষায় সঠিক উচ্চারণ ডেঙ্গু। তবে যদি কোনো সেমিনারে ইংরেজিতে বক্তব্য উপস্থাপন করিস সেখানে ইংরেজি উচ্চারণে ডেঙ্গি (Den-gee) বলবি। ব্যস এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দের আর কিছু নেই। অনেকে ডেঙ্গিউ উচ্চারণ করেন, এটি প্রমিত রীতি নয়।

: আচ্ছা লিমন ভাই এই যে ‘Dengue’ বাংলায় ডেঙ্গু হয়ে গেল একে কোথায় ব্যাখ্যা করা যায়? আমি বলতে চাইছি ব্যাকরণের কোন বিষয়ে গেলে এই পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারব? সন্ধি, সমাস, না প্রত্যয় পড়লে জানতে পারব?

— হ্যাঁ, ব্যাকরণ একে ব্যাখ্যা করে। এই ব্যাখ্যা পাবি ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ত্বে (Phonetics), আরও সুস্পষ্টভাবে বললে ধ্বনি পরিবর্তন অধ্যায়ে। সেখানে স্বরসঙ্গতি বলে একটি টার্ম আছে। স্বরসঙ্গতির বৈশিষ্ট্য— পূর্ববর্তী স্বরের প্রভাবে পরবর্তী স্বরের পরিবর্তন হয়। এটি দ্বারা আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি, ডেঙ্গি থেকে ডেঙ্গু কীভাবে হল। প্রথমে বিশ্লেষণ করি। ডেঙ্গি=ড্+এ+ঙ্গ্‌+ই এবং ডেঙ্গু=ড্‌+এ+ঙ্গ্+উ। অর্থাৎ পূর্ববর্তী এ-কারের প্রভাবে পরবর্তী ই-কার উ-কারে পরিণত হয়। আমি যতটুকু জানি সাধ্যমতো ব্যাখ্যা করলাম নীলা।

: দৈনিক পত্রিকাগুলো কী লেখে লিমন ভাই? ডেঙ্গু, না ডেঙ্গি?

— ভালো বলেছিস। প্রধান দৈনিক পত্রিকাগুলোর ভাষা দেখতে হয়। তারা কীভাবে লিখছে। পত্রিকাগুলো বাংলা প্রমিত বানানের একটি স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখে। যেমন ইচ্ছা তেমন লেখার সুযোগ নেই। দৈনিক পত্রিকাগুলো ‘ডেঙ্গু’ লেখে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা বাংলা ভাষার অভিধান। বাংলা ভাষার শব্দ নিয়ে সমস্যা হলে দমে দমে বাংলা অভিধানের সাহায্য নিবি। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ও আধুনিক বাংলা অভিধান খুবই ভালো। এখানে ইচ্ছামতো ধুম করে একটি শব্দ অন্তর্ভুক্ত করার উপায় নেই। বিশেষ করে ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ড. মুহম্মদ শহীদুউল্লাহর সময় থেকে সম্পাদিত হয়ে আসছে। কোনো একটি নতুন শব্দ সেখানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে বাংলা ভাষার বিজ্ঞ পণ্ডিতরা তার অনুমোদন দেন। অভিধান খুলে দ্যাখ সেখানেও ডেঙ্গু লেখা আছে।

: অনেক ধন্যবাদ, লিমন ভাই। এতক্ষণে পরিষ্কার হল।

— পরিষ্কার হল কই। তোরা তো সুযোগ পেলেই বাংলা ভাষার মৌল চরিত্র নিয়ে ঘোঁট পাকাস। তুই যে অহরহ বই বলিস, বল তো বই শব্দটি কোন ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে।

: ওমা এটা বাংলা ভাষার শব্দ না?

— বাংলা ভাষার শব্দ তো বটেই। কিন্তু এসেছে কোথা থেকে? আরবি ভাষা থেকে এসেছে।

: আরবি থেকে?

— জি। আরবি ওয়াও বর্ণটি বাংলায় এসে অন্তঃস্থ ব হয়। আর এখন বাংলায় অন্তঃস্থ ব আর বর্গীয় ব-এর উচ্চারণ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। ওহি থেকে প্রথমে বাংলায় হয়েছে বহি। এখনও সাধু ভাষায় বহি প্রচলিত। আর বহি থেকে হয়েছে বই। মানে ওহি>বহি>বই।

: বাহ লিমন ভাই, ভারি চমৎকার বললে। আচ্ছা স্পেনিশ ডেঙ্গু শব্দটি কীভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেল?

— ধারণা করা হয় শব্দটি স্পেনিশ ভাষায় গেছে সুয়াহিলি ভাষা থেকে। সুয়াহিলি ভাষা চিনিস? এটি পূর্ব আফ্রিকার সোয়াহিলি জাতির ভাষা। সোয়াহিলি জাতির লোকেরা দক্ষিণ সোমালিয়া থেকে উত্তর মোজাম্বিক পর্যন্ত ভারত মহাসাগরের উপকূলে বাস করে। সুয়াহিলি ভাষায় একটি বাগধারা বা phrase ছিল কা-ডিঙ্গা পেপো (Ka-dinga pepo), এর অর্থ হল দুষ্ট আত্মার (Evil spirit) কারণে ঘটিত রোগ। আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রীতদাসদের মধ্যে যাদের ডেঙ্গু হত হাড়ের ব্যথায় তাদের ভঙিমা ও চলন ডান্ডি নৌকার মতো হয়ে যেত, সেজন্য রোগটিকে ডান্ডি ফিভারও (Dandy fever) বলা হয়।

: তারপর?

— তবে এই ডেঙ্গু জ্বরটির ইতিহাস সুপ্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ২৬৫-৪২০ অব্দে চীনের জিন সাম্রাজ্যের সময় এক চীনা মেডিকেল এনসাইক্লোপিডিয়ায় এই রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা জানা যায়। সেখানে এর পরিচিতিতে বলা হয়েছে জলীয় বিষ, যা সম্পর্কিত উড়ন্ত পতঙ্গের সঙ্গে (Water poison associated with flying insects), আর মহামারী বা এপিডেমিক হিসাবে ডেঙ্গু জ্বরের নির্ভরযোগ্য প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় ১৭৭৯ ও ১৭৮০ সালে ফিলাডেলফিয়া এলাকায় যা এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকায় বিস্তৃত ছিল। ডেঙ্গু জ্বরের আরেকটি নাম নিশ্চয়ই শুনেছিস হাড়ভাঙ্গা জ্বর বা ব্রেকবোন ফিভার বা লা ডেঙ্গু (la dengue)।

লেখা: মোরশেদ হাসান

১৮৮৪ পঠিত ... ১৮:৩৪, আগস্ট ০১, ২০১৯

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top